শনিবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফারহানা শুধু তার স্বামীর খুনীদেরই নয়, পর্দার আড়ালে থাকা হোতাদেরও (মাস্টারমাইন্ড) গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
নিহত টিপুর বাড়িটি রেললাইন সংলগ্ন খিলগাঁওয়ের বাগিচা এলাকায়। শনিবার দিনভরই বাড়িতে ছিল নেতা-কর্মীদের উপচে পড়া ভিড়। স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ের নেতারা আসছেন-যাচ্ছেন। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতা-কর্মীরা এসেছেন সমবেদনা জানাতে।
শনিবার সন্ধ্যায় এরমধ্যেই এক ফাঁকে হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা টিপুর স্ত্রী বলেন, “আপনারা জানেন মিল্কী (রিয়াজুল হক মিল্কী) ভাই মার্ডারের পর টিপুকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আসামি করা হয়েছিল। এরপর যখন এলাকার ছেলে বোঁচা বাবু (রিজভী হাসান বাবু) খুন হল তখনও তাকে আসামি করার জন্য একটি পক্ষ উঠে-পড়ে লাগল।”
আগামী এপ্রিলেই একটি চাকরিতে যোগদানের কথা ছিল সামিয়া আফনান প্রীতির।
“এখন অনেকেই বলতেছে যে, ওরা (ফারুক ও বাবু হত্যার অন্যান্য আসামিরা) আপনার ভাইরেও হুমকি দিচ্ছিল। কারণ সবাই জানে যে বাবুর বাবার সঙ্গে তার (টিপুর) খুব ভালো সম্পর্ক। আবুল কালাম ভাই তার (টিপু) কথা শোনে। ও মারা যাওয়ার পর আমি এসব শুনেছি।”
তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ওমর ফারুককে পাওয়া যায়নি। তার ঘনিষ্ঠরা বলছেন, শুক্রবারই ফারুককে আটক করে নিয়ে গেছে সরকারের একটি বাহিনী।
ফারুক ছাড়াও আরও অন্তত দুজন নেতাকর্মীকে এলাকা থেকে আটকের কথা জানিয়েছেন তারা। তবে শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত শাহজাহানপুর থানার পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ বা র্যাব থেকে ওই মামলায় কাউকে আটক বা গ্রেপ্তারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে খুন হন স্থানীয় যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোঁচা বাবু। বাবু হত্যা মামলায় পুলিশের তদন্তে আওয়ামী লীগেরই কিছু নেতা-কর্মীর যুক্ততা রয়েছে উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলাটি এখন বিচারের পর্যায়ে রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেটের কাছে ভিড়ে ঠাসা সড়কে মাইক্রোবাস আরোহী টিপুকে (৫৫) গুলি করে হত্যা করা হয়। এসময় গুলিতে নিহত হন রিকশারোহী কলেজ শিক্ষার্থী সামিয়া আফনান জামাল প্রীতি (২২)। গুলিবিদ্ধ হন টিপুর গাড়ির চালকও।
এ হত্যাকাণ্ডের পরদিন নিহতের স্ত্রী ওয়ার্ড কাউন্সিলর ডলি বাদী হয়ে শাহজাহানপুর থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। থানা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে।
শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত ওই মামলায় কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে গ্রেপ্তারের খবর জানায়নি পুলিশ। তবে স্থানীয় রাজনীতিকরা কয়েকজনকে ‘ধরে নেওয়ার’ খবরের কথা বলছেন।
‘হোতাদেরও’ যেন ধরা হয়
শনিবার সন্ধ্যায় নিহত টিপুর স্ত্রী ডলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে কাজ করছেন তাতে খুনী তো ধরা পড়বেই। আমি চাই খুনের পেছনে যেই মাস্টারমাইন্ডদের হাত রয়েছে এবার তাদেরও যেন ধরা হয়। না হলে টিপুর আত্মা শান্তি পাবে না।
“টিপু দলের জন্য করছে, অনেক সার্ভিস দিছে। আমার এইটুকু চাওয়া তারা যেন পূরণ করেন।”
স্বামীকে হত্যার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে তিনি খুব সুনির্দিষ্টভাবে কোনও কিছু ধারণা করতে পারছেন না জানিয়ে ডলি বলেন, “পারিবারিক বা ব্যবসায়িক কোনো বিরোধ নেই। রাজনীতিতে পক্ষ বিপক্ষ থাকে। তবে এমন কিছু হয়ে যাবে এটা আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি।“
হুমকি দিয়ে ফোন এসেছিল
নিহত এ আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারী তিন নেতা কর্মী জানালেন সম্প্রতি হুমকি পাওয়ার কথা তাদের জানিয়েছিলেন টিপু। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডলি বলেন, “আমাকে আগে সেভাবে কিছু বলেনি। যেদিন ঘটনা (বৃহস্পতিবার) সেদিন সকালে বলল, কে যেন তাকে ফোন করে বলেছে, ‘তোর বিপদ, তোরে মাইরা ফেলব’।
“আমি জিগাইলাম নম্বরটা কার, সে বলল, ‘এখন বন্ধ পাচ্ছি’। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পার্টির প্রোগ্রাম, করপোরেশনের প্রোগ্রামের প্রস্তুতি মিটিং ছিল কয়েকটা। আমি সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম। নম্বরটাও নিলাম না। এখন কে যে কী কারণে হুমকি দিল সেটা তো বুঝতে পারতেছি না।”
একা চলতেন না টিপু
স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন গত কয়েকদিন জাহিদুল ইসলাম টিপুকে একা চলতে দেখেননি তারা। কাউকে না কাউকে ডেকে নিতেন বের হওয়ার সময়।
এ বিষয়ে ডলি বলেন, “ওর (টিপুর) বাম চোখে অপারেশন হইছে। যার কারণে শবে বরাতের আগে চারদিন বাসাতেই ছিল। শবে বরাতের রাতে প্রথম বাসা থেকে বের হয়। ওর সঙ্গে তো এমনিতেই নেতা-কর্মী বা বন্ধু-বান্ধবরা থাকে। যেখানে আড্ডা দিতে যায় ফেরার সময় তাদের অনেককেই গাড়িতে লিফট দিত।”
পুলিশ বলছে, মামলার তদন্ত করতে গিয়ে নিহতের ব্যক্তিগত জীবনাচরণও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কতটুকু এগোল তদন্ত
শনিবার রাতে মামলার তদন্তের অবস্থা জানতে শাহজাহানপুর থানায় গিয়ে দেখা যায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কক্ষে বসে কাজ করছেন পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অনেক রকমের কাগজ ধরে তারা বিশ্লেষণ করছেন।
পরে ওসি মনির হোসেন মোল্লা বলেন, “অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। সবাই মিলে খুবই চেষ্টা করছি আসামিদের ধরার জন্য।”
মামলার আলামত হিসেবে গাড়ি, গুলির খোসা ও কয়েকটি মোবাইল ফোন জব্দ করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এসব আলামতই নানাভাবে পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে সোর্সদের মাধ্যমেও তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
থানার প্রাঙ্গণে রাখা আছে রক্তমাখা টয়োটা মাইক্রোবাসটি। এটির চালকের আসন, স্টিয়ারিং হুইলেও রক্তের দাগ। রক্ত লেগে আছে চালকের পাশের দরজাতেও।
গাড়ির চালক মনির হোসেন মুন্নার হাতে গুলি লেগেছিল। আর টিপু বসেছিলেন চালকের পাশের (বাঁ) আসনে। সেটিতে তেমন রক্তের দাগ নেই। তবে দুই পাশের কাঁচ ভেঙে চুরে পড়ে আছে। পেছনের আসনগুলো পরিচ্ছন্ন। ওইদিন গাড়ির দ্বিতীয় সারির আসনে বসে ছিলেন বোঁচা বাবুর বাবা আবুল কালাম ও অন্য আরেকজন।
আরও পড়ুন