ভবনটি আপাতত ব্যবহার করা যাবে না বলে রাজউকের কারিগরি কমিটি মত জানিয়েছে।
Published : 08 Mar 2023, 10:38 PM
পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের পর নাজুক অবস্থায় থাকা ভবনটি পরিদর্শন করেছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।
চার দশক আগে নির্মিত এই ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে সংস্কারে কোনো অনিয়ম ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি হচ্ছে। বিধ্বস্ত ভবনটি নিয়ে কী করা হবে, সেই করণীয় নির্ধারণে আরেকটি কমিটি হয়েছে।
রাজউকের পরিচালক (জোন-৫) মো. হামিদুল ইসলাম বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর এই তথ্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
বুধবার সরকারি ছুটি থাকায় ভবনটি সংক্রান্ত নথিপত্র এখনও দেখতে পাননি রাজউক কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার সকালে ভবনটি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়ার আশা করছেন হামিদুল।
নর্থ সাউথ রোডে বিআরটিসির ফুলবাড়িয়া টার্মিনাল থেকে শ খানেক গজ দক্ষিণে সাত তলা ‘ক্যাফে কুইন’ ভবন। বাণিজ্যিক এই ভবনের বিভিন্ন তলায় স্যানিটারি সামগ্রীর দোকান ও গুদাম, নানা রকম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ছিল। উপরে ছিল আবাসিক ফ্ল্যাটও।
মঙ্গলবার বিকালে বিকট বিস্ফোরণ ঘটে ভবনটিতে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় ভবন থেকে ইট-কনক্রিট থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামগ্রী, এমনকি মানুষও ছুটে এসে পড়ে সড়কে। ভবনটির নিচ তলা ও দ্বিতীয় তলার ফ্লোর ধসে পড়ে।
ভয়াবহ এই বিস্ফোরণের কারণ এখনও জানা যায়নি। তিন দিনের মধ্যে ঢাকার দুটি ভবনে একই ধরনের বিস্ফোরণে নাশকতার সন্দেহ করছেন কেউ কেউ। তবে তেমন কোনো আলামত মেলেনি বলে পুলিশ জানিয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে।
মঙ্গলবার বিস্ফোরণের পর ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। বুধবার দ্বিতীয় দিনের অভিযানে ধ্বংসস্তূপের নিচে মেলে আরও দুটি লাশ। এখনও একজন নিখোঁজ আছেন জেনে তাকে উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের কাজ চলছে।
সাততলা এই বাণিজ্যিক ভবনটির মালিক ছিলেন রেজাউর রহমান। এক সময় তিনি ক্যাফে কুইন নামে একটি রেস্তোরাঁ খুলেছিলেন এই ভবনে, সেজন্য স্থানীয়রা ভবনটি ক্যাফে কুইন বিল্ডিং নামে চেনে।
রেজাউর অনেক দিন আগে মারা গেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর এখন তার তিন ছেলে এর মালিক। মশিউর রহমান নামে এক ছেলে দেশের বাইরে থাকেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ওয়াহিদুর রহমান এবং সবার ছোট মতিউর রহমান ঢাকায় থাকেন। তারাই ভবনের দেখাশোনা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় সিদ্দিক বাজারের বিস্ফোরণ
সিদ্দিক বাজারের বিস্ফোরণ ‘দুর্ঘটনা’ মনে করছেন ফায়ার সার্ভিস ডিজি
ক্যাফে কুইন ভবন তিন তলা থেকে কীভাবে ৭ তলা, জানেন না রাজউক পরিচালক
ভাঙতে হবে? নাকি টিকিয়ে রাখা যাবে?
ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায় আংশিক বিধ্বস্ত এই ভবন এখন কী করা হবে, তা নিয়ে রয়েছে জিজ্ঞাসা।
রাজউকের পরিচালক হামিদুল বুধবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা গতরাত থেকে ঘটনাস্থলে ছিলাম। আজও গিয়েছি। এ বিল্ডিংটা ছিল আশির দশকের। ৪০-৪৫ বছরের পুরনো বলা যায়।”
পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা এবং বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ জানতে দুটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
রাজউকের পরিচালক বলেন, “আমরা আশা করি, তদন্ত কমিটি পেয়ে যাব। রাজউকের একজন পরিচালকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি হতে পারে। এতে রাজউকের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা রাখা হবে।
“আরেকটা কমিটি হতে পারে-এ ঘটনার পর কী করা যায়, সে বিষয়ে সুপারিশ করবে। এ ভবন কি ভেঙে ফেলা হবে, নাকি অন্য কিছু করতে হবে-বুয়েটের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধ্যাপকসহ বিশেষজ্ঞরা তাতে থাকবেন।”
তার সঙ্গে কথা বলার পর রাজউক থেকে ছয় সদস্যের কারিগরি কমিটি গঠনের অফিস আদেশ আসে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) অবসরপ্রাপ্ত মেজর সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরীকে।
কমিটিতে সদস্য রয়েছেন বুয়েটের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমদ আনসারী ও অধ্যাপক রাকিব আহসান, ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান, রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের প্রধান আবদুল লতিফ হেলালী। কমিটির সদস্য সচিব রাজউক কর্মকর্তা রংগন মণ্ডল।
ভবনটির ব্যবহার উপযোগিতা বিষয়ে সুপারিশ দিতে কমিটিকে দুই কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কারিগরি কমিটির সদস্যরা রাত ৯টার দিকে ভবনটি পরিদর্শনে যান। তারা ফায়ার সার্ভিসের মইয়ের মাধ্যমে ভেতরে ঢুকে ক্ষতির মাত্রা বোঝার চেষ্টা করেন।
পরে বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটির দ্বিতীয় তলা থেকে উপরের অংশ ঠিক আছে। নিচে থাকা ২৪টি কলামের (খুঁটি) মধ্যে নয়টি কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যান্য বিমগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কলামগুলো যে ভার নিতে পারত, সেই ভার এখন অন্য কলামগুলোর উপর পড়ছে।
তিনি বলেন, “যেহেতু নিচে থাকা নয়টি কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণেই সেগুলোকে পুনরায় সংস্কার বা রেট্রোফিটিং করতে হবে কি না, নিচতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না, ভবনটি ভাঙতে হবে কি না, এসবের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সময় প্রয়োজন।”
এ ধরনের কাজ করতে দুই-তিন মাস সময় লাগে জানিয়ে তিনি বলেন, “রেট্রোফিটিং কাজ শুরু করার আগে কলামগুলোকে স্ট্যাবল করতে হবে। স্ট্যাবল করার পর বোঝা যাবে নয়টি কলাম রেট্রোফিটিং করার পর ভবনটি টিকবে কি না?
“এক থেকে দুই মাস বিল্ডিংয়ের মাটি পরীক্ষা করবেন। ভবনের প্রত্যেকটা বিম-কলাম চেক করবেন। মাটির কোয়ালিটি কালেকশন করবেন এবং রডের কোয়ালিটি দেখবেন। আসলে ইনিশিয়াল অ্যাসেসমেন্ট করতে দুই মাস লাগবে এবং রেট্রোফিটিং করতে আরও সময় লাগবে।”
এই কাজটি কোনো কোম্পানিকে দিয়ে করানোর পক্ষে মত দিয়ে অধ্যাপক মেহেদী বলেন, সিটি কর্পোরেশন ও রাজউকের জনবল থাকলেও সেই সক্ষমতা নেই। এ কারণে তৃতীয় পক্ষ নিয়োগ করতে হবে। তারা গবেষণা করবে এবং নানা বিষয়ে যাচাই করে কাজ করবে।
বুয়েটের অধ্যাপক রাকিব আহসান বলেন, “এটা মাথায় রাখতে হবে, ভবনটি খুব বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনটি এখন সামনের রাস্তার জন্য ঝুঁকি আশপাশের ভবনের জন্যও ঝুঁকি।”
ভবনটি আপাতত ব্যবহার করা যাবে না বলে কারিগরি কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন।
সাততলা এই ভবনের দুই পাশে আছে আরও দুটি বহুতল ভবন। দক্ষিণ পাশের এর গা ঘেঁষেই আরেকটি সাততলা ভবন। উত্তর পাশের পাঁচতলা ভবনের সঙ্গে দুই ফুট কাঁক রয়েছে।
বিস্ফোরণে ক্যাফে কুইন ভবনের নিচতলার উত্তরপাশের সালু এন্টারপ্রাইজ ও দক্ষিণের ভবনের নিচতলার বাদশা ট্রেডিং সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অনিয়ম আছে কি?
পুরনো এই ভবন নির্মাণ কিংবা সংস্কারে অনিয়ম ছিল কি না, বিস্ফোরণের পর সেই প্রশ্ন আসছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ভবনটি শুরুতে ছিল তিন তলা। পরে আরও চার তলা বাড়ানো হয়।
ভবনের বেইজমেন্টে ছিল গুদাম, একতলা ও দোতলায় স্যানিটারির দোকান, তৃতীয় তলায় ‘সুজুতি এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় ভবন মালিকের দুই ছেলে ও পরিবার থাকত। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় থাকত ভাড়াটিয়ারা।
ভবনটিতে কোনো অনিয়ম ছিল কি না, তা নিয়ে রাজউক কর্মকর্তা হামিদুল বলেন, “নথি না দেখলে আমরা কিছু বলতে পারছি না। নথি সংরক্ষণ কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে, দ্রুত পেয়ে যাব।”
এদিকে রাতে পরিদর্শনের পর কারিগরি কমিটির আহ্বায়ক রাজউক সদস্য সামসুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “ভবনটি ১৯৮০ সালের পর হতে পারে। তবে নথিপত্র ঘেঁটে আমরা এটা পাইনি। এটা যেহেতু অনেক পুরনো ভবন, তখন রাজউকও ছিল না।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নকশা বহির্ভূতভাবে ভবনটি তৈরি করা হলে ‘অবশ্যই’ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভবন নিয়ম মেনে করা হয়েছে কি না, তা বিভিন্ন সময় তদারকি হয়েছে বলে দাবি করেন রাজউক পরিচালক হামিদুল।
ভবন ধসের মৃত্যুর ঘটনায় এরই মধ্যে একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে পুলিশ। ভবনের দুই মালিক ওয়াহিদুর ও মতিউরকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে।
ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মো.জাফর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, রাজউক, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করছে বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।
“তারা যদি প্রতিবেদন দেয় ভবনটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল, ভবন মালিকদের গাফিলতিতে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে যে অপমৃত্যু মামলা হয়েছে, সেই মামলাটিতে ধারা পরিবর্তন হবে।”