বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা তপন চক্রবর্তীর নাম রাজাকারের তালিকায়

মুক্তিযুদ্ধের সময় নয় নম্বর সেক্টরে মেজর আবদুল জলিলের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে ছিলেন অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী। তার বাবা সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

নিজস্ব প্রতিবেদকও বরিশাল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2019, 02:51 PM
Updated : 17 Dec 2019, 04:42 AM

কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধা ও তার মাকে ‘একাত্তরের রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও স্বাধীনতাবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকার। রোববার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় স্বাধীনতাবিরোধীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে তপন চক্রবর্তী ও তার মা উষা রানী চক্রবর্তীর নাম রয়েছে।

সরকারি গেজেটভুক্ত, নিয়মিত সম্মানী পাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্ত্রীর নাম স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় রাখায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়েছে।

বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারা এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বলছেন, একটি মহল শত্রুতা করে এই পরিবারের সদস্যদের নাম তালিকায় দিয়েছে। 

এর মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ‘শুধু মুক্তিযোদ্ধাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান’ করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তপন চক্রবর্তীর মেয়ে বাসদ নেতা ডা. মনীষা চক্রবর্তী।

পেশায় আইনজীবী তপন কুমার চক্রবর্তী পরিবার নিয়ে বসবাস করেন বরিশাল নগরীর শ্রীনাথ চ্যাটার্জী লেন এলাকায়। তার মেয়ে মনীষা গেল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বাসদের হয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তিনি বাসদ বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।

ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষ হিসাবে বরিশালে বাসদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলেই রাজনৈতিক কারণে এই তালিকায় তার বাবা ও দাদীর নাম রাখা হয়েছে বলে মনে করেন মনীষা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় যাকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়েছে, তাকেই আবার রাজাকার আখ্যা দিয়ে তালিকা প্রকাশ করেছে- এটি লজ্জাজনক ও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”

ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, “বরিশালে নির্যাতিত, অসহায় মানুষের কথা বলছে বাসদ। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে বাসদের নেতা-কর্মীরা। তাই রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে প্রতিপক্ষরা প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে মিলে এমন কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে।”

দুপুরে ফেইসবুক পোস্টে মনীষা লেখেন, “মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ কাজ করার পুরস্কার পেলাম আজ। ধন্যবাদ আওয়ামী লীগকে। সদ্য প্রকাশিত রাজাকারদের গেজেটে আমার বাবা এবং ঠাকুমার নাম প্রকাশিত হয়েছে।

“শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য আমার রাজনীতি করার খেসারত দিতে হচ্ছে আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে। ধন্যবাদ আওয়ামী লীগ সরকারকে “

এবিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আহ্বায়ক মোখলেছুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তপন কুমার চক্রবর্তীর পুরো পরিবারে স্বাধীনতাবিরোধী কেউ নেই। তিনি ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে বাকেরগঞ্জে যুদ্ধ করেছেন

“তার বাবাকে একাত্তর সালে পাক-হানাদার বাহিনীরা ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। রাজকারের তালিকায় তার পরিবারের নাম দেওয়ার পেছনে অসাধু উদ্দেশ্য আছে।”

জানতে চাইলে বরিশালের জেলা প্রশাসক অজিয়র রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি অভিযোগটি শুনেছেন। লিখিত অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।

রাজাকারের নামের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম আসার কারণ জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমত এই ব্যপারে আমি কিছুই জানি না। এর কারণ হলো এই তালিকাটি ১৯৭১ সালের করা। আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংগ্রহ করেছি। এখানে আমি একাত্তর সালে যা করা হয়েছে এর কোনো দাড়ি-কমাও আমি পরিবর্তন করি নাই।

“দ্বিতীয়ত, অনেক জায়গায় একজন মুক্তিযোদ্ধার বাবা ও নিজের নামে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা একই গ্রামের আমরা পেয়েছি। সে ক্ষেত্রে যেই মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকার তালিকায় এসেছে, একই নামে রাজাকারও একই জেলায় থাকতে পারে। এটা অন্য ব্যক্তি হতে পারে।

‘একাত্তরের রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা প্রকাশ (প্রথম পর্ব)’ শীর্ষক এই তালিকায় উষা রানীকে চক্রবর্তী ও তার ছেলে তপন চক্রবর্তীর নাম ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি ও ২৫ জুন বরিশাল কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা ভিন্ন দুটি মামলার আসামি হিসেবে রাখা হয়েছে।

১৯৭৩ সালের ৯ নভেম্বর এই দুজনসহ মোট ৪৯৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে মন্তব্যে লেখা আছে।

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপমান’

মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার সপক্ষের পবিবারের সদস্যদের নাম রাজাকারের তালিকায় রাখার মধ্য দিয়ে ‘শুধু মুক্তিযোদ্ধাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান’ করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করন ডা. মনীষা চক্রবর্তী।

সোমবার সন্ধ্যায় ফেইসবুক লাইভে এসে তরুণ এই চিকিৎসক বলেন, তার বাবা মেজর জলিলের অধীনে ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সুপরিচিত। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাধারণ সম্পাদকসহ নেতারা তাকে ভালোভাবেই চেনেন। তার দাদী স্বামীকে হারিয়েছেন ১৯৭১ সালের ১২ অগাস্ট, সেদিন তার দাদা সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

“(অথচ সরকার) তাদেরকে মূল্যায়ন করলেন রাজাকারের তালিকায় নাম দিয়ে। বিষয়টি অবিশ্বাস্য। এমন একজনের নাম যে রাজাকারের তালিকায় দেওয়া যেতে পারে- এটা না হলে এই প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করতাম না। এর মধ্য দিয়ে শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান করা হয়েছে।”

তপন কুমার চক্রবর্তীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিপত্র ও সম্মানী ভাতা নেওয়ার দলিল তুলে ধরেন তার মেয়ে।