পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে সোনালী আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন যিনি, সেই বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম আর নেই।
Published : 21 Dec 2014, 08:28 AM
তার ছোট ভাই জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতলের পরিচালক মাহবুবুল আলম জানান, বাংলাদেশ সময় রোববার ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের কুইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাকসুদুলের মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
মাকসুদুল লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। শেষ দিকে লিভারের সঙ্গে তার ফুসফুসও ঠিকমতো কাজ করছিল না।
ম্যানোয়ার ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের অধীনে কলেজ অব ন্যাচারাল সায়েন্সেসে জিনোমিক্স, প্রোটিওমিক্স ও বায়োইনফরমেটিকস বিভাগের পরিচালক পদে কাজ করে আসছিলেন তিনি।
শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী হাওয়াই মেমোরিয়াল পার্ক সিমেট্রিতে মাকসুদুলকে দাফন করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
মাকসুদুল আলমের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় ২০১০ সালে তরুণ একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে তোষা পাটের জিন নকশা উন্মোচন করে আলোচনায় আসেন মাকসুদুল আলম। ওই বছর ১৬ জুন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দেশবাসীকে সেই সুখবর জানান প্রধানমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও খবরটি গুরুত্ব পায়।
মাকসুদুল ও তার সহকর্মীদের পরের সাফল্যের খবরটিও আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়েই। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি জানান, মাকসুদুল ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের এক ছত্রাকের জিন-নকশা উন্মোচন করেছেন, যা পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়।
গতবছর ১৮ অগাস্ট মাকসুদুলকে পাশে নিয়েই বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আরেকটি বড় সাফল্যের খর জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার আসে দেশি পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের খবর।
জিনোম হলো প্রাণী বা উদ্ভিদের জিনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এই নকশার ওপরই নির্ভর করবে ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট। গবেষণাগারে এই জিনবিন্যাস অদল বদল করে উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবন সম্ভব।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী পাটের নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পাটের গুণগত মান ও উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব।
আর নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলে পাট পচাতে কম লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব জ্বালানি ও ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে।
এর আগে ২০০৮ সালে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পেঁপে এবং মালয়েশিয়া সরকারের হয়ে রবার গাছের জীবনরহস্য উন্মোচনেও নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের এই গবেষক।
পেঁপে নিয়ে তার কাজের খবর বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়। ওই প্রতিবেদনে মাকসুদুলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ‘বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক’ হিসাবে।
১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া মাকসুদুল আলমের বাবা দলিলউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (বর্তমান বিজিবি) একজন কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন তিনি।
স্বামীকে হারিয়ে চার ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে কঠিন সংগ্রামে পড়তে হয় মাকসুদুলের মা লিরিয়ান আহমেদকে। তবে তার চেষ্টায় ছেলেমেয়েরা পরে যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মাকসুদুল রাশিয়া চলে যান। ১৯৭৯ সালে মস্কো স্টেইট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান।
১৯৮২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন মাকসুদুল। এর পাঁচ বছর পর জার্মানির ম্যাক্স-প্লাংক ইনস্টিটিউট অব বায়োকেমিস্ট্রি থেকে প্রাণরসায়নেও তিনি পিএইচডি করেন।
ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ে যোগ দেওয়ার আগে মস্কো স্টেইট ইউনিভার্সিটি, রাশিয়ার বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি, ম্যাক্স-প্লাংক ইনস্টিটিউট এবং ওয়াশিংটন স্টেইট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
অণুপ্রাণবিজ্ঞানের গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে এনআইএইচ শ্যানান অ্যাওয়ার্ড পান মাকসুদুল।
২০০১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোর্ড অব রিজেন্টস এক্সেলেন্স অব রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।