এক যৌথ বিবৃতিতে রাঙামাটিতে অনিক চাকমাকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও ফুটেজে হত্যাকারীদের স্পষ্ট চেহারা দেখা যাওয়ার পরও তাদের গ্রেপ্তার না করায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।
Published : 02 Oct 2024, 06:32 PM
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে চারজন আদিবাসী হত্যা, লুটপাটসহ সব ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, উচ্চপর্যায়ের তদন্ত এবং ভিডিও ফুটেজে চিহ্নিত দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইন অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করার জোর দাবি তুলেছে অ্যাসোসিয়েশন অব ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও বিশিষ্ট নাগরিকরা।
বুধবার এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদার সই করা এক যৌথ বিবৃতিতে রাঙামাটিতে অনিক চাকমাকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও ফুটেজে হত্যাকারীদের স্পষ্ট চেহারা দেখা যাওয়ার পরও তাদের গ্রেপ্তার না করায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, খাগড়াছড়ির ঘটনার জের ধরে গত ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটিতে আদিবাসী ও ‘সেটলার বাঙালি’দের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ২০০ গজের মধ্যে একটি চায়ের দোকানে বসে থাকা অনিক চাকমাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
ভিডিও ফুটেজে হত্যাকারীদের চেহারা স্পষ্ট, তাদের পরিচয়ও নিশ্চিত হওয়া গেছে দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। ঘটনার সময় ভাঙচুর চালানো হয়েছে বনরূপা মৈত্রী বিহারে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অফিস। এ সব ঘটনায় কাউকে অভিযুক্ত বা গ্রেপ্তার এখনও করা হয়নি।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২১ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা ঘটনাক্রান্ত দুই জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি সফর করেন। তারা রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে সেনানিবাসে বসে বাঙালি এবং জাতিগত নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কিন্তু নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গিয়ে ভুক্তভোগীদের মতামত শোনেননি বা তাদের কোনো সান্ত্বনা দেননি। আদিবাসী নাগরিক সমাজের কতিপয় ব্যক্তি একটি মতবিনিময় সভায় ছিলেন বলে জেনেছি।
“এতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ যেমনভাবে হতাশ ও মর্মাহত হয়েছিল, আমরাও দারুনভাবে বিস্মিত। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবশ্য কঠোর ভাষায় বলেছেন, এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু ভিডিও ফুটেজে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের অনেককে স্পষ্ট শনাক্ত করা গেছে, তাদের কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি।”
খাগড়াছড়ির হত্যাকাণ্ডের পরের দিনই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ওই জেলা সফর করেন। তার আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ খাগড়াছড়িতে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় কিছু অপাহাড়ি তাতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে এবং হট্টগোল করে বলে সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায় বলে বিবৃতিতে বলা হয়।
“আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি দশকের পর দশক পার্বত্য তিন জেলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ সারা দেশের আদিবাসীরা অন্যান্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী দশকের পর দশক ধরে বৈষম্যর শিকার হয়ে আসছে। মৌলিক নিরাপত্তা ও মানবিক আচরণের ক্ষেত্রেও একই ধরনের রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও অবহেলার মধ্যে দিনাতিপাত করেন। ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রেও বারবার তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিহীন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্জিত সাফল্যের সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ।”
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার সঙ্গে লুট, সরকারি ও বেসরকারি সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। এসবের উচ্চপর্যায়ের স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি সরকারের কাছে পাঁচ দাবি তুলেছে এএলআরডি।
১. খাগড়াছড়িত ও রাঙামাটিতে চার আদিবাসী হত্যাসহ সকল ঘটনার সুষ্ঠু নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, উচ্চপর্যায়ের তদন্ত করতে হবে। ভিডিও ফুটেজে চিহ্নিত, ‘দোষী’ ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. নিহত চার পাহাড়ি আদিবাসী পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যে সকল বাড়িঘর লুটপাট করা হয়েছে এবং দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদেরও যথাপোযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩. পাহাড়ে শান্তি ও সমঝোতার পরিবেশ বজায় রাখতে অপ্রকাশ্যে পাহাড়িবিরোধী কোনো বহিরাগত জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় কোনো এজেন্সি বা মহল থেকে মদদ বা সহায়তা দেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
৪. সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে একটি সময়-নির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে, যেটি বৈষম্যমুক্ত ‘নতুন বাংলাদেশের’ স্বপ্ন বাস্তবায়নে অপরিহার্য।
৫. সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড, লুট, অগ্নিসংযোগ ও অন্যান্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অবিলম্বে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সকল অংশীজন এবং দেশের উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের উচ্চপ্রতিনিধিদের নিয়ে গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করতে হবে। সেই আলোচনার সুপারিশের ভিত্তিতে স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিবৃতিতে সই করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, ‘নিজেরা করি’ এর সমন্বয়ক খুশি কবীর, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী তবারক হোসেন, নারী পক্ষের সদস্য শিরিন পারভীন হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, বেলার ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম শমি, লেখক রেহনুমা আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেরদৌস আজিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ও অধ্যাপক ড. খাইরুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক জোবায়দা নাসরিন।
এএলআরডি এর নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বি এন ডব্লিউ এল এ এর নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, লেনচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক সাদাফ নুর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিম সুলতানা, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী, গবেষক ও অধিকারকর্মী রোজিনা বেগম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যালের ড. স্বপন আদনান, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা এই বিবৃতিতে সই করেছেন।
স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আরও রয়েছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফস্টিনা পেরেইরা, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নোভা আহমেদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন এমএসএফ এর প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আশরাফ আলী ও শাহদাত আলম, নাজমুল হুদা, মো. আজিজুল্লাহ ইমন, মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন খীসা, আদিবাসী অধিকার কর্মী হানা শামস আহমেদ, সাঙ্গাতের মুক্তাশ্রী চাকমা।