সাতটি প্রবেশদ্বারের হিসাব অনুযায়ী শুক্রবার মেলায় এসেছিলেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫১৩জন।
Published : 09 Feb 2024, 10:32 PM
ছুটির দিনে বইমেলায় ভিড় হবে, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। তবে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি লোকের সমাগম হয়েছে শুক্রবারের মেলায়, ঘটেছে অনাকাঙ্ক্ষিত বিশৃঙ্খলাও।
এদিন সকাল থেকে মেলায় ছিল শিশুদের ভিড়। আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই মেলা রূপ নেয় জনসমুদ্রে। সে সময় মেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়াও কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। বাড়তি ভোগান্তির কারণ হয়েছে মেলার মাঠের ধুলা।
শুক্রবার ছিল বইমেলার নবম দিন, মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এর মধ্যে দুপুর ১টা পর্যন্ত ছিল শিশুপ্রহর। সে কারণে সকাল থেকেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শিশুদের পদচারণা শুরু হয়।
সকাল সাড়ে ৮টায় হয় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা; সকাল ১০টায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন হয়।
এক হাজারের বেশি শিশু বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। প্রতিযোগিতার পর তাদের অভিভাবকেরাও মেলায় প্রবেশ করে মাতিয়ে তোলেন বইমেলা।
দুপুরে দর্শনার্থীদের চাপ কম থাকলেও বিকাল থেকে বাড়তে থাকে লোক সমাগম। সন্ধ্যার পর দেখা যায়, মেলা প্রাঙ্গণে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, সাতটি প্রবেশদ্বারের হিসাব অনুযায়ী শুক্রবার মেলায় এসেছিলেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫১৩জন।
উপচেপড়া এই ভিড়ে বই কেনার চেয়ে ঘুরে বেড়ানো আর আনন্দ আড্ডায় মেতে থাকতেই দেখা যায় দর্শনার্থীদের। অন্য দিনের তুলনায় মেলায় বই বিক্রি বাড়লেও তা লোক সমাগমের তুলনায় খুব বেশি নয় বলে পেন্ডুলাম পাবলিশার্সের স্বত্ত্বাধিকারী রুম্মান তার্শফিকের ভাষ্য।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "যত লোক মেলায় এসেছেন, তাদের বেশিরভাগই বই কেনেননি। অনেকে এসে স্টলের সামনে বই হাতে নিয়ে ছবি তুলেছেন। তবে এই লোক সমাগমের আনন্দটাও আমরা উপভোগ করছি। আশা করি বাকি দিনগুলোয় লোক সমাগম হবে এবং বই বিক্রিও বাড়বে।"
লেখকদের অনেকে এদিন মেলায় এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক আনু মুহম্মদ, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, ইমতিয়ার শামীম, আনিসুল হক।
ইমদাদুল হক মিলনের গল্প সংকলন 'অন্ধকার নামতে পারেনি' এবং আটটি কিশোরগল্প 'চোর এসে গল্প করেছিল' প্রকাশ করেছে অনন্যা।
মিলন বলেন, “এবার মেলায় যে সংখ্যায় মানুষের সমাগম হচ্ছে, সেই তুলনায় হাতে হাতে বই দেখা যায়নি। যারা বইমেলায় আসেন, সবাই যদি একটা করে হলেও বই কিনতেন, তবে অন্যরকম হত।”
ইমতিয়ার শামীম বলেন, “বইমেলার পরিধি এখন বড় হয়েছে, তবে লেখকদের আড্ডা এখন সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। এখন মেলায় আর প্রাণখুলে আড্ডা হয় না। লেখকরা সবাই প্রকাশনাকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন। সবাই যেন একেক প্রকাশনীর একেক জন লেখক।
লিটলম্যাগ চত্বরে সতর্কবার্তা
মেলার লিটলম্যাগ চত্বরে এদিন দুটি স্টলকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। বিকেলে বইমেলা পরিচালনা কমিটির লিটলম্যাগ ব্যবস্থাপনা উপকমিটির আহ্বায়ক একেএম কুতুবউদ্দিন বিভিন্ন স্টল পরিদর্শন করেন।
পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা প্রতিদিনই লিটলম্যাগ চত্বর পরিদর্শন করি। কোনো ত্রুটি পেলে তাদের সতর্ক করা হয়। আজকে এসে কয়েকটা স্টলে বিভিন্ন প্রকাশনীর বই বিক্রি করতে দেখেছি। তাদেরকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। তারা যদি সংশোধন না হোন, তবে লিখিতভাবে শোকজ করে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
লিটলম্যাগ চত্বরে লিটলম্যাগ ছাড়া অন্য বই বিক্রি করার নিয়ম নেই। তবে ওই লিটলম্যাগ সম্পাদক বা তাদের বন্ধুদের বই হলে সেটি ছাড় দেওয়া হয় জানিয়ে কুতুবউদ্দিন বলেন, "কয়েকটি স্টলে বাংলাবাজার থেকে শিশুদের বই কিনে এনে কেউ কেউ এখানে বিক্রি করছেন। তাদের মৌখিকভাবে সতর্ক করেছি।"
মুশতাক দম্পতিকে বের করা হল মেলা থেকে
মেলায় এদিন মিজান পাবলিশার্সের স্টলে খন্দকার মুশতাক আহমেদ ও তিশা দম্পতিকে ঘিরে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। পরে তাদের ‘সম্মানের সাথে’ মেলা থেকে বের করে দেওয়ার কথা বলা হয় মেলা পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে।
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ কিছুদিন আগে একই কলেজের শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলাম তিশাকে বিয়ে করে আলোচনায় আসেন।
এবারের মেলায় মিজান পাবলিশার্স থেকে 'তিশার ভালোবাসা' নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বইটির প্রচারের জন্য শুক্রবার বিকেলে মেলায় আসেন মুশতাক ও তিশা।
তাদের বসে থাকতে দেখে ভিড় বাড়তে থাকে স্টলের সামনে এবং 'ভুয়া ভুয়া, ছি ছি'সহ নানা রকম স্লোগান দিতে থাকেন দর্শনার্থীদের একাংশ।
তাতে বইমেলার ‘পরিবেশ নষ্ট হওয়ার’ অভিযোগ উঠলে মেলা থেকে মুশতাক দম্পতিকে চলে যাওয়ার জন্য বলে মেলা কমিটি।
পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "মুশতাক দম্পতিকে মিজান পাবলিশার্সের স্টলে দেখে কিছু দর্শনার্থী উত্তেজিত হয়ে নানা রকম স্লোগান দিতে থাকে। আমরা মুশতাক দম্পতিকে বলি, তারা সসম্মানে মেলা থেকে চলে যাবেন কিনা, না হলে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, তার দায় তাদেরকে নিতে হবে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় তার মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন।"
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা
অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে সকাল সাড়ে ৮টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে হয় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এতে ক-শাখায় ৩৯৫, খ-শাখায় ২৩৫ এবং গ-শাখায় ৬৫ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন অধ্যাপক নিসার হোসেন।
সকাল সাড়ে ৯টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই পর্ব হয়। এতে ক-শাখায় ১২৩, খ-শাখায় ১৩৮ এবং গ-শাখায় ৫১ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন বাচিকশিল্পী আনজুমান আরা, মো. গোলাম সারোয়ার ও রফিকুল ইসলাম।
বইমেলার জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, এদিন তাদের তথ্যকেন্দ্রে নতুন বই জমা পড়েছে ১৭১টি। এতে মেলায় মোট নতুন বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ালো ৬৬৯টি।
লেখক বলছি মঞ্চের অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন শিশুসাহিত্যিক রিফাত নিগার শাপলা, অধ্যাপক মো. মাহবুবর রহমান, কবি মাশরুরা লাকী এবং কথাসাহিত্যিক আনোয়ার হোসেন বাদল।
মূল মঞ্চ
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হয় ‘স্মরণ: এস. ওয়াজেদ আলি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আবু হেনা মোস্তফা এনাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ইকতিয়ার চৌধুরী ও কুদরত-ই-হুদা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি হারিসুল হক, বায়তুল্লাহ কাদেরী এবং আফরোজা সোমা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আজহারুল হক আজাদ, সৈয়দ শহিদুল ইসলাম, সুকান্ত গুপ্ত এবং তামান্না সারোয়ার নীপা।
পুঁথি পাঠ করেন আবুল বাশার তালুকদার। এছাড়া ছিল মো. বশির উদ্দিন মাহমুদের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বিশ্বভরা প্রাণ’, সিলেটের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শ্রুতি সিলেট’ এবং ড. লীনা তাপসী খানের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী অণিমা মুক্তি গোমেজ, মমতা দাসী, শামসেল হক চিশতি, রওশন আলম, বাউল সুভাষ বিশ্বাস, মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ওয়াদুদুর রহমান রাহুল এবং ফারুক নূরী। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন রাজু চৌধুরী (তবলা), রবিন চৌধুরী (কী-বোর্ড), মো. ফায়জুর রহমান (বাঁশি), অরূপ কুমার শীল (দোতারা) এবং আব্দুস সোবহান (বাংলা ঢোল)।
শনিবার মেলায় যা থাকবে
শনিবার বইমেলার দশম দিন। মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় থাকবে শিশুপ্রহর।
অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন হবে।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হবে ‘জন্মশতবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি: সুচিত্রা মিত্র’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সাইম রানা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন আহমেদ শাকিল হাসমী ও অণিমা রায়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মফিদুল হক।