যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আরিফ টিপুকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করায় ক্ষোভপ্রকাশ করে বিতর্কিত এ তালিকা তৈরিতে জড়িতদের খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা।
Published : 17 Dec 2019, 06:30 PM
মঙ্গলবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের সংবাদ সম্মেলন থেকে সরকার, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়।
গোলাম আরিফ টিপু সাংবাদিকদের বলেন, “দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আমি আমার সহকর্মীসহ বিজ্ঞ প্রসিকিউটরদের সঙ্গে নিয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত রাজাকারের তালিকায় আমার নাম যুক্ত থাকায় আমি হতবাক, বিস্মিত, মর্মাহত ও অপমানিত।
“বুঝে পেলাম না কোথা থেকে এই শক্তিটা তারা পেলেন। মনে হয় মুক্তিযোদ্ধা সংস্থায় (হবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়) যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের অশুভ বা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তির অবস্থান কিছুটা রয়ে গেছে এবং সেখান থেকেই এই ব্যাপারগুলো হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে।
“কীভাবে রাজাকার আলবদরের তালিকায় তালিকাভুক্ত হলো, সেটার উৎস কারা, সেটাকে খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে- সেইটা করতে হবে।”
ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য চলতি বছর একুশে পদক পাওয়া গোলাম আরিফ টিপু ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
রাজশাহীতে বাংলা ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া পর্যন্ত সকল গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন প্রায় ৮৯ বছর বয়সী আইনজীবী।
২০১৩ সালে ৭ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাব্যুনাল গঠনের পর থেকে তিনি প্রসিকিউশনের প্রধান কৌঁসুলির দায়িত্ব পালন করছেন।
অথচ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত রোববার স্বাধীনতা বিরোধীদের যে তালিকা প্রকাশ করে তাতে গোলাম আরিফ টিপুর নাম রয়েছে।
প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন বলেন, এই তালিকা সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, জাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিতর্কিত তালিকা প্রণয়নে কারা জড়িত তা সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থাকে খুঁজে বের করতে হবে।
সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যে একজনও মুক্তিযোদ্ধা নেই দাবি করে তনি বলেন, “কন্টাক্ট সার্ভিসে দুয়েকজন থাকতে পারেন। আমরা কয়েকজন ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযোদ্ধা আছি। এখন যারা সরকারের বিভিন্ন পদে আছেন তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের পরিচায় জানা দরকার।
“গত ছয় মাস যাবত যে সমস্ত অফিসাররা এই তালিকা তৈরি করেছেন, তাদের নিয়োগ দিল কে এবং কীভাবে এটি প্রকাশিত হলো- প্রত্যেকটা জেলার খবরাখবর তারা নিতে পারতেন। এটা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তারা যাচাই-বাছাই করতে পারতেন।”
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে সিমন বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রাজাকারের তালিকা প্রচার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সীমাহীন অযত্ন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অত্যন্ত অবহেলার পরিচয় দিয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, তদন্ত সংস্থা বহুবার মানবতাবিরোধী অপরাধের সংশ্লিষ্টদের তালিকা, তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি দিলেও মন্ত্রণালয় থেকে কোনো তথ্য-উপাত্ত, তালিকা সরবরাহ করা হয়নি।
২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রথমে ইসলামী ছাত্র সংঘের বরিশালের সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ আব্দুল মতিনকে নিয়োগ দিয়েছিল।
সেটি মনে করিয়ে দিয়ে মালুম বলেন, “সেই লোককে জাতির এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কীভাবে নিয়োগ দিয়েছিল সেই জবাব কিন্তু পায়নি। জাবাবটা আমাদেরও জানা নাই। ফলে আজকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যখন এই ধরনের তালিকাগুলো প্রকাশিত হয় এটিকে আর অনুধাবন করার বাকি থাকে?’
জামায়াত-শিবিরের অনুসারীরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে চেপে বসে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এই ধরনের ‘স্যাবোটেজ’ করার চেষ্টা করছে বলেও দাবি এই প্রসিকিউটরের।
রাজাকার-আলবদরের তালিকায় গোলাম আরিফ টিপুর নাম আসা জাতির জন্য লজ্জার মন্তব্য করে মালুম বলেন, “শুরু থেকেই এই কাজটির (মানবতাবিরোধীদের বিচার প্রক্রিয়া) ভেতরে এবং বাইরে ষড়যন্ত্র ছিল, এখনও আছে। এটি সেই ধরনের ষড়যন্ত্রের একটি বহিপ্রকাশ।”