ইভিএম নিয়ে ইসির পিছু হটা রাজনৈতিক সংকট মোচনে ভূমিকা রাখবে?
Published : 04 Apr 2023, 01:08 AM
বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মধ্যেও সংসদের অর্ধেক আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের পরিকল্পনা ধরে এগোচ্ছিল নির্বাচন কমিশন। সেই পরিকল্পনা বদলে গেছে; সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে ব্যালট পেপারে।
এটা কি সব দলকে নির্বাচনে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে, সেই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও এটাই সব কিছু বলে এখনই মনে করছেন না জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলছেন, সব দল যেন ভোটে আসে, সেই পরিবেশ এখন তৈরি করতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বারবারই বলে আসছেন, সব দলকে ভোটে আনতে তাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
যদিও এখনও তেমন ইঙ্গিত মিলছে না, যখন বিএনপিসহ তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিটিই সামনে রাখছে।
এই বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি।
সব দলের অংশগ্রহণে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে হবে সেই নির্বাচন- এমন প্রত্যাশা দেশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যবেক্ষক মহলেরও।
ইভিএম নিয়ে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সংকট মোচনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা।
দলগুলো থেকেই এসেছিল আপত্তি
হাবিবুল আউয়াল কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে গত বছর ইভিএমে নিয়ে ইসি যে সংলাপ ডেকেছিল, তাতে ৩৯টি দলের মধ্যে বিএনপিসহ ১০টি অংশই নেয়নি। অংশ নেওয়াদের মধ্যে জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল ইভিএমের বিপক্ষে মতামত দেয়।
সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ইসির রোডম্যাপে বলা হয়, সংলাপে অংশগ্রহণকারী ২৯টি দলের মধ্যে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে ১৭টি রাজনৈতিক দল। বিপক্ষে মত দিয়েছে ১২টি দল।
সংলাপে না যাওয়া দলগুলোকে হিসাবে নিলে ইভিএমের বিরোধিতাকারী দলের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২।
এরপরও সর্বোচ্চ দেড়শ’ আসনে ইভিএমে ভোট করার প্রকল্প নেওয়ার প্রস্তুতি চলে। অক্টোবরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে।
কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্রকল্পে সায় দেয়নি সরকার।
নতুন ইভিএম কেনার প্রকল্প বাদ হওয়ার পর হাতে থাকা দেড় লাখ ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রায় ১২৫৯ কোটি অর্থ বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু তাও মেলেনি।
ইভিএমের জন্য ইসির ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প
'অর্থসঙ্কটে' ইভিএম প্রকল্প স্থগিত
সংসদ নির্বাচনে ইভিএম থাকছে না, সব আসনে ব্যালট পেপারে ভোট
সোমবার এ প্রসঙ্গ ধরে ইভিএমে থেকে সরে যাওয়ার ব্যাখ্যা ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, “অর্থ মন্ত্রণালয় তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, কিন্তু আগামী অর্থ বছরে পাওয়া যেতে পারে বলে নিশ্চয়তা দেয়।
“এ অবস্থায় ইভিএমগুলো কিউসি (কোয়ালিট চেকিং) করে কাজ করার মতো অর্থ ইসির হাতে নেই এবং সময় সাপেক্ষ বিষয়। ”
কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কোনো ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। ৩০০ আসনেই ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ হবে।
রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে বিরোধিতাও কমিশনের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে বলে জানান ইসি সচিব।
“নির্বাচনের আগে সময় স্বল্পতা ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ পেতে নিশ্চয়তা না পাওয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে যে ঐক্যমতের অভাব রয়েছে- সব বিষয় বিবেচনা করে নির্বাচন কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
ইসিতেও ছিল ভিন্নমত
সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনারের উপস্থিতিতে কমিশন সভায় ৩০০ আসনে ব্যালট পেপারে ভোটের সিদ্ধান্ত হলেও তাতে সবার সায় ছিল না।
আর্থিক সংকট বিবেচনায় হাতে থাকা ইভিএম দিয়ে ন্যূনতম কয়েকটি আসনে হলেও ভোট করার পক্ষে ছিলেন অন্তত একজন।
বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন ইভিএমে করে আসছে। সংসদীয় দুটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনও করা হয়েছে। তবে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোয় ব্যালটে ভোট হয়।
পাঁচ বছর আগে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোটের নজির রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় এবারও কয়েকটি আসনে করার পক্ষে মত আসে।
কিন্তু সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত না হলেও সংখ্যাধিক্যের মতামতে কোনো আসনেই ইভিএম হচ্ছে না দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে।
কোনো নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের সঙ্গে এ নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতেও নারাজ। মতৈক্যের মধ্যে পাঁচ সিটি নির্বাচনে কেন ইভিএমে ভোট হচ্ছে তা নিয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি ইসি সচিবও এড়িয়ে যান।
স্বাগত জাপার, বিএনপির আগ্রহ নেই
ইসির সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি, যে দলটি ইভিএমে ভোটের পক্ষে শক্ত অবস্থানে ছিল।
তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় বলেছেন, কীভাবে নির্বাচন হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবেই যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “এটা আমাদেরও দাবি ছিল। যেহেতু কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। একই সাথে নির্বাচন যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয় এবং নির্বাচন যতে নিরপেক্ষ হয়, তার জন্য যে পরিবেশ দরকার, তা কমিশন নিশ্চিত করতে হবে এখন।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য বলছেন, ইভিএমে ভোট না কি ব্যালট পেপারে ভোট, তা নিয়ে তাদের এখন কোনো আগ্রহ নেই। তারা চাইছেন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন।
তিনি এক ইফতার অনুষ্ঠানে বলেন, “আজকে নাকি নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে যে, ইভিএমে নয়, ব্যালটেই নির্বাচন হবে। এই বিষয়ে একজন সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করলেন। আমি তাকে বলেছি যে, এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের এতটুকু আগ্রহ নেই।”
ইসির এই সিদ্ধান্তেও বিএনপির অবস্থানের হেরফের হচ্ছে না জানিয়ে ফখরুল বলেন, “আমরা পরিষ্কার করে বলেছি যে, আজকে জাতির যে সংকট, সেই সংকট হচ্ছে - নির্বাচনকালীন সময়ে কোন সরকার থাকবে, কী ধরনের সরকার থাকবে? সেটাই প্রধান সংকট।”
সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব।
ইভিএম প্রত্যাখ্যান, ব্যালটে ভোট চায় বিএনপি
এখন কাগজের ব্যালটে ভোটেও আগ্রহ নেই বিএনপির: ফখরুল
এই সিদ্ধান্তের ‘প্রভাব পড়বে’
ইভিএম বাদ দেওয়াকে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলছেন, এই সিদ্ধান্তের প্রভাব অন্য ক্ষেত্রেও পড়বে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইভিএম নিয়ে সমঝোতা ছিল না। কারও কারও আপত্তি ছিল, ঘোর বিরোধিতা ছিল। সব বিবেচনা করে বর্তমান কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, (৩০০ আসনে ব্যালট পেপার থাকবে) তা সঠিক সিদ্ধান্ত।”
সামনে পাঁচ সিটি করপোরেশনে যে নির্বাচন রয়েছে, তা ‘বিশ্বাসযোগ্যভাবে’ করতে পারলে তা ইসির আস্থা অর্জনে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।
ফেয়ার ইলেকশন মনটরিং অ্যালায়েন্স (ফেমা) সভাপতি মুনিরা খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা প্রশংসাযোগ্য । ইভিএম থেকে সরে গিয়ে এখন শক্ত হাতে নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাইবে।”
আলীম বলেন, “ইসির এ সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামান্য হলেও সাহায্য করবে করলে মনে করি।”
বিএনপি যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের কথা বলছে, সে দাবি মেটানোর এখতিয়ার ইসির নেই। সিইসি বলে আসছেন, এর সমাধান রাজনৈতিক দলগুলোকেই করতে হবে।
এর মধ্যে বিএনপিসহ ৯ দলকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায়ও ডেকেছে ইসি; যদিও কোনো দলই তাতে সাড়া দেয়নি।
আব্দুল আলীম বলেন, “দলগুলোও বলেছে-এটা (রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন) ইসির এখতিয়ার না। আসলে উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারি দলের, যে দলই ক্ষমতায় থাকবে তার।
“ইতোমধ্যে দলগুলোর প্রতিনিধিরা জাতীয় পার্টির ইফতারের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে, এটাও ভালো দিক। এভাবে দুরত্বটা কমে গেলে, যদি এক টেবিলে বসে কথা বলে সমস্যাগুলো থাকবে না। আশা করি, সব দলের অংশগ্রহণে একটা ভালো নির্বাচন পাব।”
সব দলকে ভোটে আনতে কমিশনের উদ্যোগ চান সাবেক সিইসি হেনা