প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর: নজরে এবার প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলছেন, সরকার জাপানের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ উন্নীত করতে চায়।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2022, 07:31 PM
Updated : 23 Nov 2022, 07:31 PM

জাপান ও বাংলাদেশের সম্পর্কে এতদিন বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রাধান্য পেলেও এবার যুক্ত হচ্ছে প্রতিরক্ষা খাত। 

চলতি নভেম্বর মাসের শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ও গুরুত্ব পাবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। 

২৯ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর জাপান সফর করবেন শেখ হাসিনা। সফরের প্রস্তুতি আর আলোচনার নানা দিক নিয়ে এখন কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর। 

ওই সফরে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্র উন্মোচনে দুই দেশের মধ্যে একটি সম্মতিপত্র (লেটার অব ইনটেন্ট) সই হওয়ার কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো জাপানও পৃথক কৌশল নিয়ে কাজ করছে। বাণিজ্য-বিনিয়োগের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কার্যক্রম বিস্তৃত করতে চাইছে দেশটি। 

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের যে সম্পর্ক, তাকে বলা যায় ‘কম্প্রিহেনসিভ রিলেশনশিপ বা কম্প্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ’। 

“এটাকে আমরা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপে উন্নীত করতে চাই। সেটা করতে হলে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা হবে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আরও অনেক বিষয় আছে।” 

পররাষ্ট্র সচিব বলছেন, এবারের সফরে এটি হবে ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক’। কাঙ্ক্ষিত সেই সহযোগিতার জন্য জাপানের সাথে চুক্তিও করতে হবে। সময় স্বল্পতার কারণে চুক্তির বিষয়গুলো এবার চূড়ান্ত করতে না পারায় কেবল ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ সই হবে। 

সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করা মানে হল, দুই দেশ যে এ বিষয়ে সহযোগিতা এগিয়ে নিতে আগ্রহী, তার সাধারণ ও প্রাথমিক ঐকমত্য। সেই সহযোগিতার আওতায় কোনো কোন বিষয় থাকতে পারে, তার একটি ধারণা সেখানে পাওয়া যাবে।    

“এটাকে কেন্দ্র করে বা এটাকে ধরে আগামীতে হয়ত আরও কনক্রিট এগ্রিমেন্টস সাইন হবে দুদেশের মধ্যে,” বলেন মাসুদ। 

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদার জাপান। ১৯৭২ সাল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী জাপানের প্রতিশ্রুত ‍উন্নয়ন সহযোগিতার পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৭৪৩ কোটি ডলার। 

ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে ‘ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক’ বা ফোইপ শীর্ষক কৌশল নিয়ে কাজ করছে জাপান। বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথাও রয়েছে সেখানে। 

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টোকিও সফরে জাপানের ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। ওই উদ্যোগ সংক্ষেপে ‘বিগ-বি ইনিভিয়েটিভ’ নামে পরিচিতি। 

গবেষকরা বলছেন, বিগ-বি পরিকল্পনার আওতায় প্রাথমিকভাবে অর্থনীতি, অবকাঠামো ও উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া হলেও এর ভূ-রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। জাপান যে দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইছে, সেটা অনুমেয়। 

প্রতিরক্ষা খাতে ঢাকার সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে করণীয় নির্ধারণে জাপানের আগ্রহের কথা গত বছরই জানিয়েছিলেন দেশটির রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। সে সময় মূলত সমুদ্র নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে এই সহযোগিতার কথা তিনি বলেছিলেন। 

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন ক্ষেত্রে বিস্তৃত করার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জাপান থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের সম্ভাবনার কথা তিনি বলেন। 

ইতো নাওকি বলেন, “আমি মনে করি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আরও সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারি আমরা। এবং আমরা বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা যন্ত্রপাতি রপ্তানির সম্ভাবনার বিষয়ে নজর দিচ্ছি। একটি জাপানি কোম্পানি প্রতিরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহের আগ্রহও দেখিয়েছে।” 

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্ককে ‘সমন্বিত অংশীদারিত্বের’ মাত্রায় উন্নীত করার কথা বলা হয়েছিল। জাপানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ওই বছরই ঢাকা সফর করেন। তখনই ‘বিগ-বি’র আওতায় আরও শক্তিশালী অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিভাষায় দুই বা ততোধিক দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের বন্ধন হল ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’। 

সমন্বিত অংশীদারিত্ব ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের মধ্যে তুলনা করে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, “কম্প্রিসেনসিভ পার্টনারশিপ (সমন্বিত অংশীদারিত্ব) হল ভালো-মন্দ সবকিছু মিলিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপের (কৌশলগত অংশদারিত্ব) ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের বাইরে একটু বৃহৎ অনুষঙ্গ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়। 

“আপনি যখন কম্প্রিসেনসিভ বলেন, এটা বোঝায় দ্বিপক্ষীয়, ছোট-বড় সব বিষয় এর মধ্যে আসতে পারে। স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপের বিষয় হল, আপনি দুদেশের বাইরেও চিন্তাভাবনা করতে পারেন। দুইয়ের বাইরেও আপনার মধ্যে আলাপ-আলোচনা হতে পারে।” 

ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের কৌশলকে সন্দেহের চোখে দেখে চীন। এর বিপরীতে এশিয়ার সঙ্গে সড়ক ও নৌপথে আফ্রিকা ও ইউরোপের দেশগুলোকে যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই’ বাস্তবায়ন করছে এশিয়ার এই পরাশক্তি। 

জাপানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় গেলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে কি-না, এমন প্রশ্নে জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে আসা মাসুদ বিন মোমেন বলেন, কারও সঙ্গে কোনো সংঘাতে বাংলাদেশ যাবে না। 

“জাপানের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক অনেক পুরনো। সুতরাং ওরা যদি আমাদের দক্ষিণের দিকে, অর্থাৎ মাতারবাড়ি-কেন্দ্রিক গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য যে সম্ভাবনাগুলো আছে, এগুলাতে যদি আরও অবকাঠামোতে কাজ করতে চায়, আমরা স্বাগত জানাব। কে কি মাইন্ড করল, সেটা বিবেচনায় নিলেতো আমরা কাজই করতে পারব না। তাই না?” 

আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি ‘হাব’ হয়ে ওঠার যে সম্ভাবনা বাংলাদেশ দেখছে, সে কথা তুলে ধরে মাসুদ বলেন, নেপাল, ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকে রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর যে সম্ভাবনার কথা বাংলাদেশ বলে বা ভাবে, তা অনেকাংশে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর নির্ভরশীল। 

এখন জাপানের সহযোগিতায় সেই উন্নয়নের কাজটি যদি করে ফেলা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে বাকি বিষয়গুলোও বাংলাদেশ এগিয়ে নিতে পারবে বলে পররাষ্ট্র সচিবের বিশ্বাস।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার বিভীষিকা কাটিয়ে জাপান মন দিয়েছিল অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে। সামরিক উচ্চাশা তারা দীর্ঘদিন অবদমিতই রেখেছিল। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সময় থেকে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জাপানের সেই অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমেরিকারও এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা আছে জাপানের কাছ থেকে যে, টোকিও যেন আরেকটু প্রো-অ্যাক্টিভ হয় সিকিউরিটির ব্যাপারে। অনেক সময় আমেরিকাই বলে, জাপানকে আরও সক্রিয় হওয়া উচিত ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যালায়েন্সে।” 

সেই বিবেচনা থেকে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলছেন, ‘জিওপলিটিক্যালি’ জাপানের সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

Also Read: এফটিএ না হলে বাংলাদেশ ছাড়তে পারে ২০% জাপানি কোম্পানি: জরিপ

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ার কারণেও জাপান অস্ত্র বিক্রি করতে আগ্রহী হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “জাপান যদি অ্যাপ্রোচ করে থাকে, অস্ত্র বিক্রির বিষয়টা, তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে ২০ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য আছে, সে এটার রিটার্ন দিতে পারবে। এখন আমরা কী করব সেটা দেখার বিষয়। 

“এই অস্ত্রগুলো নিয়ে আমি কী করব আসলে? আমারতো কোনো শত্রু নেই সেই হিসাবে। এজন্য হোমওয়ার্কটা আমাদের করতে হবে।” 

বাংলাদেশ কবে কোন দেশ থেকে কত টাকার অস্ত্র কিনল, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব সরকার প্রকাশ করে না। তবে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, ২০০৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ১৮ দেশ থেকে ৪০১ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের অস্ত্র কিনেছে বাংলাদেশ। 

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৮৮ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের অস্ত্র কেনা হয়েছে চীন থেকে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রাশিয়া থেকে কেনা হয়েছে ৪৯ কোটি ৬০ ডলারের অস্ত্র। 

এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, ইতালি, তুরস্ক, ইউক্রেইন, সার্বিয়াসহ বিভিন্ন দেশ রয়েছে বাংলাদেশে অস্ত্র রপ্তানিকারদের তালিকায়। 

চীন, ভারত, সৌদি আরব, কাতার, রাশিয়া, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বা সামরিক চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্যারিস সফরে ফ্রান্সের সঙ্গেও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্মতিপত্র সই হয়। 

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, জাপান থেকে অস্ত্র বা সমর সরঞ্জাম কেনা হলে তা যেন তৃতীয় কোনো দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে প্রভাব না ফেলে, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। 

“জাপান যদি শর্ত দেয়, তাদের অস্ত্র কেনার কারণে চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখা যাবে না, বা এটা চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে হবে, তাহলে বাংলাদেশ তখন আগ্রহী হবে না।” 

এফটিএ সইয়ের প্রক্রিয়া 

ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সহজ করতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) সম্ভাবনা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছে ঢাকা ও টোকিও। 

এফটিএ করার আগে ‘কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট বা সেপা‘র মত চুক্তি করা নিয়েও ভাবছে দুদেশ। 

এ বিষয়ে বড় পরিসরে যৌথ গবেষণা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া প্রধানমন্ত্রীর সফরে চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। 

তিনি বলেন, “ওই রকম (চুক্তি) করার আগে একটা স্টাডি করতে হবে, সেটা ফাইনালাইজ হবে এবার। এটা হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। তারপর ওদের নিয়ম অনুযায়ী ধাপে ধাপে যেতে হয়, সেটা হবে।” 

ঢাকা-টোকিও এফটিএ সই হলে কী ধরনের ফলাফল আসবে, সে বিষয়ে চলতি বছরের জুনে ঢাকায় একটি গবেষণা জরিপ প্রকাশ করে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) ও জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (জেবিসিসিআই)। 

জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ইউজি আন্দো সে সময় জানান, ১০০টি জাপানি ও ৩০টি বাংলাদেশি বহুজাতিক কোম্পানির ওপর ওই জরিপ করা হয়। এর ৮৫ শতাংশ, অর্থাৎ ১১১টি কোম্পানি জাপান-বাংলাদেশ এফটিএ সই হওয়ার প্রত্যাশার কথা বলেছে।

ওই জরিপে ২০ শতাংশ জাপানি কোম্পানি বলেছে, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর জাপানের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) উঠে গেলে তারা বাংলাদেশ থেকে আসিয়ান, চীন বা ভারতের মত প্রতিযোগিতামূলক বাজারে স্থানান্তরিত হওয়ার চিন্তা করতে পারে। কিংবা উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে। 

ওই জরিপ প্রকাশের অনুষ্ঠানে ঢাকায় জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেছিলেন, এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হলে এখনকার জিএসপি সুবিধা থাকবে না। সেক্ষেত্রে নতুন ব্যবস্থাপনা দরকার, এফটিএ হতে পারে সেরকম কিছু। 

“এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে কেউ চাইলেও আগের জিএসপি সুবিধা রাখতে পারবে না, কারণ আইনি ফ্রেমওয়ার্ক নাই। এফটিএ হতে পারে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আইনি ফ্রেমওয়ার্ক।” 

বেসরকারি খাতের ওই জরিপের ধারাবাহিকতায় সরকারিভাবে যৌথ গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কি-না, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বলেন, “ওদের ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট মিনিস্ট্রি আছে, ওদের আন্ডারে বোধহয় করবে। জেট্রোর সহযোগিতাতো থাকবেই। এটা ওদের নিয়মের মধ্যেই আছে আর কি।” 

গত কিছুদিনে চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে জাপান বাংলাদেশে বিনিয়োগের কার্যক্রম বাড়িয়েছে বলে জানান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমেদ। 

তিনি বলেন, “ফ্রি ট্রেড আসলে সবসময় ফ্রি না, সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। জাপানের আগ্রহটা বেড়েছে, কারণ যেহেতু তাদের প্রচুর ইন্ডাস্ট্রি চীন থেকে সরাতে চাচ্ছে। 

“চীন কস্টলি হয়ে যাচ্ছে। কারণ চীনের শ্রম ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের ইকোনমিক জোন– প্রভৃতির ব্যাপারে তাদের (জাপানের) আগ্রহ বেশি, কারণ তারা যদি ওখান (চীন) থেকে সরাতে পারে, তাদের প্রফিট মার্জিন কিন্তু বেড়ে যাবে।” 

কম টাকার শ্রমের ফলে বাড়তি মুনাফার হার আর ১৭ কোটি মানুষের বাজারের কারণে বাংলাদেশের বিষয়ে জাপান আগ্রহী হচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ। 

তিনি বলেন, “ভূ-রাজনীতিতো আছেই। রাজনীতি দিয়ে তো ব্যবসায়ী মহল নড়ে না। সে মুনাফা দেখে সবসময়। তবে আমাদের অন্য মার্কেটের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে আমরা অন্য ঝামেলায় পড়ে যাব।” 

ব্যবসা ও বিনিয়োগের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাড়তি গুরুত্ব পাবে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বলেন, ৩০ নভেম্বর সকাল থেকেই অনেকগুলো আয়োজন আছে। বাংলাদেশ থেকে বড় প্রতিনিধিদল এবার জাপান যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা), বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি রয়েছে সেখানে। 

বাংলাদেশের আড়াইহাজারের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারী জাপানি কোম্পানিগুলোর নির্বাহীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের সূচি রয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব। 

নতুন কোনো প্রকল্পে জাপানের বিনিয়োগের সম্ভাবনার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “অনেকগুলো বড় বড় প্রকল্পতো পাইপলাইনে আছেই, সেগুলোর উপরই জোর দেওয়া হবে। 

“ইআরডি (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) থেকে হয়ত কিছু প্রকল্পের ব্যাপারে ফাইনালাইজ করছে, যেগুলো হয়ত ওদেরকে প্রেজেন্ট করা যেতে পারে।” 

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে জাপান থেকে ২৪৩ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের আমদানি করেছে বাংলাদেশ। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে গেছে ১৩৫ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের পণ্য। 

দুই দেশের মধ্যে শুল্ক বাধা কমিয়ে এনে বাণিজ্য বাড়াতে একটি চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে। গত ১৪ নভেম্বর মন্ত্রিসভায় ‘এগ্রিমেন্ট অন কো-অপারেশন অ্যান্ড মিউচুয়াল অ্যাসিট্যান্স ইন কাস্টমস ম্যাটারস’ শীর্ষক ওই চুক্তির খসড়াও অনুমোদন করা হয়েছে।  

রোহিঙ্গা সঙ্কট 

প্রধানমন্ত্রীর সফরে বরাবরের মতই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য জাপানের সহযোগিতা চাওয়া হবে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। 

তিনি বলেন, “জাপানের সাথে মিয়ানমারের বেশ ভালো যোগাযোগ আছে। এখন মিয়ানমারে সামরিক জান্তা আসার পর থেকে একটু বোধহয় ভাটায় আছে। তারপরও ওদের ইনভেস্টমেন্ট, অন্যান্য জিনিস চিন্তা করলে তাদের কিছু প্রভাব আছে। সেটা ব্যবহার করে যদি প্রত্যাবাসনে আমাদের সহায়তা করা যায়, সেটা অবশ্যই চাইব।” 

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ-মিয়ানমারকে নিয়ে চীনের মত ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব জাপানকেও দেওয়া যায় বলে মনে করছেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ। 

তিনি বলেন, “জাপানের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালো, জাপানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো। তাহলে সে কেন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ নিচ্ছে না? যাতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো ত্বরান্বিত করা যায়, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরতে পারেন।”