সিদ্দিক বাজারে বিধ্বস্ত ভবনের দুই মালিকসহ গ্রেপ্তার ৩

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশিদ বলেন, “এতবড় একটি দুর্ঘটনার দায় ভবনের মালিকসহ সংশ্লিষ্ট কেউ এড়াতে পারে না।”

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2023, 09:29 AM
Updated : 9 March 2023, 09:29 AM

পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে যে ভবনটিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেই ভবনের মালিক দুই ভাইসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

ওই তিনজন হলেন ভবনটির মূল মালিক মরহুম হাজী মোহাম্মদ রেজাউর রহমানের দুই ছেলে মো. ওয়াহিদুর রহমান (৪৬) ও মতিউর রহমান (৩৫) এবং ওই ভবনের একটি স্যানিটারি দোকানের মালিক আ. মোতালেব মিন্টু (৩৬)।

তাদের গ্রেপ্তারের কারণ জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতবড় একটি দুর্ঘটনার দায় ভবনের মালিকসহ সংশ্লিষ্ট কেউ এড়াতে পারে না।

"ভবনটিতে কোনো সংস্কার হত না, পয়ঃনিস্কাশন নিয়মিত তদারকি হত না, পার্কিং এলাকায় গুদাম ভাড়া দেওয়ার নিষেধ থাকার পরেও দেওয়া হয়েছে, ব্যবসায়ীরা জেনেও নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সংস্থার তদারকিরও অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।"

এসব কারণে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে হারুন বলেন, আরো কারো সংশ্লিষ্টতা পেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

সিদ্দিক বাজারের ক্যাফে কুইন নামে পরিচিত ওই ভবনে মঙ্গলবার বিকালে বড় ধরনের বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ, তাদের মধ্যে ২৭ জন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। 

সাততলা এই বাণিজ্যিক ভবনটির মালিক ছিলেন রেজাউর রহমান। এক সময় তিনি ক্যাফে কুইন নামে একটি রেস্তোরাঁ খুলেছিলেন এই ভবনে, সেজন্য স্থানীয়রা ভবনটি ক্যাফে কুইন বিল্ডিং নামে চেনে।

রেজাউর অনেক দিন আগে মারা গেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর এখন তার তিন ছেলে এর মালিক। মশিউর রহমান নামে এক ছেলে দেশের বাইরে থাকেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ওয়াহিদুর এবং সবার ছোট মতিউর ঢাকায় থাকেন। তারাই ভবনের দেখাশোনা করেন।

বিস্ফোরণের পরদিন বুধবার দুই ভাই ওয়াহিদুর ও মতিউরকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মো. জাফর হোসেন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, রাজউক, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করছে বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি।

“তারা যদি প্রতিবেদন দেয় ভবনটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল, ভবন মালিকদের গাফিলতিতে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে যে অপমৃত্যু মামলা হয়েছে, সেই মামলাটিতে ধারা পরিবর্তন হবে।”

এরপর বৃহস্পতিবার ওয়াহিদুর ও মতিউরের সঙ্গে ব্যবসায়ী মিন্টুকেও গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয় পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

নাশকতার আলামত মেলেনি

পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বলছে, ভবন মালিক রেজাউর রহমান ১০ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কেবল বেইজমেন্ট ও প্রথমতলার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। ২০০৪ সালে ভবনটিকে ৭ তলায় উন্নীত করা হয়। ২০১১ সালে রেজাউরের মৃত্যুর পর ভবনটির মালিকানা পান তার তিন ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রী।

ভবনের সেপটিক ট্যাংক কোথায় অবস্থিত সে বিষয়ে বর্তমান মালিকরা নিশ্চিত নয়। তবে পুলিশকে তারা বলেছেন, উত্তর পাশের ভবনের সাথে ক্যাফে কুইনের যে ফুট তিনেকের সরু গলি আছে, সেখানেই দুই ভবনের সেপটিক ট্যাংক আছে তাদের ধারণা।

বিস্ফোরণে সেপটিক ট্যাংকের পাশের দেওয়ালগুলো সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ বলেছে, “পয়োবর্জ্য পদার্থের বায়োগ্যাসের বিস্ফোরণে এমনটি হতে পারে।”

ভবনের বেইজমেন্ট সম্পর্কে পুলিশ জানিয়েছে, পার্কিংয়ের কথা থাকলেও সেখানে একসময় রান্নাঘর ছিল। সবশেষ সেখানে ‘বাংলাদেশ স্যানিটারি’ নামে একটি দোকানের কার্যক্রম চলছিল। প্রায় ১৮০০ স্কয়ার ফিটের এ আন্ডারগ্রাউন্ড পুরোটাই গ্লাসে ঘেরা, যা ঠাণ্ডা রাখতে ব্যবহার হতো বড় দুটি এসি। পাশাপাশি সেখানেই আছে পানির একটি বড় ট্যাংক।

কুইন ক্যাফে ভবনটি বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং সিসি ক্যামেরার নজরদারি থাকায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে পরিমাণ বিস্ফোরক প্রয়োজন তা সবার অজান্তে সেখানে জমা রাখা ‘প্রায় অসম্ভব’ বলে মনে করছে পুলিশ।

এ বাহিনীর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বেইজমেন্ট কার পার্কিংয়ে ব্যবহৃত হলে বায়ু চলাচল হত। তাতে গ্যাস জমা হত না, সেক্ষেত্রে বিস্ফোরণ হত না।

পুলিশ এও মনে করছে, পয়োবর্জ্য যেখানে জমা হয়, দীর্ঘ সময় সেই জায়গা পরিষ্কার না করায় বায়োগ্যাস জমতে পারে; যা বিভিন্ন কারণে বিস্ফোরিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতির কারণ ঘটাতে পারে।

বেইজমেন্টের একসময়ের রান্নাঘর বন্ধ করা হলেও ভবনের অন্যান্য তলার গ্যাস লাইন চালু থাকায় সম্ভাব্য আরেক কারণ হিসেবে গ্যাস লিকেজের কথা বলছে পুলিশ।

“এই (গ্যাস) লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনোভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণ হতে পারে।”

এসি থেকেও যে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হতে পারে তাও মনে করিয়ে দিয়েছে পুলিশ।

“এই ভবনটির আন্ডারগ্রাউন্ড বা বেইজমেন্টে বড় একটি স্যানেটারি দোকান, নিচ তলায় ৫টি দোকান, দোতলাতে সেক্রেটারি এবং কাপড়ের দুটি দোকান ছিল, যেগুলোর জন্য অনেক কাঁচ এবং ইন্টেরিয়রের কাজ করা হয় এবং পাওয়ারফুল এসি ব্যবহার করা হয়। এসিগুলোকে সময়ে সময়ে সার্ভিসিং না করালে বা ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে, যেমনটা ২/৩ বছর আগে গুলশানে আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারে ঘটেছিল।”

সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত সেখানে বিস্ফোরক বা নাশকতার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে পুলিশ বলছে, বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ জানতে ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ডিএমপির সিটিটিসি'র বোম্ব ডিসপোজাল টিম আলাদা আলাদা ভাবে তদন্ত করছে।

“বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে রিপোর্ট দেবেন, তাতেই প্রকৃত কারণটি জানা যাবে।”