প্রবীণ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান পরামর্শ দিয়েছেন পরীক্ষা বাতিলের।
প্রশ্ন ফাঁস রোধে সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করা বুয়েটের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশ্ন ফাঁস রোধে একটি সমাধানের পথ আছে, কিন্তু এতে তো সমস্যাও আছে।
“পরীক্ষার প্রশ্ন আগে না ছাপিয়ে কেন্দ্রে ছাপানো হবে পরীক্ষার আগ মুহূর্তে। সে কক্ষটিকে আমরা বলি স্ট্রং রুম। সে কক্ষে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না, আর কাউকে বাইরে যেতেও দেওয়া হবে না। তারা কোনো রকম যোগাযোগ রাখতে পারবে না।”
কক্ষটি সিসি ক্যামেরার আওতায় রাখারও পরামর্শ দেন তিনি।
কতক্ষণ আগে প্রশ্ন ছাপাতে হবে, এর জন্য কী কী লাগবে- সে বিষয়গুলো পরীক্ষা পদ্ধতির সাথে সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে ঠিক করা যেতে পারে বলে মনে করেন এই তথ্যপ্রযুক্তি বিশারদ।
“কোনো ধরনের মোবাইল ফোন বা ডিভাইস রাখা যাবে না সে কক্ষে। রাখলেও তার মাধ্যমে যেন যোগাযোগ করা না যায়, সে ব্যবস্থা করে দিতে হবে।”
প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা মোটেও কঠিন বিষয় নয় বলে মনে করেন তিনি।
রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুল খালেকও মনে করেন, পরীক্ষা কেন্দ্রে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠিয়ে দিয়ে পরীক্ষার সকালেই কেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপানো যেতে পারে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতে প্রশ্ন বহনের সময় বা কেন্দ্র থেকে ফাঁসের সুযোগ আর থাকবে না।”
এছাড়াও পৃথক পৃথক জেলা বা বিভাগভিত্তিক প্রশ্ন তৈরি করা গেলেও ঢালাওভাবে সবাই প্রশ্ন পাবে না বলে মনে করেন তিনি।
প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এ শিক্ষক বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় ট্রেজারি থেকে প্রশ্নগুলো আনা হয়, সে প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন বের করার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু সেটা কীভাবে হয়, তা আমাদের ধারণার বাইরে।”
প্রশ্ন ফাঁস শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে মন্তব্য করে চলতি জেএসসি পরীক্ষার একটি কেন্দ্রের সচিব আবদুল খালেক বলেন, “যে প্রশ্ন পেল, সে ভালো ফল করল প্রশ্ন পেয়ে। যে প্রশ্ন পেল না, তার ক্ষোভ তৈরি হল। প্রশ্নের আশায় থেকে প্রশ্ন কমন না পড়লে সে শিক্ষার্থী সমস্যায় পড়ে যাবে।”
এজন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রশ্ন ফাঁসের দিকে নজর না দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এই শিক্ষক বলেন, “যারা প্রশ্ন পাচ্ছে, তারা মনে করছে প্রশ্ন তো পেয়েই যাচ্ছি। তাহলে পড়ালেখার দরকারটা কী? এ রকম একটা চিন্তা চলে আসতেই পারে।”
“সরকার এদের বের করতে পারবে বলে আমি মনে করি এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে যেন আমাদের শিক্ষার মানের ওপর আঘাত না ফেলতে পারে।”
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের অধ্যক্ষ এম এম সালেহীন প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে প্রমাণ না পেলেও পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে শিক্ষার্থীদের জটলা দেখে প্রশ্ন ফাঁস হতে পারে বলে ধারণা করেন।
“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং কিছু লোক সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিপাকে ফেলার জন্যই ব্যাপক হারে প্রশ্ন ফাঁস করছে। আগেও প্রশ্ন ফাঁস হত, কিন্তু এমন ব্যাপক হারে হত না। এখন বিনামূল্যে পর্যন্ত প্রশ্নপত্র বিলি করে যাচ্ছে।"
প্রশ্ন ফাঁসের ফলে শিক্ষার্থীদের ‘নৈতিক স্খলন’ হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীরা খুব অল্প বয়সেই এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে, তার ভেতরের প্রতিভা চিন্তা-শক্তি বোধ সব কিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার চিন্তা-ভাবনা গাইডকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন পেয়ে যাওয়ায় সব ক্ষেত্রে সে শর্টকাট রাস্তা খুঁজছে।
“প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে- এটা সে দেখছে। অর্থাৎ সে একটি অনৈতিক কাজ দেখছে এবং সে শিখছে, কম পড়েও ভালো নম্বর পাওয়া যায়। তার মাথায় তখন ঢুকে গেল যে, কমই পড়ব এখন থেকে।”
এটি প্রতিরোধে পুরো প্রক্রিয়াটাকে পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এ শিক্ষক।
অধ্যক্ষ সালেহীন বলেন, “জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষাগুলোর আদৌ প্রয়োজন আছে কি না তা দেখতে হবে। ঢেলে সাজানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। জেএসসি-পিএসসি পরীক্ষা বাদ দিয়ে যদি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ওপর মনোযোগ দেওয়া হয় তাহলে এর কোয়ালিটি এনশিওর করা সম্ভব। বোর্ড যে এক বছরে তিন-চারটি পরীক্ষা মনিটর করে, এর যথাযথ তত্ত্বাবধান কি সম্ভব?”
পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্টদের ‘মোটিভেশন’ ও ‘প্রণোদনা’ দেওয়ার মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা যাবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশ্ন ফাঁস হলে তো বিপদের কথা। এতে কিছু অসাধু লোক সুবিধা পাবে। বাকীরা তার সাথে পারবে না। যে কোনো অবস্থাতেই এটি বন্ধ হওয়া দরকার। এর ফলে সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
এদিকে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত কোচিং সেন্টার ও শিক্ষকদের কঠিন শাস্তির আওতার আনার দাবি জানান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশ্ন ফাঁস হয়ে থাকলে সেটা তো অনৈতিক বিষয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বোর্ডের যারা এটি নিয়ন্ত্রণ করে তাদের উচিত এটি বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।”