‘অভিনয়ের সঙ্গীদের ফাঁদে’ খুন হন এসবি পরিদর্শক মামুন

বিভিন্ন অপরাধমূলক নাটকে অভিনয়ের সূত্র ধরে যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, তাদের ফাঁদে পড়েই পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান খুন হয়েছিলেন বলে উঠে এসেছে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযোগপত্রে।  

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2019, 04:09 PM
Updated : 11 April 2019, 04:09 PM

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান মোট দশজনকে আসামি করে গত ৮ এপ্রিল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এই অভিযোগপত্র দেন।

আসামিরা হলেন- রবিউল ইসলাম (৩০), রবিউলের স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া (২১), মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহ (৩৫), স্বপন সরকার (৩৯), দিদার পাঠান (২১), মিজান শেখ (২১), আতিক হাসান (২১), সারোয়ার হোসেন (২৩) এবং দুই কিশোরী।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করত একটি চক্র। তাদের লক্ষ্য ছিল রহমত উল্লাহকে আটকে ‘অশালীন’ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে টাকা আদায় করা। সেজন্য তারা জন্মদিনের নাটক সাজিয়ে রহমতকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল বনানীর এক বাসায়।

বন্ধু রহমতের ডাকে ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বনানীর ওই বাসায় গিয়ে খুন হন এসবির পরিদর্শক মামুন ইমরান খান। পরদিন মামুনের মৃতদেহ বস্তায় ভরে উলুখোলার জঙ্গলে নিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পোড়ানো হয় অপরাধের চিহ্ন গোপন করার জন্য।

তিন দিন পর সেখান থেকে পরিদর্শক মামুনের পোড়া লাশ উদ্ধার হলে তার ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদী হয়ে রাজধানীর বনানী থানায় এই হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে হত্যাকাণ্ডের পুরো বিবরণ। 

ঢাকার নবাবগঞ্জের রাজরামপুরের মৃত আজহার আলী খানের ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট মামুন লেখাপড়া করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

২০০৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর তিনি শান্তিরক্ষা মিশনেও দায়িত্ব পালন করেন। খুন হওয়ার সময় তার কর্মস্থল ছিল শান্তিনগরে পুলিশের বিশেষ শাখার ট্রেনিং স্কুল।

অবিবাহিত মামুন বড় ভাই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে থাকতেন তার সবুজবাগের বাসায়। কৈশোর থেকেই অভিনয়ের ঝোঁক ছিল মামুনের। টেলিভিশনে কয়েকটি নাটকে অভিনয়ও করেছেন তিনি।  

অভিযোগপত্রে বলা হয়, টেলিভিশনে একটি ক্রাইম ফিকশনে অভিনয়ের সূত্র ধরে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার রহমত উল্লাহর সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় পুলিশ কর্মকর্তা মামুনের। নাটকের সূত্রেই তাদের সঙ্গে এক কিশোরীর পরিচয় হয়, যে রবিউলের চক্রের একজন সদস্য।   

রবিউলের স্ত্রী কেয়াকে ওই কিশোরী জানায়, রহমত উল্লাহকে ফাঁদে ফেলে মোটা টাকা আদায় করা সম্ভব। সে অনুযায়ী তৈরি হয় জন্মদিনের নাটকের ছক। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই সন্ধ্যায় বনানীর এক বাসায় ওই কিশোরীর ‘জন্মদিনের অনুষ্ঠানে’ দাওয়াত দেওয়া হয় রহমত উল্লাহকে।

দাওয়াত পেয়ে রহমত উল্লাহ তার বন্ধু মামুনকেও সঙ্গী হতে অনুরোধ জানায়। তারা ওই বাড়িতে পৌঁছালে ওই কিশোরী দুজন নারীকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে আসে। তাদের একজনকে বোন, অন্যজনকে ভাবি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে রহমত ও মামুনকে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, “বাসায় গিয়ে তারা (রহমত উল্লাহ ও মামুন) দেখেন, জন্মদিনের কোনো আয়োজন নেই। রহমত উল্লাহ তখন ওই কিশোরীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমাদের নাকি বার্থডে পার্টি, কিন্তু কিছু তো দেখছি না।’ রবিউলের স্ত্রী কেয়া তখন বলেন, ‘প্রতিদিন আমাদের পার্টি এরকমই হয়। একটু পরই দেখতে পাবেন’।”

কেয়া ওই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর স্বপন, দিদার, আতিক ও মিজান ঘরে ঢোকেন। শুরু হয় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। 

“তারা মামুন ও রহমতের উদ্দেশে বলে, ‘বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে তোরা এখানে এসেছিস।’ মামুন প্রতিবাদ করলে সঙ্গে সঙ্গে ওই চারজন তাকে মারতে শুরু করে। আসামিদের একজন বলে, ‘ওদের হাত-পা বেঁধে ফেল। মেয়েদের সঙ্গে ছবি তুলে টাকা আদায় করা হবে।’ স্বপন, আতিক ও দিদার তখন মামুনকে চেপে ধরে এবং তার হাত-পা বেঁধে ফেলে।

“আসামি মিজান মুখ চেপে ধরলে মামুন তার হাতে কামড় দেন। তখন মিজান ও দিদার পেছন থেকে মামুনের ঘাড়ে আঘাত করেন এবং আতিক জোরে লাথি মারলে মামুন সংজ্ঞা হারান। রহমত উল্লাহকেও তখন বেঁধে ফেলে রাখা হয়।”

অভিযোগপত্রে বলা হয়, রাত ১২টার দিকে স্বপন বুঝতে পারেন, মামুনের হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। রবিউলকে তিনি ফেনে বিষয়টি জানান। এরপর রবিউলের পরামর্শে স্বপন, আতিক ও দিদার ধারালো অস্ত্র দিয়ে মামুনের পায়ের আঙুল কেটে দেখেন। রক্ত বের না হওয়ায় তারা নিশ্চিত হন যে পুলিশ কর্মকর্তা মামুনের মৃত্যু হয়েছে।

স্বপন আর দিদার তখন রবিউলকে ফোন করে বড় একটি ট্রলি বা বস্তা নিয়ে আসতে বলেন। সকাল ৭টার দিকে স্বপন, দিদার ও আতিক লিফট দিয়ে মামুনের লাশ নিচে নামিয়ে রহমত উল্লাহর প্রাইভেট কারে তোলে।

রহমত উল্লাহই তার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যান। দিদার, আতিক, স্বপন ও মিজানও ছিলেন ওই গাড়িতে। দলের নেতা রবিউল মোটরসাইলে যান সামনে সামনে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, কালীগঞ্জের উলুখোলায় বাঁশঝাড় দেখে স্বপন সেখানে গাড়ি থামাতে বলেন। গাড়ি থেকে লাশ নামিয়ে বাঁশঝাড়ের মধ্যে নিয়ে আতিক ও স্বপন পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর রহমত উল্লাহ গাড়ি চালিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন।

তিন দিন পর রায়েরদিয়া সড়কের পাশের ওই জঙলা এলাকায় বস্তাবন্দি পোড়া লাশ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা উলুখোলা পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে, পরনের প্যান্ট ও কোমরের বেল্ট দেখে পরিবারের সদস্যরা মামুনের পরিচয় শনাক্ত করেন।

তদন্তে নেমে প্রথমেই রহমত উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে গ্রেপ্তার করা হয় সুরাইয়া আক্তার কেয়া, মিজান শেখ ও দুই কিশোরীকে।  পরে তাদের মধ্যে তিনজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেতে হত্যা রহস্য স্পষ্ট হয়।

মিজান ও কেয়াকে গ্রেপ্তারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেছিলেন, “ওই চক্রের টার্গেট ছিল রহমত উল্লাহকে ওই বাসায় আটকে ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করে তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়া। কিন্তু মামুন যাওয়ায় এবং নিজেকে পুলিশ বলায় তাদের সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যায়।”