সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড বহাল না থাকার কারণ হিসেবে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে দুর্বলতাকে দায়ী করেছিল ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি।
Published : 14 Aug 2023, 11:31 PM
হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৩ সালের শুরুতে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় এসেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সেই ট্রাইব্যুনালের রায় পাল্টে গিয়েছিল আপিলে। বছর দেড়েক পর ২০১৪ সালের শেষে আপিল বিভাগ সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। সেই দণ্ড ভোগ করার মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে সোমবার অসুস্থ হয়ে মারা যান তিনি।
সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড বহাল না থাকার কারণ হিসেবে তখন তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে দুর্বলতাকে দায়ী করেছিল ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি।
কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বলেছিলেন, “বিচারের ক্ষেত্রে তথ্য উপস্থাপনের দুর্বলতা আমাদের ক্ষুব্ধ করেছে। সঠিকভাবে তারা আমাদের সাহায্যও নেয়নি।”
মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে একাত্তরে জামায়াত নেতা সাঈদীকে পিরোজপুরের মানুষ চিনত ‘দেইল্লা রাজাকার’ নামে। তিনি যে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় অংশ নিয়েছেন, প্রসিকিউশন তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরে হত্যা, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য সাঈদীকে। পরের বছর ১৪ জুলাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াত নেতাদের মধ্যে সাঈদীর বিরুদ্ধেই সবার আগে অভিযোগ গঠন হয়। একাত্তরে ৩ হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুর ও ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ২০টি ঘটনায় ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
রাষ্ট্রপক্ষে ২৮ জন এবং আসামিপক্ষে ১৭ জনের সাক্ষ্য শুনে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ সাজার রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল।
রায়ের পর দেশজুড়ে সহিংসতা চালায় জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। ওই তাণ্ডবে প্রথম তিন দিনেই নিহত হন অন্তত ৭০ জন। এছাড়া বহু গাড়ি-দোকানপাট ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, হিন্দুদের মন্দির-ঘরবাড়ি ভাংচুর করা হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালেরই ২৮ মার্চ আপিল করেন সাঈদী। অন্যদিকে প্রমাণিত হলেও সাজা না হওয়া ছয় অভিযোগে এই জামায়াত নেতার শাস্তি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
দুই পক্ষের আপিল আবেদনের শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল তা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে আপিল বিভাগ। তার পাঁচ মাস পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় ঘোষণা করে।
এর মধ্যে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা সব অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেন। আর বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী আসামির মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় দেন।
তবে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মতামতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় আসে।
আপিলের রায়ে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করায় সাঈদীকে ‘যাবজ্জীবন’ কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যাবজ্জীবন বলতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় পর্যন্ত’ কারাবাস বোঝাবে বলে ব্যাখ্যা দেন প্রধান বিচারপতি।
এছাড়া ৮ নম্বর অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৭ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। এই মামলায় সাঈদী ও রাষ্ট্রপক্ষের দুটি আপিল ছিল। আদালত উভয়টির আংশিক মঞ্জুর করে।
এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর ফাঁসির রায় দিয়েছিল।
আপিলে সাজা কমানোর রায় আসায় তাৎক্ষণিকভাবে আদালতের বাইরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন।
আর জামায়াতের তরফে বলা হয়েছিল, তারা খালাস আশা করেছিলেন।
‘তথ্য উপস্থাপনে দুর্বলতায় ফাঁসি এড়ান সাঈদী’
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বলেছিলেন, যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও সাঈদীর মামলার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্য উপস্থাপনে দুর্বলতা ছিল।
আপিলের রায়ে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমে যাওয়ায় সেসময় হতাশা প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ)।
সাঈদীর দণ্ড মওকুফের সুযোগ বন্ধ করতে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ সংশোধনের দাবিও জানিয়েছিল সংগঠনটি, যে অনুচ্ছেদ বলে রাষ্ট্রপতি যে কাউকে ক্ষমা করতে পারেন।
সর্বোচ্চ আদালতে মামলাটি পরিচালনাকারী তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম (প্রয়াত) বলেছিলেন, “এই মামলায় তদন্তকারী দলের গাফিলতি ছিল। তদন্ত কর্মকর্তারা ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার পর তার স্ত্রী যে এজাহার করেছিল, তা খুঁজে পায়নি।
“সাঈদীর আইনজীবী (আদালতে) ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রীর যে এজাহারটি তুলে ধরেছেন, তাতে সাঈদীর নাম নেই। অথচ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সেটি খুঁজে পায়নি। এমনকি ওই এজাহার ধরে সাঈদীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা চলেছে।”
তখন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনোলের তদন্ত সংস্থার সংন্বয়কারী সানাউল হক বলেছিলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলও এজাহারটি উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
“তিনি নিজেও তো বরিশাল-পিরোজপুর গিয়েছিলেন, সেই নথি খুঁজে বের করতে, পারেননি তো? ওই জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাও বলেছেন, এমন কোনো কাগজ তারা খুঁজে পাননি।”
এর উত্তরে মাহবুবে আলম বলেছিলেন, “আমি মনে করি সেই নথিটি ছিল। কারো যোগসাজসে সেটি সরানো হয়েছে, যে কারণে আমরা পাচ্ছি না। এটি পুরোপুরি সমন্বয়হীনতা।”
তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নানও রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমরা সাঈদীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে আশা করেছিলাম । কিন্ত তা হয়নি। উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, সেটার ওপর বলার কিছু নাই।”
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাউন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক হাসান সবমিলিয়ে সরকারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, “প্রয়োজনীয় দলিলাদি উপস্থাপনে দুর্বলতা, সাক্ষী সুরক্ষা না হওয়া ও আঁতাতের গুজবে মানুষের মধ্যে এক ধরনের পারসেপশান তৈরি হয়েছে। যেটা কখনও ভালো নয়।”