বছরজুড়েই বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে; অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উত্তরসহ প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়েছে পরীক্ষা শুরুর আগেই।
এরমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের দুটি চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষায় জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন গ্রেপ্তারদের অনেকে।
প্রশ্নফাঁসের এই জোয়ারে অসহায় শিক্ষামন্ত্রী দুষেছেন শিক্ষকদের। তাদের নৈতিকতার উন্নতি না ঘটলে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখছেন না তিনি। এই প্রেক্ষাপটে মন্ত্রী নাহিদের পদত্যাগের দাবিও উঠেছে।
চলতি বছর এসএসসিতে বিভিন্ন পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে, যা পরদিন পরীক্ষায় হুবহু মিলে যায়। এই ধারাবাহিকতায় নভেম্বরে অনুষ্ঠিত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ব্যাপকতা পায়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একাধিক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে প্রশ্নফাঁসের প্রত্যক্ষ প্রমাণ। ১ নভেম্বর জেএসসি এবং ১৯ নভেম্বর পিইসি পরীক্ষা শুরু হয়। দুটি পরীক্ষায়ই প্রশ্ন ফাঁসের গুঞ্জনের মধ্যে বিভিন্ন কেন্দ্রে সরেজমিনে যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদকরা। প্রায় প্রতিদিনই পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে কেন্দ্রের বাইরে শিক্ষার্থীদের জটলা পাকিয়ে স্মার্টফোনে প্রশ্ন ও উত্তর খুঁজতে দেখা যায়। মেসেঞ্জার, ভাইভার, ফেইসবুক গ্রুপ ও পেইজে ছড়ানো এসব প্রশ্ন পরে হুবহু মিলে যায় পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে।
প্রশ্ন পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। বিভিন্ন কোচিং সেন্টার থেকেই প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।
অনেক অভিভাবক সন্তানকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও তার উত্তর পেতে সহায়তা করলেও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক।
ঢাকার সেন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের ২০১৮ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নাবিল ইব্রাহীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফাঁস হওয়া প্রশ্ন খোঁজার মতো সময় আমাদের থাকে না। তবে বিগত বছরে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যেভাবে ভাইরাল হয়েছে, ২০১৮ সালেও তা হলে আমরা না চাইলেও ফাঁস হওয়া প্রশ্ন হাতে চলে আসা কোনো ব্যাপারই হবে না।”
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের ২০১৮ সালের একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর বাবা প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান লেনিনের মতে, যে কোনো একটি বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়া মানেই পুরো বছরজুড়ে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সব বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার বার্তা।
“মেরুদণ্ড বলে কিছু থাকছে না আমাদের সন্তানদের। অসৎ, মিথ্যাবাদী আর কপট একটি প্রজন্ম তৈরি করছি আমরা। এর থেকে বেরিয়ে আসাটা যে কতটা জরুরি, তা সরকারের অনুধাবন করা খুব বেশি প্রয়োজন।”
নতুন পদ্ধতির ভাবনা
শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা বোর্ড কর্তারা প্রশ্নফাঁস রোধে নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করলেও এজন্য তারা দায়ী করছেন শিক্ষকদের।
এই প্রেক্ষাপটে পরীক্ষার দিন সকালে কেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপিয়ে তা দিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা।
“কক্ষটি সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। কোনো ধরনের মোবাইল ফোন বা ডিভাইস রাখা যাবে না সে কক্ষে। রাখলেও তার মাধ্যমে যেন যোগাযোগ করা না যায়। এতে প্রশ্ন বহনের সময় বা কেন্দ্র থেকে ফাঁসের সুযোগ আর থাকবে না।”
নতুন পদ্ধতি নিয়ে কাজ শুরুর কথা জানিয়েছেন ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মন্ত্রণালয় এবং আমরা কাজ করছি। একটি কমিটি কাজ করছে, ওনারা যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেভাবে আমরা কাজ করছি। যা যা করণীয় তা আমরা করছি। কাজ চলছে, ২০১৯ থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যাবে। সেজন্য কাজ চলছে।”
তবে এ পদ্ধতি কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের।
“তবে শিক্ষকই যখন প্রশ্ন ফাঁসকারী, তখন আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্ন পাঠিয়ে কী লাভ?”
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ফাঁসে সংস্কৃতি রোধে প্রয়োজনে পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কয়েকজন অধ্যাপক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “দীর্ঘমেয়াদি সমাধানটা এক বা দুই বছরে সম্ভব নয়। পাবলিক পরীক্ষা তুলে দিতে হবে, এগুলো নকল করতে উৎসাহিত করছে শিক্ষার্থীদের। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা তুলে দিয়ে আবার স্কুলভিত্তিক মূল্যায়ন করতে হবে।
“শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে প্রকৃত সৃজনশীল। শিক্ষণ ও শিখন দুটিই হতে হবে সৃজনশীল। এমসিকিউ প্রশ্ন তুলে দিতে হবে, যেন-তেনভাবে শিক্ষার্থীরা পাশ করছে বলেই আমরা মানসম্পন্ন শিক্ষা পাচ্ছি না।”
“একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রত্যয় ঘোষণা করতে হবে যে, যত বাধাই আসুক তা মোকাবেলা করতে হবে। প্রশ্ন ফাঁসকারীরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের অধ্যক্ষ এম এম সালেহীন বলেন, “জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষাগুলোর আদৌ প্রয়োজন আছে কি না তা দেখতে হবে। ঢেলে সাজানো ছাড়া কোনো উপায় নেই, জেএসসি-পিইসি পরীক্ষা বাদ দিয়ে যদি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ওপর মনোযোগ দেওয়া হয় তাহলে এর কোয়ালিটি এনশিওর করা সম্ভব। বোর্ড যে এক বছরে তিন-চারটি পরীক্ষা মনিটর করে, এর যথাযথ তত্ত্বাবধান কি সম্ভব?”
সংশ্লিষ্টদের ‘মোটিভেশন’ ও ‘প্রণোদনা’ দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রশ্ন পেয়ে শিক্ষার্থীরা সব ক্ষেত্রে শর্টকাট রাস্তা খুঁজছে। এটি প্রতিরোধে পুরো প্রক্রিয়াটাকে পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।”
প্রশ্ন ফাঁস ছাড়াও ভুল প্রশ্নের কারণে বছরজুড়েই সমালোচনায় ছিল বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা। এর মধ্যে জেএসসির ইংরেজি সংস্করণের ‘গার্হস্থ্য অর্থনীতি’ বিষয়ের সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনী প্রশ্নে ১২টি ভুল পাওয়া যায়। পরে পিইসির সিলেট অঞ্চলের ইংরেজি সংস্করণের ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিতি’ বিষয়ের প্রশ্নে অর্ধ শতাধিক ভুল ধরা পড়ে। ওই প্রশ্নপত্রটির ৫০টি নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের মধ্যে ৪০টিতেই ভাষা ও ব্যাকরণগত ভুল ছিল। এসব নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
আরও খবর-