ফারদিনের মৃত্যু: ডিবির সঙ্গে বৈঠকে ‘অনেকটা সন্তুষ্ট’ সহপাঠীরা

যে কারণে ডিবি ফারদিনের মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলছে, আলামত দেখার পর তা ‘প্রাসঙ্গিক’ মনে হচ্ছে সহপাঠীদের।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2022, 08:58 AM
Updated : 15 Dec 2022, 08:58 AM

ফারদিন নূর পরশ ‘আত্মহত্যা’ করেছেন বলে যে দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করেছে, শুরুতে তা মানতে না চাইলেও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিন ঘণ্টা বৈঠক করে ‘অনেকটা সন্তুষ্ট’ বুয়েটের শিক্ষার্থীরা।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন ফারদিনের সহপাঠীরা। আগে হত্যা বললেও এখন পুলিশ কেন ‘আত্মহত্যা’ বলছে, সেই প্রমাণ দেখতে তারা ডিবি কার্যালয়ে এসেছিলেন।

বৈঠক শেষে শিক্ষার্থীদের পক্ষে তাহমিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “আলামতগুলো তারা আমাদের দেখিয়েছেন। আলামতগুলো আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। তারা এগুলোর পেছনে বেশ এফোর্ট দিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় হয়ত কিছু গ্যাপ আছে। আশা করি সামনে এগুলো নিয়ে তারা আরও অগ্রসর হবে। এ ব্যাপারে তারা আমাদের একটা আশ্বাসও দিয়েছে।”

যেসব আলামত দেখানো হয়েছে, তা আত্মহত্যা বলে ধরে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট কিনা- এমন প্রশ্নে ফারদিনের আরেক সহপাঠী বলেন, “এ নিয়ে ডিবির সাথে আমাদের কথা হয়েছে, তারা (ডিবি) বলেছেন যে, শতভাগ কাজ করা যায় না বা এটা সম্ভব না। কিছু ক্ষেত্রে গ্যাপ আছে বা থাকে।

“সেক্ষেত্রে উনারা কাজ করছেন, আমরা আমাদের পয়েন্ট বলেছি…। তারা পরবর্তীতে এ বিষয়টি জানাবেন।”

ফারদিনের ‘আত্মহত্যার’ প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীদের কোনো চূড়ান্ত মতামত আছে কি না, সেই প্রশ্নের জবাবে তাহমিদ জানান, তারা নিজেরা এ ব্যাপারে পর্যালোচনা করে বিস্তারিত পরে জানাবেন।

“আপতত আমাদের কনক্লুশন হচ্ছে, তাদের (ডিবি) বক্তব্য এবং আলামতগুলো প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। তাদের তদন্তের ধরন এবং এফোর্ট প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। তবে কিছু গ্যাপ আছে কিছু স্পট আছে। ওগুলো নিয়ে আরও স্পষ্ট হওয়ার দরকার থাকতে পারে।”

অন্যান্য কিছু বিষয়ে ডিবি ‘কংক্রিট’ আলামত দেখিয়েছে মন্তব্য করে ফারদিনের এই সহপাঠী বলেন, “তাদের কার্যকলাপে আমরা অনেকটা আশ্বস্ত, ডিবির সহযোগিতায় আমরা আশ্বস্ত।”

আত্মহত্যার মোটিভ কী হতে পারে- এই প্রশ্নের জবাবে তাহমিদ বলেন, “স্পষ্ট কোনো মোটিভ জানা নেই আমাদের কাছে। উনারা (ডিবি) কিছু জিনিস দেখিয়েছে যেগুলো সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্স বলা যায়, যে আত্মহত্যার কথাই মনে হতে পারে। হয়ত আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু ওই রকম ‘কংক্রিট’ ওই রকম ‘সলিড’ ইনফরমেশন অতটা তারা দেখায়নি।

“এ ব্যাপারটাতে তাদের (ডিবি) কাজ করার জায়গা থাকতে পারে। আত্মহত্যার মোটিভটি শিওর হওয়া যায় কিনা।”

তদন্ত এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ডিবি আশ্বস্ত করেছে জানিয়ে তাহমিদ বলেন, শিক্ষার্থীদের পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে ক্যাম্পোসে ফিরে সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানাবেন।

Also Read: ‘আত্মহত্যার প্রমাণ’ দেখতে ডিবি কার্যালয়ে ফারদিনের সহপাঠীরা

Also Read: ‘আত্মহত্যা’ মানতে নারাজ ফারদিনের সহপাঠীরা, ‘কনভিন্সড’ নন বাবাও

Also Read: বুয়েট ছাত্র ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে: ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক

Also Read: ফারদিন খুন হননি, আত্মহত্যা: ডিবি-র‌্যাব

ডিবির ব্যাখ্যায় ‘সন্তুষ্ট কিনা’ জানতে চাইলে ব্রিফিংয়ে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “তাদের সহযোগিতায় আমরা অনেকটা সন্তুষ্ট। তারা অনেক কাজ করছেন। আমরা চূড়ান্ত কিছু বলছি না। বুয়েটে ফিরে সবার সাথে আলোচনা করে আমরা বিস্তারিত বলব।”

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, “পুরোটাই যে আত্মহত্যা, তাদের আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। তারাও বিষয়টি বুঝেছেন।”

তবে ফারদিনের বাবা নূরউদ্দিন রানা এখনও মানতে রাজি নন যে তার ছেলে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে না থাকলেও পরে তিনি ডিবি কার্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আমি মানি না, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বিষয়টি আমি এখনও মানি না।”

কেন তিনি হত্যা বলে মনে করছেন জানতে চাইলে নূরউদ্দিন বলেন, “র‌্যাব বা ডিবি কোনো ভিডিও দেখাতে পারেনি, কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।”

সেক্ষেত্রে কে ফারদিনকে হত্যা করে থাকতে পারে– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “তদন্তকারী সংস্থাই সেটা বের করবে।”

গত ৪ নভেম্বর রাতে নিখোঁজ হওয়ার পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল থেকে বুয়েটছাত্র ফারদিনের (২৪) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

পরদিন ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন চিকিৎসক। তিনি মাদক কারবারিদের হাতে খুন হয়েছেন বলেও সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে।

তদন্ত নিয়ে পরিবার ও সহপাঠীদের হতাশার মধ্যে র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ বুধবার হঠাৎ করেই জানায়, ওই তরুণ আত্মহত্যা করেছিলেন বলে তারা এখন ধারণা করছেন।

ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনাটির তদন্তভার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে, পাশাপাশি ছায়া তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল র‌্যাব। এর আগে দুই সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে বিভ্রান্তি ছড়ালেও বুধবার একই উপসংহারে পৌঁছায় র‌্যাব ও ডিবি।

দুই পক্ষই বলেছে, নিখোঁজ হওয়ার দিন ভোররাতে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ফারদিন।

গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া এবং বিদেশ যেতে অর্থ জোগাড় করতে না পারার হতাশা থেকে ওই তরুণ আত্মহননের পথ বেছে নেন।

তবে সহপাঠী আর স্বজনরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই নতুন ব্যাখ্যায় প্রথমে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন– এটা মানতে নারাজ ছিলেন তার সহপাঠীরা।

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় বুয়েট শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তবে ওই কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাদের ডেকে ফারদিনের আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়েই শিক্ষার্থীরা পরে ডিবি কার্যালয়ে হাজির হন।

সেখানে ডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘণ্টা তিনেক আলোচনা শেষে বের হয়ে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে অন্যদের সাথে কথা বলে তারা কর্মসূচির বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।

গত ৪ নভেম্বর দুপুরে কোনাপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন ফারদিন; বলে গিয়েছিলেন, পরদিন তার পরীক্ষা রয়েছে বলে রাতে বুয়েটের হলেই থাকবেন। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরবেন।

কিন্তু পরদিন পরীক্ষায় তার অনুপস্থিত থাকার পর জেনে খোঁজাখুজি করে ছেলেকে না পেয়ে থানায় জিডি করেন ফারদিনের বাবা নূরউদ্দিন রানা। তিন দিন পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে লাশ পাওয়া যায়।

ফারদিনের লাশ পাওয়া যায় গোদনাইলে বর্ণালী টেক্সটাইল মিলের ঘাট এলাকায়। উদ্ধারের সময় তার হাতে ঘড়ি পরা ছিল; জামা-প্যান্ট ছিল প্রায় অক্ষত। তার মানিব্যাগও সঙ্গে ছিল বলে পুলিশ জানায়।

তবে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক শেখ ফরহাদ সাংবাদিকদের বলেন, নিখোঁজ হওয়ার দিনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ফারদিন। তার মাথা ও বুকে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে৷ মৃত্যুর আগে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ওই ছাত্র৷

ফারদিন নিখোঁজ হওয়ার দিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমতুল্লাহ বুশরা নামে এক বন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। ওই তরুণীকে আসামি করে ফারদিনের বাবা মামলা করার পর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ফারদিনের মধ্যে সেদিন কোনো অস্বাভাবিকতা না দেখার কথা বুশরাও বলেছিলেন পুলিশকে।

তাকে উদ্ধৃত করে ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রাশিদ এর আগে বলেছিলেন, “বুশরার বক্তব্য হচ্ছে, তারা যতক্ষণ একসঙ্গে ছিলেন, ততক্ষণ ফারদিন স্বাভাবিকই ছিলেন। তারা রেস্তোরাঁয় খেয়ে নিজ নিজ বিল দিয়েছেন। তাকে রামপুরা নামিয়ে দিয়ে ফারদিন চলে যায়।”

ওই ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে তদন্ত এগোলেও সবশেষ আত্মহত্যার যে কথা বলা হচ্ছে পুলিশ ও র‌্যাবের পক্ষ থেকে, তাতে ‘সন্তুষ্ট নন’ ফারদিনের বাবা নূরউদ্দিন রানা।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ডিবি ও র‍্যাবের বক্তব্যে আমি কনভিন্সড না। রামপুরার পর ফারদিনের যেসব (সিসি ক্যামেরার) ভিডিও দেখানো হয়েছে তার কোনোটিই স্পষ্ট নয়।

“ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে থেকে ফারদিন ঝাঁপ দিয়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তারও কোনো স্পষ্ট ভিডিও নেই। সেখানে ঢেউ দেখা যায়। কিন্তু ফারদিনই যে সেখান থেকে লাফিয়ে পড়েছে, তার গ্যারান্টি কী। এটা তো অন্য কেউ হতে পারে।”

এদিকে ডিবি কার্যালয় থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে ফেরার পর বৃহস্পতিবার রাতে ফারদিনের সহপাঠীরা জানান, পরবর্তী কোনো কর্মসূচির বিষয়ে তারা আপাতত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি।

ফারদিনের সহপাঠী মাশিয়াত জাহিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিবি কার্যালয় থেকে ফিরে আসার পর র‌্যাব আমাদের ডেকেছে। শুক্রবার সকালে সেখান থেকে ফেরার পর পরবর্তী করণীয় জানানো হবে।”

Also Read: ফারদিন ডেমরা সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন: ডিবি

Also Read: সেই রাতে ৪ স্থানে ঘোরেন ফারদিন, যাত্রাবাড়ী থেকে ওঠেন লেগুনায়: ডিবি

Also Read: ফারদিন যাত্রাবাড়ী গেলেন, লেগুনায় উঠলেন, তারপর? তদন্ত গতিহারা

Also Read: হিসাব মেলাতে পারছেন না ফারদিনের সহপাঠী-স্বজনরা