পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি অলি-গলিতে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসার বিষয়টি বারবার সামনে আসে বড় অগ্নিকাণ্ডের পর।
Published : 09 Mar 2023, 12:17 AM
পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারের যে ভবনে মঙ্গলবার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার পেছনেই সরু গলির ভেতর ঘিঞ্জি আবাসিক এলাকা। একদিন পর বিকালে সেখানে মোড়ের দোকানে পুরি, বেগুনি, চপ খেতে খেতে স্থানীয়রা আলাপ করছিলেন ‘নিমতলী’ আর ‘চুড়িহাট্টা’ নিয়ে।
পুরান ঢাকারই নিমতলী আর চুড়িহাট্টায় শত প্রাণহানির ট্রাজেডি মুখস্থ তাদের, তবে নিজেরাও যে একই ঝুঁকিতে, তা মানতে নারাজ এখানকার ব্যবসায়ীরা। আর বছরে পর বছর ধরে দায় এড়িয়ে থাকছে এসব দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলোও।
সিদ্দিক বাজার থেকে নিমতলীর দূরত্ব ছয় কিলোমিটারও নয়। আরেকটু গেলে চকবাজারের চুড়িহাট্টা। এই পুরো এলাকাটাই ঘিঞ্জি, সড়কগুলোর বেশিরভাগই সরু গলি, ভবনগুলো গায়ে গা লাগানো। এর মধ্যেই গড়ে উঠেছে পাইকারি সব ব্যবসা কেন্দ্র, যেখানে দিনে লেনদেন কোটি কোটি টাকার।
২০১০ সালে নিমতলীর রাসায়নিক গুদাম থেকে লাগা আগুনে প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ। এরপর আরও অনেক ছোটখাট আগুন দেখেছে এলাকার মানুষ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবার বড় আগুন দেখতে হয় চকবাজারের চুড়িহাট্টায়, প্রাণ হারান ৭০ জন।
চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ড: ৭১ মৃত্যুর জন্য ৮ জনের দায় পেয়েছে পুলিশ
সিদ্দিক বাজারের ভবনটির এখন কী হবে?
সর্বশেষ মঙ্গলবার সিদ্দিক বাজারে ক্যাফে কুইন ভবনের বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল পুরো এলাকা, তবে তা স্থানীয়দের টনকে কাঁপন ধরাতে পেরেছে কি? নিমতলীর আগুনের পর পুরান ঢাকার রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার যে পরিকল্পনা ও উদ্যোগ শুরু হয়েছিল, তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
সিদ্দিক বাজারের যে ভবনটিতে মঙ্গলবার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার পেছনেই লম্বা সরু গলি। ভেতরে গায়ে গা লাগানো ভবন। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনেও এখানে আধো অন্ধকার। গলির মধ্যে রবারের তীব্র গন্ধ, চারদিকে স্যান্ডেলের পাইকারি দোকান ও গুদাম।
পুরান ঢাকার অন্য এলাকাগুলোর মতো এখানেও দোকান ও গুদামগুলো সব আবাসিক ভবনের নিচতলা বা অন্যান্য তলায়। গলি ধরে ভেতরে একটু এগোলে মোড়ে পুরি-বেগুনি-চপের দোকান। বিস্ফোরণের পর এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় বিকালের নাস্তার জন্য অনেকেরই ভিড় সেই দোকানে। তাদের আলাপের বিষয়বস্তু ভবনের বিস্ফোরণ।
নিমতলী আর চুড়িহাট্টার সঙ্গে তুলনা করে নিজেদের ‘ভাগ্যবান’ ভেবে একজন বলে উঠলেন, “ভাগ্যিস আগুন লাগে নাইক্কা, লাগলে খবর আছিল।”
আপনাদের তো কোনো প্রস্তুতি নেই, আগুন লাগলে কী করবেন- জানতে চাইলে মো. আলতাফ নামের ওই ব্যবসায়ী বলেন, “আমাগো এইহানে তো কোনো কেমিকেল নাই। সব স্যান্ডেল আর স্যানিটারির মার্কেট।”
এই ব্যবসায়ীরা জানালেন, ক্যাফে কুইন ভবনের পেছনের দিকে লাগোয়া ভবনটির একটি জুতার মার্কেটও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই ভবন লাগোয়া সরু গলিতে থাকা একটি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস, একটি চায়ের দোকানে বসে থাকা ব্যক্তিরাও হতাহত হন।
বিস্ফোরণের পর ও শবেবরাতের ছুটির কারণে ব্যবসাকেন্দ্রগুলো বুধবার বন্ধ ছিল। আশপাশের গলিগুলোতে তাই অনেককে গল্প-গুজব করতে দেখা গেল।
স্থানীয় দোকানকর্মী জাফর আহমেদ অনেক বছর ধরে এই এলাকায়। তিনি বলছেন, কুইন ভবনটির ঠিক পেছন লাগোয়া ভবনটি আলী আশরাফের বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত। এই ভবনের নিচতলায় জুতার মার্কেট। বিস্ফোরণের এই মার্কেটের ‘মাহজাবিন সুজ’ নামে জুতার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দোকানটির পেছনের দেয়াল ভেঙে ভেতরে চলে আসে।
বিস্ফোরণস্থল কুইন ভবনের উত্তর পাশের ভবনের (যে ভবনে ব্র্যাক বা্যাংক) পেছন লাগোয়া আরেকটি ভবন রয়েছে। এটির মালিক ‘আকবর সাব’। এই ভবনে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস। বিস্ফোরণে এই সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসটি প্রায় উড়ে যায়। এখানে অনেকে হতাহত হয়েছেন।
সেখানে সরু গলির মুখে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ভবনের কোনায় চায়ের দোকান চালাতেন মিজানুর রহমান। দোকান থেকে ৩০ গজ দূরেই মিজানুরের বাসা। স্থানীয় একজন সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন সেই বাসায়।
একটি ভবনের চারতলার ছাদে একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন মিজানুর। খুব বেশি হলে এক কাঠা জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ভবনটি। একটি করে ঘর আর লাগোয়া রান্নাঘর, বাথরুম রয়েছে প্রতি তলায়। এর ভবনের খাড়া সিঁড়ি যেন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহা। সিঁড়ির প্রস্থ দুই ফুটের কিছু কম। দুজন মানুষ মুখোমুখি হলে পাশ কাটাতে কষ্ট হয়। সিঁড়ির প্রতি ল্যান্ডিংয়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে জুতার বাক্স। স্থানীয়রা বলছেন, এখানকার ভবনগুলো এরকমই। সবাই এভাবে থেকেই অভ্যস্থ।
মিজানুর বাসাতেই ছিলেন। জানালেন, মঙ্গলবার বিস্ফোরণের সময় দোকান খোলা ছিল। “আমি দোকানে আছিলাম। দোকানের সামনে দুইজন সিগারেট খাইতাছিল। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ। সব কাইপা উঠল। আমি দেহি দোকানের সামনে টেবিলও নাই, দুই কাস্টমারও নাই, উইড়া গ্যাছে। চিপা থিকা সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের লোকজন দৌড় দিয়া এইদিকে আইয়া কয় ‘আমাগো বাঁচান।’ হ্যাগো কারও মাথা দিয়া রক্ত বাইরাইতাছে, কারও হাত-ঠ্যাং নাই। আমি কয়জনরে বাইর করছি। এরপর আমার নিজেরই হুঁশ নাই। লোকজন আমারে বাসায় আইনা দিছে।”
সরু সেই গলির ভেতর ছোট্ট চায়ের দোকানের জন্য মিজানুরকে প্রতি মাসে ৮ হাজার টাকা ভাড়া গুণতে হয়। আনুমানিক তিনশ’ বর্গফুটের বাসাটির ভাড়াও ৮ হাজার টাকা।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, ব্যবসাপ্রধান এই এলাকায় জায়গার সংকট প্রবল। যে কারণে কোনো এক ফাঁকা দিয়ে কয়েক হাত জায়গা বের করতে পারলেই বাড়ির মালিকেরা সেগুলো দোকান হিসেবে ভাড়া দেন।
পাশের আরেকটি বাড়িতে ঢোকার মুখেই জুতার দোকান। সরু সিঁড়ির নিচে চলছে পেট্রোল ইঞ্জিনের জেনারেটর। ভবনের ভেতরে পেট্রোল ইঞ্জিনের ঝাঁঝালো গন্ধ।
নূর মোহাম্মদ নামের সেখানকার একজন বাসিন্দা বললেন, “অ্যামনে থাইকা আমাগো অভ্যাস হয়া গেছে। কী করবেন? এইহানেই রুটি-রুজি রাখছে আল্লায়।”
পরিস্থিতি এমন নাজুক হলেও এই ঘিঞ্জি এলাকায় একটি ব্যবসা স্থাপনের খরচ মোটেও কম নয়। ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ জানালেন, কয়েকদিন আগে তার পরিচিত একজন আনুমানিক দেড়শ’ বর্গফুটের একটি দোকানের ‘পজেশন’ কিনেছেন ৮০ লাখ টাকায়। এরপরও মাসে মাসে ভবনের মালিককে জমির ভাড়া হিসেবে ৩ হাজার করে টাকা দিতে হয়। ওই দোকানে বিনিয়োগ আরও ৫০ লাখ টাকা।
ওই ব্যবসায়ী বললেন, দোকানে বেচা-বিক্রিও খারাপ না। পুরান ঢাকারই লালবাগ, ইসলাম এলাকার জুতার কারখানাগুলোতে তৈরি হওয়ার রবারের স্যান্ডেল এখানে পাইকারি বিক্রি হয়। আর কিছু ব্যবসায়ী চীন থেকেও আমদানি করেন।
এখানকার ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ ও নোয়াখালীর। আর ক্রেতা মূলত দক্ষিণবঙ্গের খুচরো ব্যবসায়ীরা। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের খুচরা ব্যবসায়ীরা এখান থেকে স্যান্ডেল কিনে নিয়ে যান। কুরিয়ার সার্ভিসেই দিনে লাখ লাখ টাকার মাল বুকিং হয়। সেই কারণেই সেখানে সুন্দরবন কুরিয়ারের অফিস।
সিদ্দিকবাজারসহ আশপাশের পাইকারি জুতার মার্কেটগুলোতে প্রতিদিন ‘শত কোটি টাকার’ ব্যবসা হয় বলে অনুমান এই ব্যবসায়ীর।
এত কোটি টাকার ব্যবসা হলেও এখানকার ব্যবসায়ীরা দূর্ঘটনা বা আপদকালীন পরিস্থিতিতে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য কোনো পদক্ষেপ দেখা গেল না।
শিহাব নামে এক তরুণ উল্টো যুক্তি দিলেন, “ক্যান গুলশান-বনানীতে আগুন লাগে না? কয়দিন আগে গুলশানের বড়লোক বিল্ডিংয়ে আগুন দেহেননি আপনারা? বনানীর বিল্ডিংয়ে আগুন লাগচে, মাইনষে লাফ দিয়া দিয়া পড়লো? খালি কন পুরান ঢাকা ঝুঁকিপূর্ণ।”
নগর পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঘিঞ্জি পুরান ঢাকায় বিস্ফোরণের ঝুঁকিটি বেশি।
“ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় পুরান ঢাকায় ঝুঁকি অনেক বেশি। সেখানে পুরোনো ইউটিলিটি সার্ভিস, তার সঙ্গে মিশ্র ধরনের এমন সব পণ্যের গুদাম আছে। দাহ্য, বিপজ্জনক পদার্থ সেখানে গুদামজাত করা হয়। রাস্তাঘাটও সরু, একবার কোনো ঘটনা ঘটলে উদ্ধার চালানোও কঠিন।”
গত ২২ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেছিলেন, চুড়িহাট্টার আগুনের পর ফায়ার সার্ভিস থেকে কোনো কারখানা স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না ওই এলাকায়।
ফলে ওইসব এলাকায় সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তা ঠেকাতে কোনো সংস্থারই পদক্ষেপ নেই।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি দপ্তরগুলো পুরান ঢাকা নিয়ে নিজেদের দায় এড়িয়ে গেছে নানাভাবে। চেষ্টা থাকলে যে পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব, তার প্রমাণ বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো। রানা প্লাজা ধসের পর দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর চাপে গত ১০ বছরে পোশাক খাতে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা কমে এসেছে।
পোশাক খাতের শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর গত ১০ বছরে পোশাক খাতে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ‘দৃশ্যমান অগ্রগতি’ হয়েছে।
তিনি বলেন, “ইউরোপের পোশাক ক্রেতাদের জোট ‘অ্যাকর্ড’র অধীনে প্রায় ১৬০০ কারখানায় পরিবর্তন এসেছে। অগ্নিঝুঁকি এড়াতে কারখানা ভবনের কাঠামোতে পরিবর্তন করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জামগুলোতে পরিবর্তন এসেছে।
“এখন দেখবেন কারখানায় আগুন লাগলেও শ্রমিকের প্রাণহানি হওয়ার মতো অবস্থা আর নেই। কারখানাগুলোতে নিয়মিত অগ্নি নির্বাপন মহড়া হয়। শ্রমিকেরাও জেনে গেছেন বিপদের সময় কী করে নিজেকে রক্ষা করতে হবে।”