সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সমাবেশ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে আট দফা দাবি তোলা হয়।
Published : 22 Sep 2024, 11:55 PM
সংবিধানে নিজেদের অনর্ভূক্তি চাওয়া পাহাড়ি আদিবাসীদের "বিচ্ছিন্নতাবাদী" আখ্যা দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
তিনি বলেছেন, “বলা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী, যারা গত ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যে নিজের স্বীকৃতি চাচ্ছে; তারা কি বিচ্ছিন্নতাবাদী? নাকি আমরা যারা তাদেরকে সংবিধানের বাইরে রাখি, স্বীকৃতি দেই না তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী?"
রোববার বিকেলে ঢাকার শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এই প্রশ্ন ছুড়ে দেন।
খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পাহাড়িদের ওপর গুলিবর্ষণ, হত্যা, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে এই সমাবেশের আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন।
বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ‘পাহাড়ি ও বাঙালিদের’ মধ্যে সংঘর্ষ থেকে স্থানীয় বাজারে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর জেরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটিতেও।
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সহিংসতায় অন্তত চারজনের মৃত্যুর খবর রয়েছে। এর জেরে পুরো পার্বত্য এলাকাতেই এখনও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চলা ঘটনাকে ‘বর্বরতা’ বলে বর্ণনা করেন রোবায়েত ফেরদৌস, বলেন এর নিন্দা জানানোর ভাষা নেই।
“আমরা দেখেছি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বাঙালিদের সঙ্গে আদিবাসী শিক্ষার্থী ভাই ও বোনেরা সমানতালে লড়াই করেছেন। এখন যখন পাহাড়ি ছেলে-মেয়েরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলছে, বিষম্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে; তখন আবার তাদেরকে নির্যাতিত হতে হচ্ছে। এ কেমন বাংলাদেশ?”
“সমতলের বাঙালি ভাই-বোনেরা বলার চেষ্টা করছে, এখন তো সব শান্তি হয়ে গেছে। এখন কেন তোমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্লোগান ব্যবহার করছ?“
“তার মানে আপনি সংকটে পাহাড়ি ছেলে-মেয়েদের ব্যবহার করছেন। আর যখন সংকট শেষ হয়ে যাচ্ছে তখন তাদেরকে বলছেন বাঙালিদের তৈরি করা স্পেস ব্যবহার করে তোমরা কেন পাহাড়ে অশান্ত করবার চেষ্টা করছ? এই যে দ্বিচারিতা এর বিরুদ্ধে আমাদের কথা বলতে হবে,” বলেন তিনি।
পাহাড়িদের সম্পর্কে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে “অপপ্রচারের’ বিরুদ্ধে কথা বলতেই দাঁড়িয়েছেন বলে মন্তব্য করে রোবায়েত বলেন, “যে পাহাড়ি আদিবাসীরা সংবিধানের স্বীকৃতি চায়, সমস্ত উন্নয়নের অংশীদার চায়; বলা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম একটা ‘খ্রিষ্টল্যান্ড’ হয়ে যাবে, আলাদা হয়ে যাবে।
“পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই ভাগ লোকও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী না। ৯৮ ভাগ খ্রিষ্টান বাইরের মানুষ। এই দুই ভাগ লোক দিয়ে কীভাবে একটা খ্রিষ্টল্যান্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে হয় এবং তাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা হয়? এই জবাব আপনাদেরকে দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, "১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা বাঙালি ছিল তারা ছিল দুই ভাগ, আর পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছিল ৯৮ ভাগ। আজকে বাঙালি আর পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ৫০-৫০ হয়ে গেছে। এরা কোন বাঙালি? কারা গেছে?”
"রংপুর-নীলফামারী থেকে, দিনাজপুর-ময়মনসিংহ থেকে বাস ভর্তি করে তাদেরকে নিয়ে যেয়ে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে বসতি স্থাপন করা হয়েছে।”
৫ অগাস্টের পর থেকে এই রাষ্ট্রকে একটি ‘মনোলিথিক রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করে অধ্যাপক রোবায়েত বলেন, “দেশটা কেবল বাঙালির, কেবল মুসলমানের, এটাকে বলা হয় মনোলিথিক রাষ্ট্র। আবার কেবল মুসলমানের না, যারা মাজারে বিশ্বাস করেন, তাদের মাজারগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
“বাংলাদেশে কেবল এক রকম মুসলমা না। এখানে বহু রকম মুসলমান আছে। কেউ মাজার মানেন, কেউ ওহাবিপন্থি আছেন। এখানে সিয়া আছে, সুন্নি আছে। এখানে লালনপন্থি আছেন, এখানে বাউলপন্থি আছে। নানা রকম মুসলমানের সমষ্টি আছে। সবগুলাকে বাদ দিয়ে সালাফিস্ট-ওহাবিস্ট ইসলাম কায়েম করার চেষ্টা বাংলাদেশকে মনোলিথিক রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে তা বিচ্যুতি।”
"৮০০ বছর আগে এ অঞ্চলে যারা হিন্দু ছিলেন, বৌদ্ধ ছিলেন, আদিবাসীদের ধর্ম ছিল; তাদেরকে কে মুসলমান বানিয়েছে? হজরত শাহজালাল, হজরত শাহপরাণ, সুফিরা ইয়েমেন থেকে এসেছেন, তুরস্ক থেকে আসছেন। তারা এখানে এসে মানুষকে ধর্মান্তরিত করে বাংলাদেশকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ করেছে। সেইসব পীরদেরকে, সেইসব সুফিদেরকে অসম্মান করা হচ্ছে। তাদের মাজারগুলো ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। তাদেরকে অপমানিত করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা বলতে চাই বাংলাদেশ কেবল বাঙালির না। বাংলাদেশ কেবল ওহাবি মুসলমানের না। বাংলাদেশ বহু জাতির, বহু ধর্মের, বহু ভাষার এবং সংস্কৃতির একটা বৈচিত্র্যপূর্ণ রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনার যে বহুত্ববাদী নীতি, এটাই বিউটি অব ডেমোক্রেসি।
"এটা আমাদের সংবিধানে রিফ্লেক্টেড হতে হবে। আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে রিফ্লেক্টেড হতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে, আমরা চারজন আদিবাসী ভাই-বোনকে হারিয়েছি। জীবনের কোন ক্ষতিপূরণ হয় না। কিন্তু আমরা মনে করি এই ক্ষতিপূরণ হতে পারে তদন্তের মধ্য দিয়ে; এর সুষ্ঠু বিচারের মধ্য দিয়ে।”
“আর যেন এ রকম নির্মম জাতিগত দাঙ্গার শিকার পাহাড়ে হতে না হয়, সেই প্রতিশ্রুতি এই সরকারকে দিতে হবে। নইলে এই পাহাড়-সমতল সর্বত্র আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলব,” বলেন এই অধ্যাপক।
বাংলাদেশ জাসদ এর সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ নাজমুল হক প্রধান বলেন, "আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা সংখ্যালঘুরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। আমাদের যেসব ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার জনগোষ্ঠী আছে, তারা আমাদের বাংলাদেশের শরীরে তীলকের মত, তারা আমাদের অলঙ্কার। তাদের রক্ষা করা, যত্ন করা এবং আগলে রাখা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দায়িত্ব।”
“১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করা হয়নি। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ভিন্ন দেশের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে আমাদের পক্ষ থেকে আমরা হুঙ্কার দিচ্ছি; এ রকম বক্তব্য দিয়ে পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করবেন না।”
“আমাদের জন্য একটাই রাস্তা খোলা- আমরা বারবার আলোচনা করব, সংলাপ করব এবং যে চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব,” বলেন তিনি।
বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, “খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটিতে সংঘটিত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। পাহাড়ের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।”
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি শাহ আলম বলেন, একটি মোটরসাইকেল চোরের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তৈরি করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর যখন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মূল্যায়ন করা হয়নি তখন থেকে পাহাড়ে অশান্তির শুরু হয়েছে।
“পার্বত্য চট্টগ্রামের চারপাশে যে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন হচ্ছে, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে চুক্তির বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি।”
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন এবং যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী।
এ সময় সমাবেশ থেকে আট দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হল-
১। অনতিবিলম্বে সংঘটিত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে;
২। মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালা হামলার জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
৩। খাগড়াছড়ি সদর, দিঘীনালা ও রাঙামাটিতে সহিংসতার শিকার পাহাড়ি অধিবাসীসহ তিন পার্বত্যজেলার জুম্ম জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪। গুলিতে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারবকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের সুচিকিৎসা প্রদানের অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫। জুম্ম জনগোষ্ঠীর ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ বিহার পুনর্নির্মাণ এবং দোকানপাট ও বাড়িঘরের মালিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৬। দায়িত্বরত বিভিন্ন সংস্থা ও মহলের যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার জন্য সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় বিভাগীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৭। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে যতদ্রুত সম্ভব পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সংলাপ শুরু করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং
৮। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে হবে।