২১ অগাস্ট: বিভীষিকাময় এক দিন

শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে’ হয়েছিল এই হামলা; নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন, আহত হন অগুনতি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2023, 07:46 PM
Updated : 20 August 2023, 07:46 PM

সেদিন শান্তির মিছিল হওয়ার কথা ছিল, তাতে অংশ নিতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে জড়ো হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা; কিন্তু একের পর এক গ্রেনেড হামলায় এক লহমায় বদলে যায় আবহ; রক্তে ভেসে যাওয়া স্থানটি রূপ নেয় মৃত্যুপুরীতে। সেই বিভীষিকা দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা দেশ।

উনিশ বছর আগে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এই ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ, এর মূল লক্ষ্য ছিলেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে রষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই যে ছিল সেই হামলার উদ্দেশ্য, যা পরে উঠে আসে আদালতের রায়ে; যাতে সেই সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর-এমপির সঙ্গে দণ্ডিত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেদিন মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করেছিলেন দলের নেতা-কর্মীরা; এজন্য কাউকে কাউকে নিজের প্রাণও বিসর্জন দিতে হয়েছিল। ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন সেই হামলায়, আহত হন অগুনতি। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই ক্ষত এখনও বইছেন। গ্রেনেড-বোমার স্প্লিন্টার দেহে নিয়ে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন আরও অনেকে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভয়াবহতম সেই হামলার উনবিংশতিতম বার্ষিকী সোমবার নানা কর্মসূচিতে পালিত হবে, স্মরণ করা হবে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্টে চালানো সেই হামলায় নিহতদের।

হামলার স্থান বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী শহীদ বেদী নির্মিত হয়েছে। সেখানে সকাল ৯টায় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুল দেওয়া হবে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সকাল সোয়া ১১টায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আলোচনা সভা হবে।

এই কর্মসূচি নির্বিঘ্ন করতে সকাল ৭টা থেকে দুপুর পর্যন্ত ওই এলাকায় ‘ট্রাফিক ডাইভারশন’ চলবে। এসময়ে গণপরিবহন ও জনসাধারণকে চলাচলের জন্য বিকল্প পথ বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ।

কেন্দ্রীয়ভাবে পালনের পাশাপাশি সারাদেশে দিনটি স্মরণে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো।

ভয়াবহ সেই হামলার বার্ষিকীতে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পঁচাত্তরের পর একুশে অগাস্ট:রাষ্ট্রপতি

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পঁচাত্তরে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় ২৯ বছর পর শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।

“এরপরও ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকচক্র থেমে থাকেনি। তারা পরিকল্পিভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জনসভা চলাকালীন ইতিহাসের বর্বরতম গ্রেনেড হামলা চালায়।”

রাষ্ট্রপতি বলেন, “ঘাতকচক্রের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে রুখে দেওয়া এবং দেশে স্বৈরশাসন ও জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ তা হতে দেয়নি।”

তখনকার বিরোধী দলের উপর এই হামলার ঘটনার রেশ ধরে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, “গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহমর্মিতার পাশাপাশি পরমতসহিষ্ণুতা অপরিহার্য।” 

রায় দ্রুত কার্যকরের আশা প্রধানমন্ত্রীর

খালেদা জিয়ার সরকার আমলে গ্রেনেড হামলার এই ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার বিভিন্ন চেষ্টার বিষয়টি তুলে ধরে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসা রায় দ্রুত কার্যকরের আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাণীতে তিনি বলেন, “এ নারকীয় হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচার করা ছিল সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।

“কিন্তু বিএনপি-জামাত জোট সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো হত্যাকারীদের রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। হামলাকারীদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ সব আলামত ধ্বংস করে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপব্যবহার করে তারা ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজায়।”

পরবর্তীকালে তদন্তে হাওয়া ভবন এবং বিএনপি-জামায়াত নেতাদের জড়িত থাকার প্রমাণ বেরিয়ে আসার বিষয়টি তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে বিচারিক আদালত থেকে রায় আসার কথা বলেন তিনি, যে রায়ে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয় আরও ১১ আসামির।

Also Read: বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় একুশ অগাস্টের হামলা: প্রধানমন্ত্রী

বিচারিক আদালতের সেই রায়ে ডেথ রেফারেন্স এবং আপিলের শুনানি এখন হাই কোর্টে চলছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আশা করি, সকল আইনি বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় দ্রুত কার্যকর হবে। এই রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চির অবসান হবে, জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে।”

গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণ করে তিনি বলেন, “বিএনপি-জামাত জোট সবসময় জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়ে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা করে আসছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সারাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এই জোট। একের পর এক বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা চালিয়ে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চালায়।

“এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালায়। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজনৈতিক সমাবেশে এ ধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ২১ অগাস্টের বীভৎস হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে।”

Also Read: রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ২১ অগাস্টের হামলা: বিচারক

কী ঘটেছিল সেদিন?

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট জনাকীর্ণ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে থাকা সাংবাদিকদের বিবরণ অনুযায়ী, সেদিন বিকাল ৩টা থেকে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন দলের মধ্যম সারির নেতারা। ৪টার দিকে শুরু হয় জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তৃতার পালা। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা আসেন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে। যে ট্রাকে সমাবেশের মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, তার পেছনে বাঁ দিকে একটি সিঁড়ি ছিল উপরে ওঠার জন্য। ট্রাকের শেষ মাথায় ডানদিকে রাখা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন নেতারা।

 শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুরু হয় বিকাল ৫টা ২ মিনিটে। তার দুই পাশে ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।

পুরোটা সময় ওই টেবিলের পাশে বসেছিলেন শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার আব্দুল্লাহ আল মামুন। মঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির কয়েক গজের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতির বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ গাড়ি। সেখানে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিক, যিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা।

৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে শেখ হাসিনা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে মাইক থেকে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়া হয়। ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতা এবং নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ট্রাকের উপর বসিয়ে দেন।

এর পরপরই আরও তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়ে চারদিকে ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত মেজর শোয়েব মো. তারিকুল্লাহ ট্রাকের সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নামিয়ে আনতে বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতিকে।

আওয়ামী লীগ নেতা মায়াসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে নামিয়ে নেওয়ার সময় আরেকটি গ্রেনেড ট্রাকের পেছনের ডালায় বাড়ি খেয়ে পাশেই বিস্ফোরিত হয়। ফলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আবার সবাই ট্রাকের উপর বসে পড়তে বাধ্য হন।

Also Read: বিভীষিকাময় ২১ অগাস্ট: গ্রেনেডের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা

Also Read: ২১ অগাস্ট: কর্মীদের মানবঢালে যেভাবে প্রাণে বাঁচেন শেখ হাসিনা

নেতা-কর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা সেখানে শেখ হাসিনাকে ঘিরে তৈরি করেন মানববর্ম। কিন্তু শোয়েব নিচ থেকে জানান, বিস্ফোরণে ট্রাকের তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে ট্রাকে আগুন ধরে যেতে পারে।

শেখ হাসিনার পায়ের স্যান্ডেল তখন কোথায় ছিটকে গেছে, চশমাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। ওই অবস্থায় মামুন, শোয়েব এবং নজিব আহমেদসহ অন্যরা মিলে তাকে নিয়ে গাড়ির সামনে বাঁ দিকের আসনে বসিয়ে দেন।

সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, বিস্ফোরণে আহত নেতাকর্মীদের ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না শেখ হাসিনা। অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে বাসভবন সুধা সদনে নিয়ে যাওয়া হয়।

শেখ হাসিনা যখন সেই স্থান ছাড়ছিলেন, তখনও গ্রেনেড ফাটানো হচ্ছিল, পাওয়া যাচ্ছিল গুলির শব্দ।

ওই হামলা আর বিস্ফোরণের পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন নেতা-কর্মীরা। ওই অবস্থায় রিকশা, অটোরিকশা, এমনকি রিকশাভ্যানে করেও আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা।

 সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। কেন্দ্রীয় নেতা আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের, যার মাথায় স্প্লিন্টার বিঁধেছিল। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।

  • ২১ অগাস্ট হামলায় নিহতরা-  আইভি রহমান, শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, মোহাম্মদ হানিফ, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় জানা যায়নি।

সেদিন গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্লিন্টারে বিদ্ধ হন তারেক আহমেদ সিদ্দিক, নজিব আহমেদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শোয়েব মো. তারিকুল্লাহসহ অনেকে।

সেদিনই টেলিফোনে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমার কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে। গ্রেনেড যখন বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন নেতা-কর্মীরা আমাকে ঘিরে রেখেছিল| তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। এখনও আমার কাপড়ে তাদের রক্ত লেগে আছে।”

‘টার্গেট’ ছিলেন শেখ হাসিনা

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন বাঁচতে না পারেন, তার সব চেষ্টাই সেদিন করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের দাগ, গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের চিহ্ন আর পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির চাকা সে কথাই প্রমাণ করে।

 সুধা সদনে শেখ হাসিনার বাসভবনে গাড়িটি দেখিয়ে দলের তখনকার সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী পরদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থার গাড়িটিই শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছে।

তিনি বলেন, গ্রেনেড হামলার পরপরই নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ঘিরে ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে যান। আর তখনই গাড়ির সামনের জানালা লক্ষ্য করে অনেকগুলো গুলি ছোড়া হয়। দেহরক্ষী মাহবুব তখনই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

শেখ হাসিনা গাড়িতে ওঠার পরপরই পেছন থেকে বাঁ দিকের সিট লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়। সব শেষে চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করে হামলাকারীরা।

কিন্তু চালক মোহাম্মদ আব্দুল মতিন সচিবালয়ের সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে শহীদ মিনার, পলাশী, নিউ মার্কেট হয়ে পিলখানার ভেতর দিয়ে নিরাপদেই ধানমণ্ডিতে সুধা সদনে পৌঁছে দেন শেখ হাসিনাকে।

অনেক পরে আদালতের রায়ে বলা হয়, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ ওই সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।

বিচারক রায়ে বলেছিলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ‘পরাজিত শক্তি’ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ওই হত্যাকাণ্ডের পর চার জাতীয় নেতাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। এরপরও ষড়যন্ত্র চলতে থাকে।

“পরবর্তীতে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়। ‘শেখ হাসিনাকে হালকা নাশতা করানো হবে’- এই উদ্ধৃতি দিয়ে দেশীয় জঙ্গি সংগঠনের কতিপয় সদস্য আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সহায়তায় হামলা করে।”

দীর্ঘ প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বিচার

গ্রেনেড হামলার পরপরই বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য আসছিল বিএনপি-জামায়াত সরকারের কর্তা-ব্যক্তিদের কাছ থেকে। এরপর মামলার শুরু থেকেই তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা শুরুহয়। তবে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তদন্ত শুরু হলে বেরিয়ে আসতে থাকে নানা তথ্য।

২০০৮ সালের জুনে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই তাজউদ্দিন, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আদালতের রায় নিয়ে শুরু হয় অধিকতর তদন্ত। সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন। সেখানে তারেক রহমানসহ চার দলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নেতারা তদন্তের শুরুতে এ হামলার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ওই হামলায় জড়িত বলেও সে সময় প্রচার চালানো হয়েছিল।

কিন্তু সম্পূরক তদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত জোট হামলার পর থেকেই তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে কাজ শুরু করে। হামলার অনেক আলামত সে সময় নষ্ট করে ফেলা হয়। হামলার বিষয়ে নোয়াখালীর জজ মিয়ার ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দেওয়ার বিষয়টি যে নাটক ছিল, সেটাও তখনই বেরিয়ে আসে।

হামলার ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে ঢাকার দ্রুত বিচার টাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারক।

খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয় আরও ১১ জনের।

সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে সাবেক কেবিনেট সদস্য ছাড়াও, সাবেক সংসদ সদস্য, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, বিএনপি নেতা ও হুজির জঙ্গিরা রয়েছে।

তারেক ছাড়া পলাতকরা হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী (যাবজ্জীবন), কুমিল্লার মুরাদনগরে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (যাবজ্জীবন), অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার (২ বছর কারাদণ্ড), ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ টি এম আমিন আহমদ (২ বছর কারাদণ্ড), হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ (মৃত্যুদণ্ড), জঙ্গিনেতা মাওলানা তাজউদ্দিন (মৃত্যুদণ্ড), মহিবুল মুত্তাকিন (যাবজ্জীবন), আনিসুল মোরসালিন (যাবজ্জীবন), মোহাম্মদ খলিল (যাবজ্জীবন), মাওলানা লিটন (যাবজ্জীবন), জাহাঙ্গীর আলম বদর (মৃত্যুদণ্ড), মুফতি শফিকুর রহমান (যাবজ্জীবন), মুফতি আব্দুল হাই (যাবজ্জীবন) ও রাতুল আহমেদ বাবু (যাবজ্জীবন)।

Also Read: ২১ অগাস্ট: বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, তারেকের যাবজ্জীবন