‘আত্মহত্যা’ মানতে নারাজ ফারদিনের সহপাঠীরা, ‘কনভিন্সড’ নন বাবাও

ডিবি ও র‌্যাব বলছে, এই বুয়েটছাত্র ডেমরা সেতু থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Dec 2022, 05:33 PM
Updated : 14 Dec 2022, 05:33 PM

ফারদিন নূর পরশ আত্মহত্যা করেছেন বলে র‌্যাব-পুলিশ তদন্তে পাওয়ার দাবি করলেও তা মানতে নারাজ বুয়েটে তার সহপাঠীরা। এর প্রতিবাদে তারা কর্মসূচিও ডেকেছেন।

অন্যদিকে ফারদিনের বাবা সাংবাদিক কাজী নূরউদ্দিন রানাও বলছেন, যে তথ্যের ভিত্তিতে আত্মহত্যার কথা বলা হচ্ছে, তাতে একমত নন তিনি।

গত ৪ নভেম্বর রাতে নিখোঁজ হওয়ার পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল থেকে বুয়েটছাত্র ফারদিনের (২৪) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

ওই সময় ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেছিলেন, ফারদিনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে, তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

ফারদিনের বাবা এরপর হত্যা মামলা করলে তা তদন্তের দায়িত্ব পায় গোয়েন্দা পুলিশ। পাশাপাশি ছায়া তদন্তে নামে র‌্যাব।

তদন্তের গতি নিয়ে ফারদিনের পরিবার ও সহপাঠীদের অসন্তোষের মধ্যে ৪০ দিন পর বুধবার র‌্যাব-ডিবি উভয় পক্ষ থেকে আলাদাভাবে সাংবাদিকদের বলা হয়, এই তরুণ নিখোঁজ হওয়ার রাতেই ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, পরীক্ষা ফল খারাপ হওয়া এবং বিদেশ যাওয়ার অর্থ সংস্থান না হওয়ায় হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেন এই তরুণ।

তার এই বক্তব্য মানতে নারাজ ফারদিনের সহপাঠী মো. শাফী বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষার ফলাফল বা সিজিপিএ নিয়ে ফারদিনকে আমরা কখনও ডিপ্রেসড দেখি নাই। ফারদিন মৃত্যুর আগে আমাদের সঙ্গে ১০ দিন একটা সার্ভে করেছে। সার্ভে শেষে পরীক্ষার আগের রাতে সারা ঢাকা ঘুরে ঘুরে সুইসাইড করেছে! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?  সুইসাইড করার জন্য তো বাসা আছে, হল আছে, নিজের রুম আছে। এত ঢং করে আত্মহত্যা করবে কেন?”

Also Read: বুয়েট ছাত্র ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে: ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক

Also Read: ফারদিন খুন হননি, আত্মহত্যা: ডিবি-র‌্যাব

Also Read: ফারদিন ডেমরা সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন: ডিবি

তিনি বলেন, “পুলিশ প্রায় দুই মাস ইনভেস্টিগেট করে গতকাল (মঙ্গলবার) ডিপার্টমেন্ট থেকে ওর রেজাল্ট শিট নিয়েছে। গতকাল রেজাল্ট নিয়ে আজকেই ডিক্লেয়ার করে দিল, এটা সুইসাইড। এটা তো প্রথম দিনই করতে পারত। এটা ডিক্লেয়ার করতে তো দুই মাস লাগার কথা না।”

বুয়েটের পুরকৌশলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন থাকতেন ঢাকার ডেমরার কোনাপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে। বিতার্কিক হিসেবে এই বছরই স্পেনের এক অনুষ্ঠানে তার যাওয়ার কথা ছিল।

গত ৪ নভেম্বর দুপুরে কোনাপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন ফারদিন; বলে গিয়েছিলেন, পরদিন তার পরীক্ষা রয়েছে বলে রাতে বুয়েটের হলেই থাকবেন। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরবেন।

সেদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমতুল্লাহ বুশরা নামে এক বন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তিনি। ওই তরুণীকে আসামি করে ফারদিনের বাবা মামলা করার পর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ফারদিনের মধ্যে সেদিন কোনো অস্বাভাবিকতা না দেখার কথা বুশরাও বলেছিলেন পুলিশকে।

তাকে উদ্ধৃত করে ডিবি কর্মকর্তা হারুন এর আগে বলেছিলেন, “বুশরার বক্তব্য হচ্ছে, তারা যতক্ষণ একসঙ্গে ছিলেন, ততক্ষণ ফারদিন স্বাভাবিকই ছিলেন। তারা রেস্তোরাঁয় খেয়ে নিজ নিজ বিল দিয়েছেন। তাকে রামপুরা নামিয়ে দিয়ে ফারদিন চলে যায়।”

শাফী বলেন, “বলা হচ্ছে, বিদেশ যেতে অর্থ জোগাড় করতে না পারার হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছে। টাকার জন্য বুয়েট শিক্ষার্থী কখনও আত্মহত্যা করতে পারে না। বুয়েট শিক্ষার্থীরা এতটা ‘গোবর’ নয়, রেজাল্ট দিয়ে জীবনকে জাজ করবে, ফারদিন তো অবশ্যই না। ডিবেটে তার পারফর্মেন্স দেখলেই এটা বোঝা যায়।

“প্রাথমিক পোস্ট মর্টমে ডাক্তার কিন্তু বলেছিল, তার গায়ে আঘাত, মাথায় আঘাত পেয়েছে। তখন বলা হয়েছে, এটা পরিকল্পিত হত্যা। দুই মাস পরে কেন সুইসাইড বলা হচ্ছে?”

Also Read: সেই রাতে ৪ স্থানে ঘোরেন ফারদিন, যাত্রাবাড়ী থেকে ওঠেন লেগুনায়: ডিবি

Also Read: ফারদিন যাত্রাবাড়ী গেলেন, লেগুনায় উঠলেন, তারপর? তদন্ত গতিহারা

মাশিয়াত জাহিন নামের ফারদিনের আরেক সহপাঠী বলেন, “আত্মহত্যার বিষয়টি আমরা সহপাঠিরা কেউই বিশ্বাস করছি না।

“আমাদের একটা সার্ভে (জরিপ) করতে হয়েছিল, সেটা শেষ করে সে যায়৷ সেটি ১০ দিন সারারাত সারাদিন ফিল্ডে থেকে করতে হয়েছে৷ যারা তার সাথে ছিল, তারা সবাই ফারদিনকে উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে দেখেছে। যার মধ্যে মরে যাওয়ার মোটিভ থাকবে, সে তো ১০ দিন ধরে এই উৎসাহ নিয়ে কাজ করত না।”

মাশিয়াত বলেন, “ডিবি যখন নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার কথা বলছে, তার কয়েক ঘণ্টা আগেও সে অন্য একজনের সাথে সময় কাটিয়েছে, খাওয়া-দাওয়া করেছে, কথা-বার্তা বলছে, কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি।

“স্পেনে বিতর্ক করতে যাওয়া নিয়েও অনেক এক্সাইটেড ছিল। টাকা নিয়ে ডিবি যেটা বলছে সেটা সিভিয়ার কোনো সমস্যা না, ওটা ম্যানেজ হয়ে যেত, কোনো স্পন্সর ম্যানেজ হয়ে যেত। আর রেজাল্ট তেমন খারাপও ছিল না, ভালোও ছিল না (কোনো ফেইল ছিল না) কিন্তু সে সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে তো এগিয়ে আছে৷ শুধু রেজাল্টের জন্য কখনোই সুইসাইড করার প্রশ্নই আসে না।”

তিনি বলেন, “এজন্য আমরা কালকে কর্মসূচিও ডেকেছি। আমরা সেখানে পয়েন্ট বাই পয়েন্ট কথা বলব যে কেন আত্মহত্যার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য না।”

সহপাঠিরা জানান, বুয়েটের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বুয়েট শহীদ মিনারে বৃহস্পতিবার সকালে ব্রিফিং ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।

ফারদিনের বাবা নূরউদ্দিন রানা বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “ডিবি ও র‍্যাবের বক্তব্যে আমি কনভিন্সড না। রামপুরার পর ফারদিনের যেসব (সিসি ক্যামেরার) ভিডিও দেখানো হয়েছে তার কোনোটিই স্পষ্ট নয়।

“ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে থেকে ফারদিন ঝাঁপ দিয়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তারও কোনো স্পষ্ট ভিডিও নেই। সেখানে ঢেউ দেখা যায়। কিন্তু ফারদিনই যে সেখান থেকে লাফিয়ে পড়েছে, তার গ্যারান্টি কী। এটা তো অন্য কেউ হতে পারে।” 

Also Read: হিসাব মেলাতে পারছেন না ফারদিনের সহপাঠী-স্বজনরা