ফারদিনের ‘আত্মহত্যা’: ডিবি-র‌্যাবের ব্যাখ্যায় ‘সন্দেহ কেটেছে’ সহপাঠীদের

শিক্ষার্থীরা ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ আপাতত কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান সংবাদ সম্মেলনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2022, 03:19 PM
Updated : 17 Dec 2022, 03:19 PM

ফারদিন নূর পরশ ‘আত্মহত্যা’ করেছেন বলে তদন্তকারী সংস্থা ডিবি ও র‌্যাবের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাতে আর কোনো প্রশ্ন বা সন্দেহের সুযোগ নেই জানিয়ে আন্দোলন থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা।

শনিবার সন্ধ্যায় বুয়েট ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তারা। তবে ফারদিনের পরিবার আইনি লড়াই চালিয়ে গেলে তাদের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে কয়েকজন নাম প্রকাশ না করে বক্তব্য দেন; একে একে আলোচিত এ মৃত্যুর তদন্তের বিষয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরেন।

আন্দোলন থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়ে এক শিক্ষার্থী বলেন, ডিবি ও র‌্যাব কার্যালয় গিয়ে আমরা যেসব তথ্য-প্রমাণাদি জেনেছি, আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করেছি।

“ডিবি ও র‌্যাবের তদন্তে যেসব বিষয়ে আমাদের মনে সন্দেহ বা প্রশ্ন জেগেছিল, তার সবকটির সন্তোষজনক উত্তর আমরা পেয়েছি। এ বিষয়ে প্রশ্ন করার মত আর কোনো এলিমেন্ট আমাদের হাতে নাই। তাদের ব্যাখ্যায় আমাদের কোনো কনফিউশন নেই।“

এ কারণে শিক্ষার্থীরা ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ আপাতত কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, “ভবিষ্যতে কোনো ক্লু থেকে ফারদিনের পরিবার এটা নিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে, যৌক্তিক দাবিতে আমরা তার পাশে থাকব।”

গত ৪ নভেম্বর রাতে নিখোঁজ হওয়ার পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফারদিনের (২৪) লাশ উদ্ধার করা হয়।

পরদিন ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন চিকিৎসক। পরে মাদক কারবারিদের হাতে ফারদিন খুন হয়েছেন বলেও সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে।

ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পাশাপাশি ছায়া তদন্ত চালায় র‌্যাব। এর আগে দুই সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে বিভ্রান্তি ছড়ালেও বুধবার একই উপসংহারে পৌঁছায় পুলিশের ইউনিট দুটি।

দুই পক্ষই বলেছে, নিখোঁজ হওয়ার দিন ভোররাতে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ফারদিন।

গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া এবং বিদেশ যেতে অর্থ জোগাড় করতে না পারার হতাশা থেকে ওই তরুণ আত্মহননের পথ বেছে নেন।

ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা তদন্তকারী এ দুই সংস্থার কথা মেনে নেননি। এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করে আসছেন তিনি। তার ছেলে আত্মহত্যা করেছে তা মানতে নারাজ। তিনি বলেছেন, কাউকে আড়াল করা হচ্ছে।

অপরদিকে তদন্তকারী সংস্থার বক্তব্য আসার পর সহপাঠী আর স্বজনরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই নতুন ব্যাখ্যায় প্রথমে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন- এটা মানতে নারাজ ছিলেন সহপাঠীরা।

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় বুয়েট শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তবে ওই কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাদের ডেকে ফারদিনের আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়েই শিক্ষার্থীরা পরে ডিবি কার্যালয়ে হাজির হন।

পরদিন শুক্রবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে র‌্যাব সদর দপ্তরে যান ফারদিনের ২০ সহপাঠী; সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তারা বৈঠক করেন। তবে সেদিন বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বিস্তারিত কিছু জানাননি তারা, ক্যাম্পাসে ফিরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার কথা জানান তারা।

শনিবার নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ডিবি ও র‌্যাবের কার্যালয়ে গিয়ে এ বিষয়ে আমরা ডিটেইলস জানতে পেরেছি যে, তারা ৩৮ দিন তদন্ত করে কী জোগাড় করেছেন। ফারদিনের ফোনের লোকেশন, টাইম, কোন কোন ওয়েবসাইট ভিজিট করেছিল, গত দুই বছরে কার কার সঙ্গে তার কথা হয়েছে এবং যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাদের আবার কাদের সঙ্গে কথা হয়েছে এরকম পনের হাজার লোককে ডিজিটাল নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে।

“তাদের যে এফোর্ট বা ডিজিটাল ইনফরমেশন আমাদের দেখিয়েছেন, তাতে প্রশ্ন করার সুযোগ আমাদের কম। আমাদের মাথায় যা যা প্রশ্ন ছিল, সব প্রশ্ন করেছি। যে ফুটেজটা দেখিয়েছে, যে সময় ব্রিজ থেকে লাফ দেওয়া হয়, সেই সময় থেকে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। টাইম ও লোকেশন মিলিয়ে এটা ফারদিন বলে তারা শনাক্ত করেছেন।”

তবে কোন কারণে আত্মহত্যা করেছেন, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি বলে জানান এই শিক্ষার্থী।

তিনি বলেন, “কেন আত্মহত্যা করেছে- এ বিষয়ে তারা আমাদের ক্লিয়ার করতে পারেন নাই। মোটিফ যে কোনো বিষয়ে হতে পারে, এটা তাদের দাবি। আমরা আমাদের সহপাঠীর জন্য একটি নৈতিক জায়গা থেকে দাঁড়িয়েছিলাম।

“এখন তাদের দেওয়া এভিডেন্স ও ডেটা থেকে আমরা মোটামুটি সন্তোষজনক উত্তর পেয়েছি। তারা যে তথ্য-প্রমাণাদি দেখিয়েছেন, তাতে আমাদের আর কোনো সন্দেহ করার মতো কিছু নেই।”

এর আগে শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জানিয়েছিলেন ফারদিনের মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশ ও র‌্যাব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করেই তা জানিয়েছে।

২৪ বছর বয়সী ফারদিন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং ক্লাবের যুগ্ম-সম্পাদকও ছিলেন ফারদিন। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তার স্পেন যাওয়ার কথাও সংবাদ মাধ্যমে এসেছিল। আর নিখোঁজ হওয়ার রাতের পরদিন তার পরীক্ষা ছিল বলে জানিয়েছিলেন তার বাবা ও সহপাঠীরা।

শীতলক্ষ্যা নদী থেকে মরদেহ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসক শেখ ফরহাদ জানিয়েছিলেন, নিখোঁজ হওয়ার দিনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ফারদিন। মাথা ও বুকে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মৃত্যুর আগে শারীরিক নির্যাতনের কথাও বলেছিলেন তিনি।

চিকিৎসকের ওই বক্তব্যের পর তার বাবা রামপুরা থানায় ফারদিনের বন্ধু আমাতুল্লাহ বুশরাকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। নিখোঁজ হওয়ার আগে কয়েকঘণ্টা ফারদিন ও বুশরা একসঙ্গে ছিলেন।

মামলার তদন্তে নেমে ডিবি ও র‌্যাব এ মৃত্যুর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের চনপাড়ার মাদক ব্যবসায়ীরা জড়িত বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর এলে তা আলোচনা তৈরি করে।

আরও পড়ুন:

Also Read: ফারদিন খুন হননি, আত্মহত্যা: ডিবি-র‌্যাব

Also Read: ফারদিনের ‘আত্মহত্যা’: র‌্যাব পুলিশ ভালোভাবে বুঝেই বলেছে, বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

Also Read: ফারদিনের মৃত্যু: এবার র‍্যাবের ব্যাখ্যা শুনলেন সহপাঠীরা

Also Read: ফারদিনের মৃত্যু: ডিবির সঙ্গে বৈঠকে ‘অনেকটা সন্তুষ্ট’ সহপাঠীরা

Also Read: ফারদিন যাত্রাবাড়ী গেলেন, লেগুনায় উঠলেন, তারপর? তদন্ত গতিহারা

Also Read: নিখোঁজ বুয়েট ছাত্রের মরদেহ মিলল শীতলক্ষ্যায়