“যেসব বিষয়ে রাষ্ট্র বিশেষভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এ কাজগুলো যারা করেছেন তারা যাতে শেষ পর্যন্ত ছাড় না পান আমরা চেষ্টা করব,” বলেন তিনি।
Published : 11 Dec 2024, 09:30 PM
ক্ষমতার পালাবদলের পরিবর্তিত সময়ে রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে কাজ না করার ওপর গুরুত্বারোপ করে দুর্নীতি দমন কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেছেন, এ সংস্থা নিয়ে জনপ্রত্যাশা খানিকটা হলেও পূরণ করতে পারবেন তারা।
তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, এই সময়ে এই পরিবর্তিত সময়ে জনপ্রত্যাশা রাষ্ট্রের যে প্রত্যাশা, আমরা সেই প্রত্যাশা খানিকটা হলেও পূরণ করতে পারব।”
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার পরদিন বুধবার কমিশনে যোগ দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সদ্য সাবেক এই সচিব।
এদিন তার সঙ্গে নবগঠিত কমিশনে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী। তবে নতুন আরেক কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাফিজ আহ্সান ফরিদ এদিন আসেননি।
পরে সন্ধ্যায় কমিশনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন চেয়ারম্যান ও কমিশনার।
বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন সদ্য যোগ দেওয়া চেয়ারম্যান।
আবদুল মোমেন বলেন, ‘‘যেকাজগুলো করব বলে আশা করি, তার মধ্যে প্রধান- জনপ্রত্যাশা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসময় জনগণের প্রত্যাশিত বিষয়গুলো কী কী হতে পারে? যেসব বিষয়ে বড় ধরনের ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, যেসব বিষয়ে রাষ্ট্র বিশেষভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; এ কাজগুলো যারা করেছেন তারা যাতে শেষ পর্যন্ত ছাড় না পান আমরা চেষ্টা করব।
”সেই কাজটি সঠিকভাবে ন্যায়পরাণভাবে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে সমাপ্ত করতে পারি। যাতে শেষ পর্যন্ত এমন না হয় যে আমরা একটি অসমাপ্ত তদন্ত কিংবা বায়াসড কোনেসা তদন্ত কিংবা কোনো রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে আমরা কাজ না করি সেদিকে লক্ষ্য রাখব।’’
সরকারি চাকরি জীবনে তিনটি রাজনৈতিক সরকার ও দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এই অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য রাজনৈতিক দলের মত কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নেই। রাজনৈতিক চাওয়া নেই। এই সরকারের চাওয়া হচ্ছে জনগণকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
”এখানে রাজনৈতিক সরকার প্রভাবিত করবে না। আমরাও প্রভাবমুক্ত থেকে ন্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাব।”
এর আগে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এলে প্রতিষ্ঠানটির অন্যান্য কর্মকর্তারা তাকে অভ্যর্থনা জানান। এসময় তার সঙ্গে নতুন দুদক কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজীও দুদক কার্যালয়ে প্রবেশ করেন।
বুধবার বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে প্রথমবার সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে আসেন সাবেক সচিব আবদুল মোমেন, যাকে সরকার পতনের পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকার দুদকের প্রধান হিসেবে বেছে নিয়েছে। তিনি সাড়ে চার বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্বে থাকা মুহাম্মদ মইনুউদ্দীন আব্দুল্লাহ এর স্থলাভিষিক্ত হলেন।
ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে গত ২৯ অক্টোবর আগের কমিশন পদত্যাগ করে। সেই থেকে ৪২ দিন ধরে দুদক নেতৃত্ব শূন্য ছিল।
নতুন চেয়ারম্যান মোমেন প্রধান কার্যালয়ে এলে সংস্থার অন্যান্য কর্মকর্তা তাকে অভ্যর্থনা জানান। এসময় তার সঙ্গে নতুন কমিশনার আলি আকবার আজিজীও কার্যালয়ে প্রবেশ করেন।
চেয়ারম্যান ও কমিশনার ঘণ্টা দুয়েক কার্যালয়ে অবস্থান করেন। এসময় তারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজখবর নেন।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় চেয়ারম্যান মোমেন সাংবাদিকদের বলেন,’’ দুর্নীতি একেবারে নির্মূল করতে পারব সেরকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া বোধহয় ঠিক হবে না, কিন্তু আমরা যাতে সাধ্যমত কাজ করতে পারি সেটা দেখতে হবে।”
৪২ দিন কমিশন না থাকলেও দুদক নিষ্ক্রিয় না থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এর মধ্যে তারা অনেক কাজ করেছেন। কমিশন না থাকায় সিদ্ধান্ত পেতে সমস্যা হয়েছে কিন্তু তারা কাজ পিছিয়ে রাখেননি।
রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে এ দায়িত্ব পালনে সংবাদমাধ্যমসহ সবার সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, “৫ অগাস্টের আগের বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও এর পরবর্তী বাংলাদেশের প্রত্যাশা এক নয়। যদি একরকম নাই হয়ে থাকে আমাদেরও ভূমিকা, আপনারা যে ভূমিকা পালন করছেন, ৫ অগাস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে-আমরাও সেই ভূমিকা যাতে আমরা পালন করতে পারি, সেই সহযোগীতা আপনারা সবার আগে করবেন।”
বৈষম্যর সূচনা দুর্নীতি থেকে হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যে আন্দোলন থেকে নব বাংলাদেশের সৃষ্টি সেটি বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ। বৈষম্যর সূচনা মূলত দুর্নীতি থেকে। যদি আমরা দুর্নীতিগ্রস্থ না হতাম বৈষম্য সৃষ্টি অনেক কম হত।
”সুতরাং আমরা যদি এই দুর্নীতিকে কাট করতে পারি, আমরা যদি কমিয়ে নিয়ে আসতে পারি তাহলে বৈষম্য ক্রমাগত কমতে থাকবে। কাজেই এই কাজটা যদি আমরা করতে পারি, আপনারা সবাই যদি সাহায্য করেন, আমি বিশ্বাস করি আমরা কমাতে অনেকাংশেই সক্ষম হব।”
নতুন আরেক কমিশনার হাফিজ আহ্সান ফরিদের শিগগির যোগ দেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ''তখন আমাদের কোরাম পূর্ণ হবে। কোরাম পূর্ণ না হলেও এরকম দুজন সদস্য নিয়েও আমরা কাজ চালিয়ে যেতে পারব।
“মানসিকভঅবে আমরা তিন সদস্যই একই মতাদর্শের অনুসারী আমাদের নিরপেক্ষভাবে ন্যায়নিষ্ঠভাবে আইন মেনে আমরা কাজ করে যাব।”
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘দুদক সমাজেরই একটি অংশ, কাজেই সমাজ যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয় দুদকও খানিকটা দুর্নীতিগ্রস্থ হতেও পারে। আমরা চেষ্টা করব এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে। এরকম বেশ কিছু অভিযোগ আমার বিরুদ্ধেও আছে সেটাও আপনারাও দেখবেন। যেকারো বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে আপনারা ন্যায়নিষ্ঠভাবে আপনারাও সেটি বিবেচনা করবেন, পর্যালোচনা করবেন তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন।”
সাংবাদিকদের কাছে সহযোগীতা চেয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সহযোগী হন এবং আমাদের ইতিবাচক বিষয়গুলো প্রচার করলে জাতি উপকৃত হবে।’’
চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে তার বিরুদ্ধে ফেইসবুকে ‘বিমানের এমডি থাকার সময়কার দুর্নীতির’ অভিযোগ ছড়িয়ে পড়া বিষয়ক প্রশ্নে সদ্য যোগ দেওয়া দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। দুদকে এসেছে ২০০৯ সালে, বহু তদন্ত হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রমাণিত হয়নি, দুদক ক্লিনচিট দিয়েছে। আমার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে, সেটাও আপনারা দেখবেন। যেকারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে ন্যায়নিষ্ঠভাবে আপনারা দেখবেন।”
দুদকে তিনি নিজেও হয়রানির স্বীকার হয়েছেন, এমন তথ্য তুলে ধরে আবদুল মোমেন বলেন, ২০০৯ সালের তদন্ত যদি ২০২৩ সালে শেষ হয় এটাই তো হয়রানি।
হয়রানি, মামলার জট কমানো বিষয়ক এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের কাজ শুরু করতে দিন। কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করব হয়রানি কমাতে পেরেছি কি না, তদন্তে গতি আনতে পেরেছি কি না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পেরেছি কি না।”
নতুন কমিশন গঠনের দিনই মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে আয় ও সম্পদ বিবরণী, দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সেগুলো তথ্য প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছে।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান আগামী সাত দিনের মধ্যেই নিজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব দেবেন বলে জানান।
এসময় নবনিযুক্ত কমিশনার আলি আকবার আজিজী সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়েও সম্মতি দেন।
নতুন কমিশনার আলি আকবার বলেন, “অনুসন্ধান ও তদন্ত যদি আমরা ঠিক মত করে দিতে পারি তবেই বিচারকরা ন্যায়বিচার দিতে পারবেন। এখানে বিচারককে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। বিচারকের একক কৃতিত্ব নাই। বিচারের পেছনে তদন্ত হচ্ছে ফাউন্ডেশন। তদন্ত নিরেপক্ষ হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে।
”আমরা জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকার আমাদের অনেক বিজ্ঞজনের মধ্য থেকে নির্বাচন করেছেন। আমাদের কোন ত্রুটি বিচ্যুতি নজরে আসলে নিসংকোচে বলবেন।”
মোমেনের নেতৃত্বে নতুন দুদক কমিশন
পদত্যাগ করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আবদুল মোমেন
দুদক চেয়ারম্যান-কমিশনার খুঁজতে কমিটি, সদস্য হলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ