আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে চারজনকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানাচ্ছেন র্যাব কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, চাঞ্চল্যকর এ জোড়া খুনের সঙ্গে জড়িয়েছে ঢাকা ও দুবাইয়ের অপরাধজগতও। টিপুকে খুন করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা অপরাধজগতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন; বাজেট ছিল ১৫ লাখ। রাজনীতি ও অপরাধজগতের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঢাকা ও দুবাইয়ের মধ্যে সংযোগের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, হত্যাকাণ্ডের ১২ দিন আগেই মুসা দুবাই চলে যান। হত্যা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা এবং সেখান থেকেই কলকাঠি নাড়া হয়। হত্যাকাণ্ডের পর দুবাইতে বার্তা যায় কাজ শেষ (ইট ইজ ডান)।
হত্যার কারণ হিসেবে র্যাব বলছে, চাঁদাবাজি ও দরপত্র নিয়ে আধিপত্যের দ্বন্দ্ব, রিয়াজুল হক মিল্কী হত্যার বদলা এবং বোঁচা বাবু হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে বক্তব্য রাখেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এদের মধ্যে সালেহ শিকদার হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ‘পরিকল্পনাকারী’ মুসার ভাই। বোঁচা বাবু হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি নাসির, দুই নম্বর সালেহ, তিন নম্বর আসামি মুসা এবং চার নম্বর আসামির তালিকায় রয়েছেন ওমর ফারুক।
র্যাব জানিয়েছে, মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের সময় নজরদারির কাজে ব্যবহার করা মোটরসাইকেল এবং হত্যার জন্য দেওয়া ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে নাসির যে পোশাক পরে উপস্থিত ছিলেন সেই পোশাক ও জুতাও উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে র্যাব।
এর আগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ওই ঘটনায় শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও আরফান উল্লাহ দামাল নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। এদের মধ্যে মাসুম গুলি ছুঁড়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটান এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দামাল হত্যার পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছিলেন বলে জানাচ্ছে ডিবি।
ডিবির হাতে গ্রেপ্তার দুজনকে নিয়ে যা বলল র্যাব
গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) যে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে তাদের বিষয়ে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার চারজন কী তথ্য দিয়েছেন জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, “ডিবির বক্তব্যেও এসেছে, তদন্তকালেও আমরা দেখেছি যে পুরো পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ‘কাটআউট সিস্টেমে’ করা হয়েছে।”
অপরাধ জগতে কাট আউট বলতে বোঝায় কোনো ঘটনায় জড়িত এক স্তরের ব্যক্তিরা অন্য স্তরের সম্পর্কে কোনো তথ্য জানেন না। মাঝে কেউ একজন তাদের মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করে।
“নাসির স্পটের একদম কাছে ছিল। শুটার একটি মোটরসাইকেলে এসে আরেকটিতে করে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। নাসির সবই দেখেছেন। ওমর ফারুক ও কাইল্যা পলাশও ঘটনাস্থলের আশপাশেই ছিলেন। তবে এ শুটার কে ছিল সেটা নাসির, ওমর ফারুক বা কাইল্যা পলাশ কেউ জানেন না।”
ডিবির হাতে গ্রেপ্তার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরফান উল্লাহ দামালের বিষয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, “আমরা যাদেরকে ধরেছি তাদের কেউ বলেননি যে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরফান উল্লাহ দামাল পরিকল্পনায় ছিলেন।”
‘আধিপত্য-প্রতিশোধ’ থেকে হত্যা
লিখিত বক্তব্যে র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা খুনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে নিহত টিপু ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি ও দরপত্রে দখলদারিত্ব, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল। দীর্ঘদিন ধরে এসবের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কী খুন হন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা র্যাবকে জানায়, তাদের ধারণা টিপুর কারণেই বাবু হত্যা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালে স্থানান্তরিত হয়েছে। ইতোমধ্যে মামলার বাদী বাবুর বাবা আবুল কালামের সঙ্গে ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা ৫০ লাখ টাকায় রফা করার চেষ্টা করে। সেখানেও বাদ সাধেন টিপু। তার কারণে কালাম মিমাংসায় আসেননি বলে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জানান। কালামকে নিয়ে সার্বক্ষণিক চলাচল করতে থাকেন টিপু।
তারা আরও জানায় যে, বোঁচা বাবু হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী কাইল্লা পলাশকে আসামিরা স্বাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য টাকা সেধেছিলেন। পলাশ তাতে রাজীও হন। কিন্তু পরে টিপুর চাপে সাক্ষী দেন পলাশ। পলাশও পরে টিপুকে হত্যার জন্য বাবু হত্যা মামলার অন্য আসামিদের সঙ্গে যুক্ত হন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “জাহিদুল ইসলাম টিপু নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ বোঁচা বাবু হত্যা মামলাটি শক্তভাবে পরিচালনা করছিলেন। বাবুর বাবা আবুল কালামকেও শেল্টার দিয়ে আসছিলেন। সবসময়ই বাবুর বাবা টিপুর সঙ্গে চলতেন।
ওই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের কাছে যে বিষয়টি এসেছে পিউরলি যদি বলা হয় হত্যার বদলে হত্যা। মিল্কী হত্যাকাণ্ডের পর যারা মিল্কীর কাছের মানুষ ছিল এই কাইল্যা পলাশ, ওমর ফারুক তারা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকে বলেছেন জাহিদুল ইসলাম টিপু ওই হত্যা পরিকল্পনায় যুক্ত। তো এ যে হত্যার বদলে হত্যা হিসেবে এবং আরও কিছু স্বার্থের দ্বন্দে তারা কিন্তু টিপুর সবচেয়ে কাছের মানুষ বোঁচা বাবুকে হত্যা করায়। এ হত্যাকাণ্ডেও অপরাধ জগতের সঙ্গে সমন্বয় করে কিলার ভাড়া করে দিয়েছিলেন মুসা।”
অপরাধজগতের সংযোগ ও চুক্তি
র্যাব জানায়, ফারুক ও মুসার সঙ্গে ফোনে অপরাধ জগতের কয়েকজন সন্ত্রাসীর যোগাযোগ করিয়ে দেন কাইল্লা পলাশ। পরে খুনের বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সমন্বয়ের জন্য মুসা গত ১২ মার্চ দুবাই যান। সেখানেই হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত সমন্বয় করা হয়।
ওমর ফারুকের সঙ্গে টিপুকে হত্যার জন্য ১৫ লাখ টাকার চুক্তি হয়। ওই টাকার মধ্যে ফারুক নয় লাখ এবং নাসির, সালেহ ও মুসা বাকি টাকার যোগান দেন। নগদ পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে মুসা দুবাইয়ে যান। পরে আরও চার লাখ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে তাকে পাঠানো হয়। বাকি ছয় লাখ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়।
‘ইট ইজ ডান’
র্যাব জানায়, দেশ হতে নাসির, পলাশসহ আরও কয়েকজন টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েকদিন ধরে মুসার কাছে তথ্য দিচ্ছিলেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর নাসির অন্তত চার বার অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে জানান। টিপু তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ড সুলতান রেস্তোঁরা থেকে বের হওয়ার সময় পলাশ তাকে নজরদারিতে রাখে এবং তার অবস্থান সম্পর্কে বিদেশে অবস্থানরত সন্ত্রাসী ফ্রিডম মানিককে জানান।
মূলত নাসিরের সঙ্গেই মুসার প্রতিদিন নিয়মিত কথা হচ্ছিল। নাসির কয়েকদিন ধরেই টিপুকে অনুসরন করছিলেন। মুসাকে নিয়মিত আপডেট দিতেন তিনি।
নাসির র্যাবকে বলেছেন, তাদের পরিকল্পনায় মূল শুটারের পাশাপাশি ব্যাকআপ প্ল্যানও ছিল তাদের। ওই পরিকল্পনার বিষয়েও মুসা তাকে বলেছেন। গুলি হওয়ার পর নাসির মুসাকে জানান, কাজ শেষ (ইট ইজ ডান)। তখন আর দ্বিতীয় পরিকল্পনা কার্যকরের প্রয়োজন হয়নি।
খুনের রাতের ঘটনাক্রমের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এসএমএস পাঠিয়েই নিজের মোবাইল ফোন থেকে সিম খুলে ফেলে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে সেটি নষ্ট করে ফেলেন নাসির। এরপর ফোনটি ফ্ল্যাশ করে বেচেও দেন। র্যাব ওই মোবাইল ফোন ও সিম উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে।
ভূক্তভোগীরাও র্যাবের সন্দেহে
টিপু হত্যার পর যারা ভুক্তভোগী হচ্ছেন এমন ব্যক্তিদেরও সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে না জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “আবার ভুক্তভোগী হিসেবে যাদের দেখা যাচ্ছে তারা যে কেউ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না এমনটাও বলা যাচ্ছে না। পরে জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে।”
অপরাধজগতের এরা কারা?
যে অপরাধজগতের (আন্ডারওয়ার্ল্ড) সন্ত্রাসীদের কথা জড়িয়েছে এ খুনের সঙ্গে তারা কারা জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মঈন বলেন, “আমরা বিভিন্ন সন্ত্রাসীর নাম পেয়েছি। মুসার অবস্থান পেয়েছি দুবাইতে। তিনি সেখানে একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর আশ্রয়ে আছেন। একইভাবে আমরা কাইল্যা পলাশকে পেয়েছি যিনি আরেকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে তথ্য দিচ্ছিলেন। তার অবস্থান পাশের একটি দেশে। তবে এখন ভিপিএন ব্যবহার করে একদেশে থেকে আরেকদেশের নম্বর ব্যবহার করা যায়।
“স্কুল-কলেজে ভর্তি বাণিজ্য, মতিঝিল এলাকায় চাঁদাবাজিতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই কলগুলো তাদের কী না সেটা ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন রয়েছে। এখানে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কিছু সন্ত্রাসীর নামও আমরা পেয়েছি। এদের এমন কিছু ব্যক্তি এর আগে আমরা যাদের গ্রেপ্তার করেছিলাম তাদের সংশ্লিষ্টতাও আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না।”
সংবাদ সম্মেলনে মঈন আরও বলেন, অপরাধজগতের পাশাপাশি লুকিয়ে (আন্ডারগ্রাউন্ডে) থাকা কিছু অপরাধীও এ হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকতে পারেন- যাদের এর আগে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব।
র্যাব সূত্রগুলো জানিয়েছে, ক্যাসিনো কাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলে যুক্ত কয়েকজন ওই হত্যাকাণ্ডে কলকাঠি নেড়েছেন বলেও তথ্য এসেছে।