জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞার দেড় বছর পর ভিসা নিয়ে ওয়াশিংটনের নতুন নীতির ঘোষণা এল।
নতুন নীতির অধীনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা বন্ধ হয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিংকেন বুধবার এক বিবৃতিতে এই ঘোষণা দিয়ে দাবি করেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থেই তাদের এই পদক্ষেপ।
এদিকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, এই ঘটনায় বিচলিত নয় সরকার।
বিবৃতিতে ব্লিংকেন বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে যারা এগিয়ে নিতে চায়, তাদের সবাইকে সমর্থন দিতে এই নীতি ঘোষণা করেছেন তিনি।
তার ভাষ্যে, “এই নীতির অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে।”
এর মধ্যে বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা বা কর্মচারী, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার মধ্যে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তা তুলে ধরে ব্লিংকেন বলেন, “গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে: ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হবার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেওয়া এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা।”
ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ধারা ২১২ (এ)(৩)(সি) এর অধীনে নতুন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এই সিদ্ধান্তের কথা যুক্তরাষ্ট্র সরকার গত ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেন ব্লিংকেন।
এদিকে ব্লিংকেনের এমন ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নিয়ে সরকার ‘বিচলিত নয়’।
বুধবার রাতে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “এটা কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়। এতে সরকার বিচলিত নয়, যেহেতু আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
শাহরিয়ার পাল্টা বলেন, “বিএনপিকে দুশ্চিন্তা করা উচিৎ, কেননা নির্বাচনের আগে বা পরে সংঘাত রয়েছে ভিসা বিধি-নিষেধের আরেকটি মানদণ্ড হিসাবে রয়েছে।”
বছর শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পদক্ষেপ এল।
এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এলিট ফোর্স র্যাব এবং এর সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
ওই সময়ে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও তৎকালীন আইজিপি বেনজীর আহমদের সঙ্গে কক্সবাজারে র্যাব-৭ এর সাবেক অধিনায়ক মিফতা উদ্দিন আহমেদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল দেশটি।
অবশ্য নিজের মেয়াদের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিয়ে ২০২২ সালের অগাস্টে জাতিসংঘের পুলিশ প্রধান সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বেনজীর।
জাতিসংঘের কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘রীতি অনুযায়ী’ যুক্তরাষ্ট্র অনেক সময় ভিসা নিষেধাজ্ঞায় ছাড় দিয়ে থাকে বলে সে সময় জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
ভিসা বিধি-নিষেধের বিষয়ে বুধবার রাতে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, “আজ বাংলাদেশের জনগণের জন্য আমাদের বার্তা হচ্ছে যে, আমরা আপনাদের পেছনে আছি।
“আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পেছনে আছি এবং আপনাদের দেশে গণতন্ত্রকে সহায়তার জন্য আমরা এই নীতি ঘোষণা করছি।”
এটা নতুন নিষেধাজ্ঞা নয়- জানিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি এই বার্তা পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা আইনের এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে আমাদের কর্তৃত্ব ব্যবহারে প্রস্তুত আছি।”
এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশে যদি কেউ জনগণের ক্ষমতার উপর হস্তক্ষেপ করতে চায়, তাদের এই বার্তায় দেওয়া যে ওয়াশিংটন ঘটনার উপর চোখ রাখছে, যা জনগণ ভরসা পায়।
“আমরা মনে করি, আইনের এই ধারা প্রয়োগের সামর্থ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের কাছে এমন সংকেত পাঠানোও গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে আছি, আর আমরা অ্যাকশন নিতে প্রস্তুত।”
ভিসা নিষেধাজ্ঞা কী, কীভাবে কার্যকর
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি প্রকাশের পাশাপাশি ভিসা নিষেধাজ্ঞা কী এবং কীভাবে কোনো ব্যক্তিদের উপর তা কার্যকর হয়, তা প্রশ্নোত্তরে তুলে ধরেছে।
প্রশ্ন: এসব ভিসা বিধিনিষেধ কার/কাদের জন্য প্রযোজ্য হবে?
উত্তর: এই নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যে কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্য অনেকের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তা/কর্মচারী, সরকারের সমর্থক এবং বিরোধী দলীয় সদস্যরা এর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের ব্যক্তিদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
প্রশ্ন: এখন কি এই নীতিমালার আওতায় কোনো ভিসা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে?
উত্তর: না। সেক্রেটারি অফ স্টেট যেমনটা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারকে আমরা স্বাগত জানাই।
প্রশ্ন: এই ভিসা বিধিনিষেধ কি সরকার বা আওয়ামী লীগের দিকে নির্দেশ করছে?
উত্তর: না, যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। এই নতুন নীতির অধীনে বিধি-নিষেধগুলি সংশ্লিষ্টতা নির্বিশেষে সেইসব ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে পরিচালিত যারা গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন আচরণে/কর্মকাণ্ডে জড়িত।
প্রশ্ন: যাদের ভিসা প্রত্যাহার করা হয়েছে আপনারা কি তাদের অবহিত করবেন?
উত্তর: যাদের ভিসা প্রত্যাহার বা বাতিল করা হয়েছে তাদের অবহিত করা একটি সাধারণ রীতি।
প্রশ্ন: উচ্চ স্তরের আদেশ অনুসরণ করে যারা অপরাধ করে তাদের জন্য ভিসা বিধি-নিষেধ কীভাবে প্রযোজ্য হবে? আদেশ পালনকারীদের সাথে উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদেরকে যুক্ততার বিষয়টি যদি কঠিন হয় তবে কী হবে?
উত্তর: বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই নীতি প্রযোজ্য।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রদূত হাসের নিরাপত্তা হ্রাস করার বাংলাদেশ সরকারের ১৪ মে’র সিদ্ধান্তের প্রতিশোধ হিসেবে কি এই ঘোষণা?
উত্তর: বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গত ৩ মে এই নীতিগত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করেছি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন এত চিন্তিত?
উত্তর: যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কে সমর্থন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করার অঙ্গীকার করেছে। এই নীতিটি সেই প্রচেষ্টাকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে সাহায্য করার জন্য প্রণীত হয়েছে, যাতে তারা তাদের নেতা বেছে নেওয়ার জন্য নির্বাচন করতে পারে।