ডিমে কতটুকু এগোলো বাংলাদেশ?

বছরে এখন মাথাপিছু ডিম খাওয়ার পরিমাণ ১৩৬টি। সরকার ২০৩০ সালে বছরে ১৬৫টি ডিম খাওয়াতে চায়।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Oct 2022, 03:35 AM
Updated : 14 Oct 2022, 03:35 AM

দেশে প্রাণীজ আমিষের সহজলভ্য উৎস ডিমের উৎপাদন গত এক দশকে বেড়ে তিনগুন হয়েছে, কিন্তু মাঝেমধ্যেই কারণে-অকারণে দাম বেড়ে যাওয়ায় সবার জন্য তা আর সহজলভ্য থাকছে না।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ডিম উৎপাদন হয়েছে মোট ২ হাজার ৩৩৫ কোটি; সে হিসাবে বছরে প্রত্যেকের জন্য ডিমের প্রাপ্যতা ছিল ১৩৬টি।

আর তার আগের অর্থবছরে দেশে ডিম উৎপাদন হয় মোট ২ হাজার ৫৭ কোটি, তাতে জনপ্রতি নাগরিকের ডিমের প্রাপ্যতা দাঁড়ায় ১২১টি।

ডিমের প্রাপ্যতা যে বেড়েছে, তা এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। কিন্তু কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাব বলছে, এক হালি ডিমের দাম গতবছরের ৩৫ টাকা থেকে এ বছর ৫০ টাকার কাছাকাছি উঠে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে তা ‘আমিষের সাশ্রয়ী উৎসের’ পরিচয় ধরে রাখতে পারেনি।

দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ বাস্তবায়নে জনপ্রতি বছরে ১৬৫টি ডিম সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। আর সরকারের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০২১-৪১) ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে বছরে জনপ্রতি ২০৮টি ডিম সরবরাহের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

সেই লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ডিমের বার্ষিক উৎপাদন নিয়ে যেতে হবে ৩২৯৩ দশমিক ৪ কোটিতে; আর ২০৪১ সাল নাগাদ তা হতে হবে ৪৬৪৮ দশমিক ৮ কোটি।

বিসিএস লাইভস্টক অ্যাকাডেমির পরিচালক ডা. পীযূষ কান্তি ঘোষের মতে, বাংলাদেশ ডিমের চাহিদার লক্ষ্য পূরণের ‘খুব কাছাকাছিই’ আছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মুরগির খাবারের দাম কমলে ডিম উৎপাদন আরও বেশি হত।”

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদা রশিদ বলছেন, ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তাদের হাতে নেই। সেজন্য সরকারের আরও শাখা আছে।

“তবুও উৎপাদনের জায়গাটির সাথে যেহেতু আমাদের সম্পর্ক আছে, আমাদের কাছেও যেহেতু প্রশ্ন আসে, সেহেতু আমরা এ ব্যাপারে নজর দিচ্ছি। খামারিদের কাছ থেকে ডিম উৎপাদনের খরচ জানতে চাইছি। তারা যেন রশিদ দিয়ে ব্যবসা করেন সেদিকেও নজর দিচ্ছি।"

 সচিব বলেন, “প্রতি বছরে মাথাপিছু ডিমের যে প্রাপ্যতা, সেটি আমরা এরই মাঝে অর্জন করেছি। ডিম উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের যে ডিম উৎপাদিত হয়, তাতে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না।” 

ডিম কেন গুরুত্বপূর্ণ

পুষ্টি চাহিদা পূরণে সব শ্রেণির মানুষের খাদ্যাভাসের নিয়মিত উপকরণ ডিম। প্রতি বছরের মত এবারও ১৪ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডিম দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্রতিদিন একটি ডিম, পুষ্টিময় সারাদিন’।

বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল, ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি সায়েন্সেস অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার যৌথ উদ্যোগে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন মানুষের সপ্তাহে কমপক্ষে তিনটি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক কাজী মো. রেজাউল করিম বলেন, “সব বয়সের মানুষের ডিম খাওয়া উচিত। এত সহজে এর চেয়ে ভালো প্রোটিন আর হয় না।”

পুষ্টি উপাদানে ঠাসা ডিম স্বাস্থ্যকর খাবারগুলোর মধ্যে একটি। মাঝারি আকারের ডিমে প্রায় ৬ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যকর মাত্রায় চর্বি আছে। ভিটামিন ডি’র চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণ করতে পারে একটি ডিম। খনিজ উপাদানসহ ভিটামিন বি সিক্স ও বি টুয়েলভ ভিটামিনও প্রচুর পরিমাণে থাকে ডিমে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে জরুরি।

ডিমকে বলা হয় ‘ন্যাচারাল ভিটামিন পিল’। দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে এর করোটিনয়েড, ল্যুটেন চোখের ছানি কমায়। ডিমের ভিটামিন ই বন্ধ্যাত্ব রোধ ও স্কিন ক্যানসার প্রতিরোধেও ভূমিকা পালন করে। রক্তে কোলেস্টরল জমতে বাধা দেয়, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে, রক্তে লোহিত কণিকা তৈরি করে। কিডনি ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ঠিক রাখতেও এর ভূমিকা আছে।

ডিমের ওমেগা-৩ রক্তের প্লাজমায় ট্রাইগ্লিসারিডের পরিমাণ কমায়, যার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে, চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি, মাংসের ক্ষয়রোধ ও ব্রেস্ট ক্যান্সার রোধেও কাজ করে। ডিমে থাকা ২০০ ধরনের এন্টিবডি মানব দেহে সালমোনেলা আক্রমণ রোধ করে। এর মধ্যে যে এলবুমিন আছে তা মিউকাস মেমব্রেনকে রক্ষণাবেক্ষণ করে ফলে, পাকস্থলীর প্রদাহ, আলসার, ডায়রিয়া প্রতিরোধ হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “ডিম হচ্ছে দারুণ একটি খাবার। ছোট এবং সহজলভ্য এই জিনিসের মধ্যে অনেক প্রোটিন থাকে। এর অন্যান্য পুষ্টি উপাদান দেহ গঠনে অনেক দৃঢ় ভূমিকা রাখে। তাই সবারই দিনে একটি করে ডিম খাওয়া উচিত।”

দামের কাঁটা

মহামারী ও ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে উচ্চমূল্যের বাজারে মাছ-মাংসের নাগাল পেতে হিমশিম খাওয়া মানুষের ডিমই যেন ভরসা। কিন্তু বাজারে ডিমের দামও চড়ে আছে, ফলে সাধারণ মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা।

ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ বলেন, “মেস বা বাসায় ব্যাচেলরের নিয়মিত খাবার উপাদান ডিম। দাম বাড়লেও ডিমের বিকল্প চিন্তা করা যায় না।”

পুষ্টি চাহিদা ও খাদ্যাভাসের প্রয়োজনে সপ্তাহে অন্তত এক ডজন ডিম লাগে উত্তরার গৃহবধূ ফারহানার মিশুর সংসারে।

তার ভাষায়, ডিম ছাড়া তার সংসার ‘অচল’, পুষ্টির কথা ভেবেও পাতে ডিম রাখতে হয়। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় তাকেও খানিকটা লাগাম টানতে হয়েছে।

হাঁস বা কোয়েলের ডিমের পাশাপাশি পোল্ট্রি মুরগির সাদা আর লাল ডিমই বেশি পাওয়া যায় বাজারে। গত অগাস্ট মাসে পোল্ট্রি মুরগীর ডিমের দাম চড়তে চড়তে প্রতি ডজন ১৬০ টাকায় উঠে গিয়েছিল, এরপর নানা উদ্যোগে ১২০ টাকায় নেমে আসে দাম। এখন আবার তা বেড়ে দেড়শ ছুঁয়েছে।

ডিমের বাজারে এমন অস্থিরতা নতুন নয়। তখনও বার্ড ফ্লু, কখনও অতি বৃষ্টি, আবার কখনও কারসাজি ডিমের দাম সাধারণের হাতের নাগাল থেকে উঁচুতে নিয়ে গেছে।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাব বলছে, এক যুগ আগে ২০১০ সালে প্রতি হালি লাল-সাদা ডিমের দাম ছিল গড়ে ২৫ টাকা ৩৩ পয়সা। পরের বছর তা সামান্য কমে ২৪ টাকা ৮৩ পয়সা হয়। সেই দাম বাড়তে বাড়তে ২০১৯ সালে গড়ে ৩৫ টাকা হালি ছাড়িয়ে যায়। মহামারীর মধ্যে সাময়িক সঙ্কটের মধ্যে তা ৬০ টাকার কাছাকাছিও পৌঁছে গিয়েছিল। 

খামারি থেকে ডিম কেনে এক শ্রেণির সরবরাহকারী বা এজেন্ট, তাদের কাছ থেকে কেনে আড়তদাররা, তাদের কাছ থেকে ডিম যায় পাইকারি দোকানে, সেখান থেকে যায় খুচরা দোকানে; এভাবে চার হাত ঘুরে ডিমের দাম চড়ে।

প্রচলিত মুরগির ডিম ছাড়াও অর্গানিক, ওমেগা থ্রি ও ব্রাউন নামে প্রক্রিয়াজাত ডিম পাওয়া যায়, যেগুলো বিক্রি হয় আরও বেশি দামে।

এসব ডিম উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করে ডিমের পুষ্টিমান নির্ধারণ ও উৎপাদন খরচ অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করছে বলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের এক শুনানিতে উঠে এসেছে।

একটি ই-কমার্স সাইটে বৃহস্পতিবার প্রতি ডজন ব্রাউন ডিম ১৮৫ টাকা এবং প্রতি ডজন ওমেগা থ্রি প্লাস ২৫৫ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা যায়।  

কিন্তু মান?

ডিমের দাম হাতের নাগালে রাখার জন্য সরবরাহ আরও বাড়াতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (উৎপাদনের দপ্তর) মো. মজিবর রহমান বলছেন, চাহিদা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে ডিমের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। ছোট খামারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, বড় খামারিদের কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদা রশিদও প্রায় একই সুরে বললেন, “আমাদের কার্যক্রমের সাথে খামারিরা সবসময় যুক্ত আছেন। আমরা যা অর্জন করেছি তা ধরে রাখতে আমাদের কাজ অব্যাহত থাকবে। সেই সাথে মান ধরে রাখার ব্যাপারটিও আমাদের মাথায় আছে।"

ডিমের মান নিয়ে কথা বলতেই আকারের প্রসঙ্গ টানলেন ঢাকায় কর্মরত ব্যাংক কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস।

তিনি বলেন, “ডিমের আকার দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। অনেকসময় ডিম ভাঙলে কুসুম থেকে প্লাস্টিকের গন্ধ আসে। ভাজি করলে রাবারের মতো লাগে। আমরা তো কৃত্রিম ডিমের কথাও শুনি প্রায়সময়।”

খামারিরা বলছেন, বয়সে ছোট এবং শুরুর দিকে মুরগীর ডিমের আকার ছোট হয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিমের আকার কেমন হবে তার মুরগির জাতের ওপর নির্ভর করে।

পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, “হাঁস-মুরগির খাবারের ওপর ডিমের মান নির্ভর করে। যারা ডিমের খাবার বানায় তাদেরকে নিরাপদ খাবারের ব্যাপারে নজর দিতে হবে, যাতে ডিমের মান ভাল ও নিরাপদ থাকে।”

অন্যদিকে সাভারের বিসিএস লাইভস্টক একাডেমির পরিচালক পীযূষ কান্তি বলেন, “প্লাস্টিকের ডিম বা ট্যানারির খাবার খাইয়ে ডিম উৎপাদন– এগুলো মুখরোচক গল্প। এগুলোর ভিত্তি নেই।”

ডিমের আকার ও মানের বিষয়ে তার উত্তর, “ডিমের আকার কেমন হবে, তা মুরগির জাতের ওপর নির্ভর করবে। এতে ডিমের গুণাগুণে প্রভাব পড়ে না।

“প্রাকৃতিকভাবে আমরা যেটা পাব, সেটাই গ্রহণ করা উচিত। এখানে পরিবর্তন করতে গেলে ভিন্ন প্রভাব পড়তে পারে।”

পুরনো খবর