মেলায় নতুন আসা বইয়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।
Published : 12 Feb 2024, 10:42 PM
এক সময় বইমেলায় আলাদা করেই নজর কাড়ত লিটলম্যাগ চত্বর। বছরের পর বছর নবীন-প্রবীণ লেখকের যোগসূত্র তৈরি হত এ চত্বরকে ঘিরেই। মেলায় এলেই সেখানে ঢু মারতেন সবাই, আড্ডায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত কথায়, তর্ক আর বির্তকে। খ্যাতনামা সাহিত্যকদের আড্ডায় মুখর থাকা লিটলম্যাগ চত্বরের সেই দিন এখন আর নেই। আড্ডাবিহীন লিটলম্যাগ চত্বর এখন ধুঁকছে নানা সংকটেও।
লিটলম্যাগের কর্মীদের অভিযোগ, মেলার আয়োজকদের দিক থেকে চরমভাবে অবহেলা করার কারণেই দিনে দিনে নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে লিটলম্যাগ চত্বর। এখানে সৃজনশীল বা মননশীল ছোটকাগজের নামে যাকে-তাকে দেওয়া হচ্ছে স্টল বরাদ্দ। স্টল বিন্যাস নিয়েও অসন্তোষ অনেকের।
কবি শাহেদ কায়েস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এই চত্বরে এবার যেভাবে স্টল বিন্যাস করা হয়েছে তা দেখতেও নান্দনিক হয়নি। এই চত্বর যে মেলার আয়োজকদের কাছে অবহেলার শিকার, তা স্টল বিন্যাস দেখলেই বোঝা যাবে।"
টিএসসি গেইট দিয়ে মেলায় ঢুকলেই ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ এবং লিটলম্যাগ চত্বর রয়েছে পাশাপাশি। তবে দুটি চত্বর যেন পরস্পরবিচ্ছিন্ন।
থিয়েটার বিষয়ক ছোটকাগজ ক্ষ্যাপার নির্বাহী সম্পাদক অপু মেহেদী বলেন, "লিটলম্যাগ চত্বর এবং লেখক বলছি মঞ্চ একসঙ্গে করে তার চারদিকে স্টল রাখা যেত। মাঝখানের গাছের নিচে বসে আড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা যেত। কিন্তু এখন এমনভাবে করা হয়েছে, লেখক বলছি মঞ্চটি আলাদা এবং লিটলম্যাগ চত্বরটিও আলাদা। দেখতে খুবই অসুন্দর লাগে।"
তার ভাষ্য, "লিটলম্যাগের নামে এখানে যে কেউ স্টল না নিতে পারে, তার জন্য নিয়ম মানা উচিত। অনেকে স্টল নিয়ে 'বাজারি বই' বিক্রি করছে।"
লিটলম্যাগ চত্বরকে 'গরুর হাট' বানানো হয়েছে বলেও অভিযোগ ছোটকাগজ 'দ্রষ্টব্য' এর শিল্প সম্পাদক ও প্রচ্ছদশিল্পী চারুপিণ্টুর।
তিনি বলেন, "লম্বা সারি করে কিছু স্টল করা হয়েছে। কয়েকটি স্টলের সামনে গাছের কারণে হাঁটার জায়গাও নেই। সেদিকেও খেয়াল নেই মেলার আয়োজকদের। স্টলগুলোকে দেখলে মনে হয় 'গাবতলীর গরুর হাট'।
“প্রতিবারই লিটলম্যাগ চত্বরকে এভাবে অবহেলা কেন করা হয়? এমন অবহেলা তো কাম্য নয়।"
মেলায় আসছেন, বই হাতে ছবি তুলছেন, চলেও যাচ্ছেন
মেলায় কত নতুন বই? সঠিক তথ্য নেই কমিটির কাছে
শিশুসাহিত্যের ছোটকাগজ 'দোলন' এর সম্পাদক কামাল মোস্তফা বলেন, "বইমেলার এই চত্বর যেন আড্ডায় মুখর থাকে, তার জন্য চত্বরটিকে আরও নান্দনিক এবং আড্ডাবান্ধব করতে হবে। এখানে যেন লেখক-পাঠকের আড্ডায় মুখর হয়।"
লিটলম্যাগ চত্বরের স্টল বিন্যাস নিয়ে অসন্তোষের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বইমেলা পরিচালনা কমিটির লিটলম্যাগ ব্যবস্থাপনা উপকমিটির আহ্ববায়ক একেএম কুতুবউদ্দিন বলেন, "গতবার অন্য একটি জায়গায় ছিল লিটলম্যাগ চত্বর। এবার লিটলম্যাগকর্মীদের চাওয়ার কারণেই মুক্তমঞ্চের পাশের জায়গাটিতে আনা হয়েছে। এখানে চারদিকে স্টল করা হলে তো পেছনের দিকটা বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য এভাবে করা হয়েছে।
“আর গাছের কারণে যে স্টলগুলো আড়ালে পড়েছে, সেগুলো অন্য জায়গায় দেওয়া হয়েছে। এবার যে ত্রুটিগুলো রয়েছে, তা নিয়ে আমরা চিন্তা করব-যেন ভবিষ্যতে আরও সুন্দর করা যায়।"
বইমেলায় প্রতিদিনই লেখক-সাহিত্যিকদের অনেকে আসছেন। তবে তাদেরকেও এখন আর লিটলম্যাগ চত্বরে খুব একটা দেখা যায় না। মেলায় আসা লেখকদের প্রায় সবাই এখন ব্যস্ত নিজের বই নিয়ে। মূলত যে প্রকাশনী থেকে লেখকের বই প্রকাশ হয়, তার সামনেই তিনি আড্ডা দেন। এতে তার বই বেশি বিক্রি হয় বলে মনে করছেন প্রকাশকরা।
কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীম গত শুক্রবার এসেছিলেন মেলায়। লেখক-সাহিত্যিকদের বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি নজরে এসেছে তারও।
সেদিন এ প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, "পরিধি বাড়লেও এখন বইমেলা যেন সংকুচিত হয়ে গেছে। আগে মেলা প্রাঙ্গণে লেখকদের খুঁজে পাওয়া যেত। তারা একে অপরকে খুঁজে আড্ডা জমাতেন। কিন্তু এখন লেখকরা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন, আমরা যেন একেক প্রকাশনীর একেকজন লেখক।"
লিটলম্যাগ চত্বর ঘুরে দেখা যায়- দ্রষ্টব্য, সরলরেখা, থিয়েটার বিষয়ক ছোটকাগজ ক্ষ্যাপা, নান্দিক, দোলন, গ্রাম থিয়েটার, ’ভ্রমণগদ্য’, গারো নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি নিয়ে ‘থকবিরিম’ এর মতো ছোটকাগজের বিভিন্ন স্টল রয়েছে মেলায়।
এর মধ্যে কারও কারও নিজেদের প্রকাশিত বই রয়েছে। আবার কয়েকটি স্টলে নীতিমালা লঙ্ঘন করে বিভিন্ন শিশুতোষ বইও বিক্রি করা হচ্ছে।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির লিটলম্যাগ ব্যবস্থাপনা উপকমিটির আহবায়ক একেএম কুতুবউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "লিটলম্যাগ চত্বরে লিটলম্যাগ ছাড়া অন্য বই বিক্রি করার নিয়ম নেই।"
তবে ওই লিটলম্যাগ সম্পাদক বা তাদের বন্ধুদের বই হলে সেটি ছাড় দেওয়া হয় জানিয়ে কুতুবউদ্দিন বলেন, "কয়েকটি স্টলে বাংলাবাজার থেকে শিশুদের বই কিনে এনে কেউ কেউ এখানে বিক্রি করছেন। তাদের মৌখিকভাবে সতর্ক করেছি।
"আমরা প্রতিদিনই লিটলম্যাগ চত্বর পরিদর্শন করি। কোনো ত্রুটি পেলে তাদের সতর্ক করা হয়। কয়েকটা স্টলে বিভিন্ন প্রকাশনীর বই বিক্রি করতে দেখেছি। তাদেরকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। তারা যদি সংশোধন না হোন, তবে লিখিতভাবে শোকজ করে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
হাজার ছাড়িয়েছে নতুন বই
সোমবার ছিল একুশে বইমেলার দ্বাদশ দিন। মেলা শুরু হয় বিকেল ৩টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, এদিন মেলার তথ্যকেন্দ্রে নতুন বই জমা পড়েছে ১১৫টি। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০টি নতুন বই জমা পড়েছে তথ্যকেন্দ্রে।
ছুটির দিনের বইমেলায় ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই
প্রকাশকদের কাছ থেকে যারা নতুন বই একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা দিয়েছেন, সেই সংখ্যা অনুযায়ী সোমবার মেলায় নতুন বইয়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানান মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মজাহিদুল ইসলাম।
সোমবার 'লেখক বলছি' মঞ্চের অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক সালমা বাণী, কবি ফারহানা রহমান, গবেষক মিলটন কুমার দেব এবং কথাসাহিত্যিক ইকবাল খন্দকার।
মূল মঞ্চ
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: হেনা দাস শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জোবাইদা নাসরীন। আলোচনায় অংশ নেন ঝর্না রহমান ও ফওজিয়া মোসলেম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি আলতাফ হোসেন, সাজ্জাদ আরেফিন, ওমর কায়সার, ইউসুফ রেজা, আসাদ কাজল, শাহেদ কায়েস ও সারমিন মতিন মিতু।
আবৃত্তি পরিবেশন করেন কাজী মদিনা, পলি পারভীন, জালালউদ্দীন হীরা। এছাড়া ছিল নাজিয়া জাবীনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্পর্শ ফাউন্ডেশন’, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘কথা আবৃত্তি চর্চাকেন্দ্র’ ও মোঃ সজীব মিয়ার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘হাওলা’র পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া, সাইদুর রহমান বয়াতি, জহির আলীম, আবুল বাসার আব্বাসী ও বশির উদ্দিন সরকার। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন গৌতম কুমার সরকার (তবলা), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কী-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি), খোকন বাউলা (দোতারা) ও মেহেদী হাসান রনি (বাংলা ঢোল)।
মঙ্গলবার যা থাকবে
যথারীতি এদিন মেলা শুরু হবে বিকাল ৩টায়। বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণ: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। আলোচনায় অংশ নেওয়ার কথা হরিশংকর জলদাস ও ফারজানা সিদ্দিকার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।