সরকার ঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম আসায় সারা দেশে আলোচনা চলছে।
Published : 17 Dec 2019, 03:31 PM
‘রাজাকার তালিকা ইতিহাস বিকৃতি রোধে সহায়ক হবে’
রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম নিয়ে মন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ
বরিশাল, বরগুনা, রাজশাহী, বগুড়া ও ঝালকাঠি জেলার মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কয়েকজনের নাম এ তালিকায় উঠে আসায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধারা। কোথাও কোথাও বিক্ষোভ কর্মসূচিও দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সোশাল মিডিয়াতেও চলছে নানামুখী আলোচনা।
বিজয় দিবসের দিবসের আগের দিন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১০ হাজার ৭৮৯ জন `স্বাধীনতাবিরোধীর’ ওই তালিকা প্রকাশ করে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সরকারের কাছে বিভিন্ন মহল থেকে স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা প্রকাশের দাবি করা হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে। তারই প্রেক্ষিতে প্রথম দফায় ১০ হাজারের বেশি নাম প্রকাশ হলেও এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
এদিকে দুঃখ প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “ব্যাপকভাবে অভিযোগ পাওয়া গেলে গত রোববার প্রকাশিত ওই তালিকা প্রত্যাহার করা হবে। আর ‘দুই-একশ’ নামে ভুল হলে সংশোধন করা হবে। ”
আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে বিস্তারিত:
রাজশাহী
স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকার ৮৯ নম্বরে রাজশাহী জেলার প্রকাশিত নামগুলোর মধ্যে তিনটি নাম অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ, অ্যাডভোকেট মহসিন ও অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের নামের মিল থাকায় তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে। ওই তালিকায় এসব নাম পূর্বের ৬০৬ নম্বর নথি থেকে নেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
তালিকার ৮৯ নম্বরের ঘরের চার নম্বরে বলা ‘গোলাম আরিফ’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি ছাড়া রাজশাহীতে এ নামে আর কোনো আইনজীবীর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
“১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন টিপু।”
একাত্তরে রাজশাহী জেলা ন্যাপের সহসভাপতি গোলাম আরিফ টিপু ভারতের লালগোলা ক্যাম্পে থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছেন বলেও জানান তিনি।
এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে দুই সন্তানসহ পরিবারের পাঁচজনকে হারানো অ্যাডভোকেট সালাম তালিকার সালাম কিনা তা নিয়েও চলছে আলোচনা।
২৫ মার্চ রাতে অ্যাডভোকেট সালামকে না পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তুলে নিয়ে যায় তার দুই সন্তানসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে। পরে তাদের লাশও পাওয়া যায়নি বলে জানান ওয়ালিউর।
রাজাকারের তালিকায় অ্যাডভোকেট মহসিন সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহীতে এ নামের দুইজন আইনজীবীর কথা বলেন ওয়ালিউর রহমান বাবু।
“একজনের নাম অ্যাডভোকেট মিয়া মহসিন আর অপরজন অ্যাডভোকেট মহাসিন খান। মিয়া মহসিন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রাজশাহী অঞ্চলের অন্যতম সংগঠক। এখনো বহু মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটে অ্যাডভোকেট মহসিনের স্বাক্ষর আছে। তিনি ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রাজশাহী-১ আসনে এমপি নির্বাচন করেছিলেন। আর মহসিন খান তিনিও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।”
মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের রাজশাহী অঞ্চলের সাব সেক্টরের উপ-অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা তসিকুল হক রাজা বলেন, এ তালিকা তৈরিতে মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেননি।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় ক্ষুব্ধ তসিকুল এ তালিকা তৈরির সঙ্গে রাজাকাররা জড়িত কি না তা খুঁজে বের করার দাবি জানান।
বগুড়া
বগুড়ার বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতার নাম মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত তালিকায় থাকায় বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে ক্ষোভ প্রকাশ করে তালিকাটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
সোমবার আদামদীঘি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম খান রাজু, সহসভাপতি আবু রেজা খান, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হামিদসহ অন্যান্য নেতারা রাজাকারের নামের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতার পক্ষে ব্যক্তিদের নাম ওঠায় প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান।
আদমদীঘি থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হামিদ বক্তব্যে বলেন, “তালিকায় ১৮ নম্বরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপি কছিম উদ্দিন আহম্মেদের নাম। কছিম উদ্দিনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এখনও ভাতা উত্তোলন করেন।”
এছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক এমএনএ মজিবর রহমান (আক্কেলপুর), মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মনছুর আলী, আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা সভাপতি তাহের উদ্দীন সরদার, সাবেক রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা জাহান আলী, সান্তাহার কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগ নেতা ফয়েজ উদ্দীন আহম্মেদের নামও রয়েছে বলে অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধারা জানান।
আব্দুল হামিদ বলেন, “দেখে হতবাক হয়েছি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা করা হয়েছে। যারা আওয়ামী লীগের সংগঠক এবং যুদ্ধকালীন কমান্ডার তাদের নাম কীভাবে রাজাকরের তালিকায় এসেছে!”
আদমদীঘির যুদ্ধকালীন ডেপুটি কমান্ডার হাফিজার রহমান বলেন, “আমি কমান্ডার মনছুর আলীর অধীনে যুদ্ধ করেছি। তার নাম দেওয়া হয়েছে রাজাকারের তালিকায়। এ তালিকা সঠিক নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারীদের রাজাকার বানানো হলো; তার বিচার করতে হবে।”
বরগুনা
বরগুনার পাথরঘাটা মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, পাথরঘাটা থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রয়াত মজিবুল হকের নাম স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় আসায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় অনেকের মধ্যে।
পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. জাবির হোসেন বলেন, মুজিবুল হকের (ডাক নাম-নয়া ভাই) নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় তারা মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ।
“তার নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় আওয়ামী লীগের সুনাম ক্ষুণ্ন রয়েছে।“
পাথরঘাটা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সাংগঠনিক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, মজিবুল হক মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি এবং তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
“মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে তৎকালীন বরগুনা মহকুমার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ মাস্টার ধরে এনে বেশ কিছুদিন আটকে রেখেছিলেন। এমনকি পাকিস্তানি বাহিনীর পটুয়াখালী কমান্ডার মেজর নাদের পারভেজের কাছেও তাকে নেওয়া হয়েছিল।”
বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুর রশিদ মিয়া বলেন, ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (পাথরঘাটা-বামনা) সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা মজিবুল হক ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি পাথরঘাটা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
“তিনি ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। এই নেতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন।”
প্রয়াত মজিবুল হকের স্ত্রী নুরজাহান বেগম (৯০) সঠিক তথ্য জেনে তার স্বামীকে কলঙ্কমুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে, বিক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা মঙ্গলবার সকালে পাথরঘাটা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে পাথরঘাটা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল মান্নান বলেন, মজিবুল হক বঙ্গবন্ধুর সহচর ছিলেন। তারা একই সময়ে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন।
পাথরঘাটার তালিকায় প্রকাশিত আটটি নামের মধ্যে তিনজন কালমেঘার গোলাম কাদের কাদু, টেংরার শেখ আবদুল মালেক ও পাথরঘাটার ছালেহ আহমেদ শুধু ‘চিহ্নিত রাজাকার’ উল্লেখ করে বাকীরা স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন না বলে জানান আবদুল মান্নান।
তালিকার আমির হামজা ওরফে রুস্তম খা এবং খলিলুর রহমান মানিক তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা বলেও জানান তিনি।
“এই খলিলুর রহমান মানিক বাদী হয়ে পাথরঘাটা থানার শান্তি কমিটির সভাপতি খলিলুর রহমানকে আসামি করে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলা করেছিলেন।
“এছাড়া সৈয়দ হায়দার আলী ছিলেন ‘রাজাকার খলিল চেয়ারম্যানের বিরোধী’ এবং এ তালিকায় নাম ওঠা অপরজন আমজাদ আলী ছিলেন আওয়ামীলীগের নেতা।”
সংবাদ সম্মেলন শেষে পাথরঘাটা পৌরশহরের শেখ রাসেল চত্বরে মানববন্ধন করা হয়। দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পাথরঘাটা পৌর শহরের সব দোকানপাট বন্ধ রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারা।
পাথরঘাটা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাবির হোসেন বলেন, পাথরঘাটার আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রয়াত মজিবুল হক ৪০ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
তার নাম স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় আসার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিক্ষোভ সমাবেশ করার কর্মসূচি নিয়েছেন তারা।
ঝালকাঠি
এ তালিকায় ঝালকাঠি জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার প্রয়াত শামসুল আলম ওরফে সামশুর নাম আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার পরিবারসহ স্থানীয়রা।
“একাত্তরের রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা ছিলেন তিনি। তার নাম রাজাকারের তালিকায় ওঠার মত চরম দুঃখজনক এবং বিস্ময়কর ঘটনা আর থাকতে পারে না।
এ ব্যাপরে ঝালকাঠি সদর উপজেলার সাবেক ভারপ্রাপ্ত জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল রশিদ হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শামসু ভাই (শামসুল আলম) একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রের যোদ্ধা। তার নাম রাজারেরর তালিকায় থাকার মত লজ্জার বিষয় আর হতে পারে না।”
এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সদর উপজেলার কেওড়া ইউনিয়নের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা ইউনিয়ন কমান্ডার জাহাঙ্গীর আলম খানও।
২০১২ সালের ২৯ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ঝালকাঠি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার শামসুল আলম।
বরিশাল
বরিশালের ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী ও তার মা ও শহীদ জায়া উষা রানী চক্রবর্তীর নাম স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় আসায় আলোচনা শুরু হয়। এরপর একে একে অন্যদের নাম আসা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় শুরু হয় সমালোচনা।
বরিশালে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় তাদের নাম আসার প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে।
বরিশাল বাসদের সভাপতি ইমরান হাবিব জানান, রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকালে নগরীর ফকিরবাড়ি রোড বাসদ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। এ সময় ডা. মনীষা চক্রবর্তী ও তার বাবা তপন কুমার চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন।
তপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, “একজন গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা দুঃখজনক। এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা অসৎ উদ্দেশ্যে এমনটা করেছে। তালিকা সংশোধনের পাশাপাশি জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে।”
সংবাদ সম্মেলন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে তালিকা থেকে তপন কুমার চক্রবর্তীর নাম প্রত্যাহারের দাবিতে সদর রোডে সমাবেশ হয়।
এর আগে সোমবার বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারা এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বলেন, একটি মহল শত্রুতা করে এই পরিবারের সদস্যদের নাম তালিকায় দিয়েছে।
এর মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ‘শুধু মুক্তিযোদ্ধাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান’ করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তপন চক্রবর্তীর মেয়ে বাসদ নেতা ডা. মনীষা চক্রবর্তী।
সিরাজগঞ্জ
সরকার প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় সিরাজগঞ্জের দুই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকের নাম থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তাদের স্বজন ও সহযোদ্ধারা।
তারা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের প্রথম দফায় প্রকাশিত এই তালিকা বাতিল এবং তালিকা প্রস্তুতকারীদের বিচার দাবি করেছেন।
তালিকায় প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জা ও সদ্য প্রয়াত অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম। তালিকায় রাজশাহী বিভাগীয় অংশে ৪র্থ পাতায় ৩৪ ক্রমিক নম্বরে এই দুজনের নাম রয়েছে।
আব্দুল লতিফ মির্জা ও খুরশিদ আলমের স্বজন ও সহযোদ্ধারা জানান, আব্দুল লতিফ মির্জা যুদ্ধকালে সিরাজগঞ্জ মহুকুমায় বেসরকারিভাবে গঠিত পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (বিএলএফ) সদস্য ছিলেন।
পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের সহকারী অধিনায়ক অ্যাডভোকেট বিমল কুমার দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রায় ৫৫০ থেকে ৬০০ মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে পলাশডাঙ্গা যুব শিবির গঠিত হয়েছিল। এ বাহিনীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকালীন চলনবিল অধ্যূষিত পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ৪৮টি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। এর নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জা।
“এ ঘটনায় আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বিস্মিত ও স্তম্ভিত। আমরা মনে করি, সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতা বিরোধীরা এই তালিকা প্রণয়ন করেছে। এটার মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে কলংকিত করা হয়েছে। আমরা তালিকা প্রণয়নকারীদের শাস্তি দাবি করছি।”
তিনি আরও জানান, সরকার পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরকে আগামী প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার জন্য নওগা যুদ্ধের স্থানে প্রায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে। পাশাপাশি পলাশডাঙ্গা যুব শিবির গঠনের জন্য প্রথম যেখানে সভা হয়েছিল সেই স্থানটি চিহিৃত করে রাখতে কামারখন্দ উপজেলার মধ্যভদ্রঘাট এলাকায় ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে সরকারিভাবে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে।
“এই বাহিনীর প্রধানের নাম রাজাকারের তালিকাভুক্ত করে শুধু তাকে নয় পুরো বাহিনীকেই অপমান করা হয়েছে।”
এই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক আরও বলেন, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আব্দুল লতিফ মির্জা ও খুরশিদ আলম সিরাজগঞ্জে তাঁত শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন। ওই সময় চৌহালী ও শাহজাদপুর থানার তাঁত মালিকদের পক্ষ থেকে জহুরুল ইসলাম মোল্লা নামে এক তাঁত মালিক মহুকুমা প্রশাসনের কাছে এই দুজনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন।
“সেই অভিযোগের সূত্র ধরেই তাদের নাম রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে প্রকাশিত তালিকা থেকে জেনেছি; যা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
এ বিষয়ে সদ্য বিলুপ্ত সিরাজগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার গাজী আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের রাজাকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদে এবং এর জন্য দায়ীদের বিচার দাবিতে বুধবার বিকালে সিরাজগঞ্জ জেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধাদের সভা আহবান করা হয়েছে।
ওই সভা থেকে এ ঘটনার জন্য পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে তিনি জানান।
এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জা স্মৃতি পরিষদ বুধবার সকালে জেলা সদরে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
যারা এটা করেছে, তাদের চিহিৃত করে সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন হোসনে আরা।
আব্দুল লতিফ মির্জার একমাত্র মেয়ে সেলিনা মির্জা মুক্তি বলেন, “সরকারিভাবে বিভিন্ন দলিলপত্র ও বইয়ে দালিলিকভাবে প্রমাণিত আব্দুল লতিফ মির্জা একজন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক। কোনো প্রকার যাচাই-বাচাই ছাড়া এই তালিকা প্রকাশ করায় আমি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। পাশাপাশি বাবাকে অপমান করায় একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।”
আব্দুল লতিফ মির্জা স্বাধীনতা পরবর্তীতে শ্রমিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেন। এরপর তিনি জাসদ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শেখ হাসিনা দেশে এসে দলের হাল ধরলে আব্দুল লতিফ মির্জা আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি জাসদ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি নৌকা প্রতীকে সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দলের জেলা সভাপতি থাকা অবস্থায় ২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম স্বাধীনতা পরবর্তীতে জাসদ সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রায় ৭ বছর আগে তার মৃত্যু হয়।