এইচ এম এরশাদের শহর রংপুরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে শোচনীয়ভাবে হারিয়ে দিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী।
Published : 21 Dec 2017, 06:31 PM
দলীয় প্রতীকে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা লাঙ্গল প্রতীকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।
তার চেয়ে ৯৮ হাজার ৮৯ ভোট কম পেয়ে হার মানতে হল আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে। নৌকা প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ৬২ হাজার ৪০০ ভোট।
মেয়র পদে ভোটে তৃতীয় হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা। ধানের শীষ প্রতীকে তার ভোট ৩৫ হাজার ১৩৬।
একটিতে ইভিএমসহ মোট ১৯৩টি কেন্দ্রে দিনভর ভোটগ্রহণের পর গণনা শেষে মধ্যরাতে ফল ঘোষণা করেন এই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার।
তিনি জানান, প্রায় চার লাখ ভোটারের মধ্যে মোট ২ লাখ ৯২ হাজার ৭২৩ জন ভোট দিয়েছেন। ভোটের হার ৭৪ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মোস্তফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার এই বিজয় রংপুরবাসীর উদ্দেশে উৎসর্গ করলাম। অতীতে আমি রংপুরবাসীর পাশে ছিলাম, বর্তমানে আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব।”
আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঝন্টু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার এখানে বলার কিছু নেই। সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। আমি জনগণের রায় মেনে নিয়েছি।”
ভোট গণনা শুরুর সময়ে নির্বাচন ‘বয়কটের’ ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী বাবলা। তার অভিযোগ, ভয়-ভীতি দেখিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে দেওয়া হয়নি। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার সুযোগ নিয়ে কারচুপি করা হয়েছে।
২০১২ সালে অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনেও এই তিনজনই প্রার্থী ছিলেন। তবে সেবার নির্বাচন হয়েছিল নির্দলীয়ভাবে।
সেবার বাবলার নির্বাচন বর্জনের পর ২৮ হাজার ভোটে মোস্তফাকে হারিয়ে রংপুর সিটির প্রথম মেয়র হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য ঝন্টু।
এবার দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সাবেক পৌর চেয়ারম্যান ঝন্টু সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফার মুখোমুখি হন। তারা দুজনই এক সময় ছিলেন জাতীয় পার্টিতে।
ভোটের লড়াইয়ে তার সময়কার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমকেই সামনে ধরে তুলেছিলেন ঝন্টু। তিনি আশাবাদী ছিলেন, উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে তার উপরই ভরসা রাখবে রংপুর নগরবাসী।
অন্যদিকে মোস্তফা তার দলের নেতা এরশাদের ‘ইমেজে’ ভর করে ভোটের লড়াইয়ে উৎরানোর লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “লাঙ্গল মানেই এরশাদ, আর এরশাদ মানেই লাঙ্গল। সিটি এলাকা এরশাদের ঘাঁটি। লাঙ্গলের পক্ষে ভোটের বিপ্লব ঘটবে।”
গণঅভ্যুত্থানে দুই যুগ আগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারাতে হলেও তাতে রংপুর অঞ্চলে এরশাদের জনপ্রিয়তার কমতি ঘটেনি।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ায় ভোটের প্রচারে নামতে না পারলেও গত কয়েকদিন ধরে রংপুরে নিজের বাড়িতেই ছিলেন এরশাদ। বৃহস্পতিবার সকালে ভোটও দিয়েছেন তিনি।
এরশাদ আগেই বলেছিলেন, “আমাদের যে অবস্থা, তাতে রংপুরে আমরা জিতব; বিপুল ভোটে জিতব।”
রংপুর নির্বাচনের পর সংসদ নির্বাচনের কাজে নামার কথাও বলেছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও নানা কারণে পর্যবেক্ষক মহলের চোখ ছিল বছর শেষে রংপুরের এই নির্বাচনের দিকে।
আগামী বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নৌকা, ধানের শীষ ও লাঙ্গল প্রতীকের অংশগ্রহণের এই সিটি নির্বাচনকে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের জন্য ‘এসিড টেস্ট’ও বলা হচ্ছিল।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের একটি মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীম বলেছিলেন, বছর শেষের এ নির্বাচন সরকার, ইসি ও রাজনৈতিক দল সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
“বর্তমান কমিশন কুমিল্লায় শুভ সূচনা করেছে, রংপুরের মধ্য দিয়েই মানুষকে যেন বার্তা দিতে পারে সে লক্ষ্যেই ভোট করতে হবে।”
ইসি মনে করছে, রংপুরে সেই পরীক্ষায় ভালোভাবেই উৎরে গেছে তারা।
ভোট শেষে কমিশনের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এসে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা মডেল নির্বাচন করার কথা আপনাদের বলেছিলাম। রংপুরে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে; একটি মডেল নির্বাচন হয়েছে।”
সরকারে অংশগ্রহণের পাশাপাশি সংসদে বিরোধী দলের আসনে থাকা জাতীয় পার্টি ভোট নিয়ে সন্তুষ্টির কথা আগেই জানিয়েছিল।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এই ভোটের লড়াইকে ‘একই বৃক্ষে বিভিন্ন ডাল-পালা’ বলে আখ্যায়িত করেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী।
আওয়ামী লীগ ও জাপা সরকারের ওই ‘নীলনকশাই’ সিইসি ও রংপুরের স্থানীয় প্রশাসন বাস্তবায়ন করেছে বলে দাবি করেন দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপির এই নেতা।
অন্যদিকে ভোটের ফল ঘোষণার আগেই হার মেনে নিয়ে হাসিমুখেই ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের নেতারা।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “এটাকে আমি বলব, গণতন্ত্রের বিজয়। আমরা এই নির্বাচনের ফলাফলকে গণতন্ত্রের বিজয় হিসাবে দেখছি।”
ইডব্লিউজির আলীম মনে করছেন, রংপুরের ভোট ইসির উপর জনগণের আস্থা বাড়াবে।
“সুষ্ঠু ভোটের জন্য যা যা করা দরকার, তাতে সবার সহযোগিতা ছিল। এ রকম নির্বাচনই মানুষ প্রত্যাশা করে। রংপুরের নির্বাচন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি সব ধরনের অংশীজনের আস্থা বাড়াবে।”
তবে সংসদ নির্বাচনের আগের বছর ইসির অধীনে এই ভোটে আসার পর নির্বাচন শেষে বিএনপির প্রতিক্রিয়া সেই আস্থার প্রশ্নে প্রশ্ন হয়েই থেকে যাচ্ছে।
রংপুরের ভোট নিয়ে আরও খবর