বাড়ি ফিরতে চেয়েও ফেরা হল না প্রীতির

“মাইয়াডা বাড়িত আইতে চাইল, আমি না করলাম। আমার মায়ে রাগ কইরা চইলা গেল।” ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে কান্না থামছিল না সামিয়া আফনান জামাল প্রীতির মায়ের।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2022, 06:39 AM
Updated : 29 March 2022, 12:35 PM

ঢাকার শাহজাহানপুরে বৃহস্পতিবার রাতে এক আওয়ামী লীগ নেতার মাইক্রোবাস লক্ষ্য করে চালানো গুলিতে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী প্রীতিরও মৃত্যু হয়। 

বদরুন্নেছা কলেজের শিক্ষার্থী প্রীতিরা দুই ভাই-বোন। শাহজাহানপুরের কাছেই শান্তিবাগে তাদের ছোট্ট দুই কামরার বাসা। বাবা মো. জামালউদ্দীন কাজ করেন শহরের অপর প্রান্তে মিরপুরের এক কারখানায়।

২২ বছর বয়সী প্রীতি চার দিন আগে খিলগাঁওয়ের তিলপা পাড়ায় গিয়েছিলেন বান্ধবী সুমাইয়া আক্তারের বাসায়। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফিরছিলেন বাসায়।

মা হোসনে আরা বেগম জানালেন, বান্ধবীর বাসা থেকে বেরিয়ে তাকে ফোন করেছিলেন প্রীতি। বলেছিলেন, “বাসায় আইতাছি, ভাত খাব।”

অপর প্রান্ত থেকে মা ফোনে বলেছিলেন, “চিটাগং থাইকা তোর মামা আইছে, আরেকদিন সুমাইয়ার বাড়িত থাইকা আয়।”

মায়ের কথা শুনে আবার সুমাইয়াকে সঙ্গে নিয়ে তার বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশা নেন দুজন। তার পরপরই গুলির শব্দ, রিকশা থেকে পড়ে যান প্রীতি।

রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে আহাজারি করছিলেন প্রীতির মা। বাসার কাছাকাছি চলে আসার পরও কেন মেয়েকে ফেরত পাঠালেন, সেজন্য নিজেকে দোষারোপ করছিলেন তিনি। 

জামাল উদ্দীন স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, “হায়াত-মউত সবই আল্লাহর হাতে।” কিন্তু মেয়েকে হারিয়ে কান্নায় তার নিজের কণ্ঠ বুঁজে আসছিল।

টানাটানির সংসারে ছেলে-মেয়েদের ভালোভাবে পড়াতে পারেননি বলে আক্ষেপ আছে জামাল উদ্দীনের। তিনি জানালেন, প্রীতি কয়েক বছর আগে একবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসে অকৃতকার্য হয়। এরপর কিছুদিন পড়ালেখা বন্ধ থাকে।

প্রীতির মা হোসনে আরা বেগম কাঁদছেন, সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই বাবা জামালউদ্দিনের।

খিলগাঁওয়ের একটি খাবারের দোকানে কিছুদিন কাজও করেছিলেন এই তরুণী। পরে সব ছেড়ে আবার বদরুন্নেছা কলেজে ভর্তি হয়ে যান, প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার।

তার বান্ধবী সুমাইয়া বলেন, তার মা গ্রামের বাড়িতে যাওয়ায় প্রীতিকে কদিন বাসায় থাকতে বলেছিলেন। সেই অনুরোধেই চারদিন তার বাসায় ছিলে প্রীতি।

বৃহস্পতিবার প্রীতি নিজের বাসায় ফেরার জন্য তিলপা পাড়া থেকে রওনা হলেও কিছুক্ষণ পর ফোন করে খিলগাঁও রেলগেইটের কাছে যেতে বলেন সুমাইয়াকে। পরে সেখান থেকে দুই বান্ধবী আবার সুমাইয়ার বাসায় যাওয়ার রিকশা নেন।

সুমাইয়া বলেন, রিকশা চলতে শুরু করতেই হঠাৎ ‘দুম দুম’ শব্দ। ধাক্কার চোটে দুই বান্ধবীর রিকশা থেকে পড়ে যান। পড়ে তিনি উঠে দেখেন, প্রীতি সংজ্ঞাহীন পড়ে আছে।

“আমাদের পাশেই একটা মাইক্রোবাস ঘিরে গোলাগুলি হচ্ছিল।  কে গুলি করছে সেটা তখন খেয়ালও করতে পারিনি।”

শাহজাহানপুরের আমতলী এলাকায় মানামা ভবনের সামনে প্রকাশ্য সড়কে ওই হামলা চালানো হয় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুর (৫৪) গাড়ি লক্ষ্য করে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদেরও সদস্য ছিলেন তিনি।

স্থানীয়রা প্রীতি আর টিপুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক জানান, তারা দুজনই মারা গেছেন।

টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নারী কাউন্সিলর। শুক্রবার সকালে তিনি শাহজাহানপুর থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন।

সবুজবাগ জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মনতোষ বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে সিসিটিভি ভিডিও সংগ্রহ করা হয়েছে, সেসব বিশ্লেষণের পর্যায়ে রয়েছে। আমরা কাউকে শনাক্ত করতে পারিনি এখনো। তবে চেষ্টা চলছে।”