আসামিপক্ষের দাবি, সব অভিযোগ ‘ভুয়া’। অন্যদিকে সিমিন ও তার ছেলেকে কারাগারে পাঠানোর দাবি করেন বাদীপক্ষের আইনজীবী।
Published : 03 Apr 2024, 11:46 PM
ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত লতিফুর রহমানের মেয়ে শাযরেহ হকের করা চারটি মামলায় গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহনাজ রহমান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান ও হেড অব ট্রান্সফরমেশন যারেফ আয়াত হোসেন আত্মসমর্পণের পর আদালতে দুই পক্ষে পাল্টাপাল্টি নানা বক্তব্য উঠে এসেছে।
আসামির আইনজীবী চারটি মামলাতেই ‘ভুয়া’ দাবি করে প্রশ্ন তোলেন, এত দিন পরে কেন এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তার দাবি, লতিফুর রহমান মৃত্যুর আগেই সব বিলি বণ্টন করে দিয়ে যান।
ভাই হত্যার অভিযোগকেও অসার দাবি করে আইনজীবী বলেন, ‘হত্যার কোনো লক্ষণই ছিল না।’ ফলে এসব মামলায় আসামিরা জামিন পেতে পারেন।
অন্যদিকে বাদীর আইনজীবী জামিনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, এ আদালত হত্যা মামলায় জামিন দিতে পারে না।
বুধবার দুই পক্ষের এই শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম মাহবুব আহমেদ ৫ হাজার টাকা মুচলেকায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা পর্যন্ত জামিন দেন তিন জনকে। পরে বাদীর আইনজীবী এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
ট্রান্সকম গ্রুপের উত্তরাধিকারদের মধ্যে এই মামলা নিয়ে এরই মধ্যে তুমুল আলোচনা তৈরি করেছে।
লতিফুর রহমান করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ২০২০ সালের ১ জুলাই মারা যান। এরপর তার রেখে যাওয়া ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান হন স্ত্রী শাহনাজ রহমান। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হন বড় মেয়ে সিমিন রহমান। তার ছেলে যারেফ আয়াত হোসেন পেয়েছেন হেড অব ট্রান্সফরমেশন পদ।
লতিফুরের ছেলে আরশাদ ওয়ালিউর রহমান ও মেয়ে শাযরেহ হক গ্রুপের পরিচালক পদে ছিলেন আগে থেকেই।
২০২৩ সালের ১৬ জুন ঢাকার গুলশানের বাসায় নিজের শোয়ার ঘরে মারা যান আরশাদ ওয়ালিউর। তিনি নিঃসন্তান এবং তার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল।
পরিবারটির মধ্যে সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে বিভেদ সামনে আসে গত ২২ ফেব্রুয়ারি। সেদিন শাযরেহ তার মা, বোন ভাগ্নেসহ আটজনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, সম্পত্তি দখল ও অবৈধভাবে শেয়ার হস্তান্তরের অভিযোগ আনেন।
জাল জালিয়াতি করে শেয়ার হস্তান্তর দলিল করার অভিযোগ এনে তিনি বলেন, এমন কোনো দলিলে তিনি সই করেননি। অথচ তার ও তার ভাইয়ের নামে যে শেয়ার দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় দ্বিগুণ শেয়ার আছে সিমিনের নামে।
এরপর ২২ মার্চ শাযরেহ আরেকটি মামলা করেন। এখানে তিনি তার ভাইকে হত্যার অভিযোগ আনেন। এতে আসামি করা হয় বোন সিমিন রহমান ভাগ্নে যারেফ আয়াত হোসেনসহ ১১ জনকে। মাকে এই মামলায় আসামি করেননি শাযরেহ।
মামলা দুটি করার সময় শাহনাজ, সিমিন ও যারেফ বিদেশে ছিলেন। তাদের পক্ষে উচ্চ আদালতে একটি আবেদনের পর গত ৩১ মার্চ হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ তাদেরকে দেশে ফেরার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়।
বুধবার দুপুরের আগে তারা ঢাকার বিচারিক আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। বেলা আড়াইটা থেকে বিকাল পৌনে ৪ টা পর্যন্ত শুনানি নেন বিচারক মাহবুব আহমেদ।
শুনানির বেশিরভাগ সময়েই আইনজীবীদের দিকে না তাকিয়ে বিচারক নথিকে নোট নিতে থাকেন।
তিন মামলার আসামি ট্রান্সকম গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান শাহনাজ রহমান আইনজীবীদের আসনে বসে দুই পক্ষের বক্তব্য শুনছিলেন।
অন্য দুই আসামি সিমিন ও যারেফ দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে শুনানি শোনেন।
সিমিনদের আইনজীবী যা যা বললেন
তাদের পক্ষে আদালতে কথা বলেন আইনজীবী শাহীনুর ইসলাম অনি। তিনি বলেন, “এটা একটা ফ্যামিলি ম্যাটার। মেয়ে হয়ে তার নিজ গর্ভধারিণী মা-বোনের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক।”
মামলা দেরিতে কেন- এই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “জানুয়ারি মাসেই অনিয়মের বিষয়, জালিয়াতির বিষয়ে জেনেছেন। তাহলে এতদিন কেন চুপ থাকলেন?”
শাযরেহের পক্ষে আইনি নোটিশের উত্তর দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তার আনা অভিযোগ খণ্ডন করে আইনজীবী বলেন, “ডিড অব সেটেলমেন্ট অনুযায়ী সব কিছু হয়েছে। কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। লতিফুর রহমান সাহেব নিজেই শেয়ার ট্রান্সফার করেছিলেন।
“লতিফুর রহমান মারা গেলেন ২০২০ সনের ১২ জুলাই। তিনি জীবিত থাকতেই সম্পত্তি বিলি বণ্টন করে গিয়েছিলেন। কোনো অনিয়ম ছিল না। সে সময় শেয়ারগুলো বিধিসম্মতভাবে ট্রান্সফার করা হয়।”
শাযরেহকে জানানো হয়েছে, তার বাবা তাকে ও তার ভাইকে কোম্পানির ৪ হাজার ২৭০টি করে এবং বড় বোন সিমিনকে ১৪ হাজার ১৬০টি শেয়ার হস্তান্তর করেছেন।
লতিফুরের ছোট মেয়ের দাবি, তিনি বাবার মৃত্যুর পরেও হস্তান্তর দলিলে সই করেননি, বাবা জীবিত থাকা অবস্থায়ও করেননি। তার অভিযোগ, আসামিরা এসব নথি জাল করেছেন।
সিমিনদের পক্ষে আইনজীবী বলেন, “প্রকৃতপক্ষে এগুলো ভুয়া দাবি।”
অভিযোগ দেরিতে তোলার প্রসঙ্গটি আবার সামনে এনে তিনি বলেন, “জাল স্বাক্ষরের প্রশ্ন কেন আগে তোলা হয়নি? আসলে কোনো প্রকার জাল স্বাক্ষরের ঘটনা ঘটেনি।”
শাযরেহ তার ভাইকে হত্যার অভিযোগও অনেক দেরিতে করার প্রসঙ্গ টানেন আইনজীবী শাহীনুর বলেন, “ঘটনাটি ঘটল গত বছরের ১৬ জুনে। আর মামলা করা হল গত ২২মার্চে । এতটা বিলম্বের কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা বাদী দিতে পারেননি।
“তাছাড়া পয়জন অথবা শ্বাসরোধ করা হলে চিকিৎসা প্রতিবেদনে শ্বাস রোধের চিহ্ন থাকত। রাসায়নিক পরীক্ষায় বিষ প্রয়োগের উপাদান পাওয়া যেত।“
বাদীর অভিযোগ ছিল, তার ভাইয়ের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সংবাদ সেখানে উপস্থিত কেউ তাকে জানাননি। তাছাড়া তার ভাইয়ের কোনো জটিল রোগও ছিল না। এ ঘটনার ৩/৪ দিন আগে থেকে তার ভাইয়ের সঙ্গে তিনি কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে সনদে লেখা ‘অজানা’।
কারাগারে পাঠাতে জোরাল বক্তব্য শাযরেহের আইনজীবীর
আসামিপক্ষে বক্তব্য শেষ হলে আদালতে দাঁড়ান বাদীপক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল।
শেয়ারের মালিকানার নথিপত্র নিয়ে তিনি বলেন, “ডিড অব এগ্রিমেন্টই জাল।”
এরপর ঘটনা কীভাবে ঘটল, মামলা করতে কেন দেরি হল, এসব তুলে ধরতে শুরু করেন।
বাদীর করা হত্যা মামলায় আসামিদেরকে কারাগারে পাঠানোর দাবি জানাতে থাকেন কাজল। তিনি বলেন, “হত্যা মামলার জামিনের কিছু নিয়ম শর্ত আইনে বেঁধে দেওয়া রয়েছে। এ আদালত সেশনস আদালত নয়। এ আদালত হত্যা মামলায় জামিন দিতে পারেন না। আসামিদের কাস্টডিতে পাঠানো হোক। কাস্টডিতে নিলেই সত্য বেরিয়ে আসবে।”
বিচারকের জামিনের আদেশ আসার পর বাইরে বেরিয়ে এসে বাদীর আইনজীবী সাংবাদিকদের বলেন, “ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের ছেলেকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে এবং ডিড অফ সেটেলমেন্ট কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করে পেপারস তৈরি করা হয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আসামিরা জামিন পেলেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।”
শুনানিতে কাজলের সঙ্গে ছিলেন গাজী শাহ আলম।
আসামি পক্ষে শাহীনুর ইসলামের সঙ্গে ছিলেন, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আব্দুর রহমান হাওলাদারসহ আরো কয়েকজন।
আত্মসমর্পণ করে ট্রান্সকমের চেয়ারম্যান-সিইওর জামিন
ট্রান্সকমের সিমিনের বিরুদ্ধে ভাই হত্যার অভিযোগে বোন শাযরেহের মামলা