হত্যার আসামি রবিউলই দুবাইয়ের আরাভ খান, বলছে পুলিশ

‘আরাভ জুয়েলার্স’ এর উদ্বোধনে যোগ দিতে দুবাই গেছেন সাকিব আল হাসান, হিরো আলমসহ বিনোদন জগতের বেশ কয়েকজন তারকা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2023, 03:23 PM
Updated : 15 March 2023, 03:23 PM

ঢাকার পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি পলাতক রবিউল ইসলামকে নিয়ে আবার তোলপাড় শুরু হয়েছে।

‘আরাভ জুয়েলার্স’ নামে একটি গয়নার দোকানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ইউটিউবার হিরো আলমসহ দেশের বিনোদন জগতের বেশ কয়েকজন তারকা দুবাই গেছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ওই দোকানের মালিক আরাভ খানই পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যা মামলার প্রধান আসামি রবিউল ইসলাম।

তাকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়া হবে জানিয়ে পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, “ওই রবিউল এখন দুবাইয়ে অবস্থান করছেন ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে, যেখানে তার নাম লেখা আরাভ খান।”

রবিউলের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার হিরন ইউনিয়নে। স্থানীয়রা বলছেন, তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ‘সোহাগ মোল্লা’। বিভিন্ন সময় তার খোঁজে এলাকায় পুলিশ গেছে। ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যার পর সেই মামলাতেও পুলিশ তাকে খুঁজতে এলাকায় যায়।

তখনই জানা যায়, ওই সোহাগই ঢাকায় রবিউলসহ বিভিন্ন নাম নিয়ে ‘ব্ল্যাকমেইল ও প্রতারণা’ করে বেড়াচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন পরিচয়ে বেশ কয়েকটি বিয়ে করেছেন বলেও স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির ভাষ্য।

এসবির পরিদর্শক মামুন ইমরান খান ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বন্ধু রহমত উল্লাহ সঙ্গে বনানীর একটি বাসায় গিয়ে খুন হন। পরদিন তার মৃতদেহ বস্তায় ভরে উলুখোলার জঙ্গলে নিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পোড়ানো হয় অপরাধের চিহ্ন গোপন করার জন্য।

মামলার তদন্ত শেষে পরের বছরের এপ্রিলে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সেই অভিযোগপত্রে বলা হয়, রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করত একটি চক্র। তাদের লক্ষ্য ছিল রহমত উল্লাহকে আটকে ‘অশালীন’ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে টাকা আদায় করা।

সেজন্য ওই চক্র জন্মদিনের নাটক সাজিয়ে রহমতকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল বনানীর এক বাসায়।বন্ধু রহমতের সঙ্গে সেখানে গিয়ে হত্যার শিকার হন পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান।

সেসময় মামলাটির তদন্তে যুক্ত ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহীদুর রহমান। তিনি জানান, রবিউলসহ ১০ জনকে আসামি করেই ২০১৯ সালের এপ্রিলে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয় আদালতে।

পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই রবিউলই দুবাইয়ের আরাভ খান বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তাকে আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।"

মামুন হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে রবিউল ছাড়াও তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া (২১), নিহত মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহ (৩৫), স্বপন সরকার (৩৯), দিদার পাঠান (২১), মিজান শেখ (২১), আতিক হাসান (২১), সারোয়ার হোসেন (২৩) এবং দুই কিশোরীকে আসামি করা হয়।

সোহাগ মোল্লা থেকে আরাভ খান

মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, রবিউল গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের মতিউর রহমান মোল্লা এবং লাকি বেগমের ছেলে। ওই গ্রামটি উপজেলার হিরন ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত।

Also Read: ‘অভিনয়ের সঙ্গীদের ফাঁদে’ খুন হন এসবি পরিদর্শক মামুন

এই আরাভ খানই যে সেই রবিউল, তা নিশ্চিত করছেন হিরন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজহারুল আলম পান্নাও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ওকে আমরা ছোটবেলা থেকে সোহাগ নামে চিনি। ওরা হল মোল্লা বংশ। ওর মা নাম রাখছে সোহাগ মোল্লা। ওর বাবা সিলভারের হাড়ি-পাতিল বিক্রি করত, ভাঙ্গারি কিনত। ওর মামার বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারি। সোহাগ জন্মের পর থেকে বেশিরভাগ সময় সেখানেই ছিল। লেখাপড়া বেশিদূর করেনি। মাঝে মধ্যে গ্রামে আসত।

“একটু বড় হওয়ার পর ঢাকার দিকে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় গ্রামে তার খোঁজে পুলিশ আসা শুরু করে। পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন খুনের আসামি হওয়ার পর আমরা জানলাম এই সোহাগ ঢাকায় রবিউল, আপন, হৃদয় ইত্যাদি নানা নাম নিয়ে কী সব করে বেড়াচ্ছে।”

সোহাগ ওরফে রবিউল ‘১৫-২০টার মত’ বিয়ে করেছে– এমন তথ্য দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান মাজহারুল বলেন, তিনি জেলা পরিষদের সদস্য থাকার সময় সোহাগের ৬-৭টা বিয়ের সালিশ-মীমাংসা করেন। এর বাইরে তার আরও স্ত্রী আছে বলে তখনই জানতে পারেন।

দরিদ্র পরিবারের সন্তান সোহাগ ওরফে আরাভ কী করে হঠাৎ এত ধনী হয়ে উঠল জানতে চাইলে মাজহারুল বলেন, “এই প্রশ্ন তো আমারও, এখানকার কেউ বুঝতে পারতেছে না ব্যাপারটা কী। এমনিতে গ্রামে বছরে সে দুয়েকবার আসত। লাল রঙ করা চুল, পরনে দামী কাপড়। চার-পাঁচ বছর আগে কোরবানির ঈদে এসে হঠাৎ করে তিনটি গরু কোরবানি দিল। তখন এলাকার সবার তাক লেগে যায়।”

এই সোহাগ বা রবিউলই যে আরাভ খান তা কী করে নিশ্চিত হলেন জানতে চাইলে চেয়ারম্যান মাজহারুল বলেন, আড়াই-তিনমাস আগে তিনি ওমরাহ করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। সেখানে তার সঙ্গে সোহাগ ওরফে রবিউলের দেখা হয়েছিল। তখনিই রবিউল তাকে বলেছিলেন যে, দুবাইতে একটা গয়নার দোকান করতে যাচ্ছেন তিনি। বিস্মিত হয়ে চেয়ারম্যান মাজহারুল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত টাকা কোত্থেকে আসবে? জবাবে রবিউল বলেছিলেন, “আরে কাকা আপনি আমার বন্ধু বান্ধবদের চেনেন? এগুলা কোনো ব্যাপার না।”

মাজহারুল জানান, পরে আরাভ নামের একটি ফেইসবুক আইডি খুলে রবিউল থেকে আরাভ হয়ে যান তাদের পরিচিত সোহাগ মোল্লা।

“কয়েক বছর আগে এসবির ইন্সপেক্টর মার্ডার হওয়ার পর এখানকার ওসি সাহেব আমাকে বলল যে ওর খোঁজ-খবর দরকার। এরপর তারা নানাভাবে ওকে ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু পারেনি। পরে শুনি যে ও দুবাই গেছে, ভারত গেছে আরও কত কী। ওর কথা শুনে আমি বিশ্বাসই করি নাই। ভাবছি চাপা-টাপা মারছে হয়ত। এখনতো দেখি পত্রিকায় ছবি ছাপা হইছে। এইটাই ওর ছবি, এখানে সবাই চিনছে। আগে চুল বড় ছিল, এখন ছোট করছে।”

রবিউল ওরফে আরাভ খানের এই হঠাৎ ধনী হওয়া দেখে এলাকার মানুষও বিস্মিত জানিয়ে চেয়ারম্যান মাজহারুল বলছেন, “ঢাকার কী করত তার কিছু কিছু পরে শুনছি। এরপর এলাকার লোক ওরে এড়ায়া চলত। দুবাই গিয়া কী আলাদিনের চেরাগ পাইলো আল্লাই জানে।”