দুই দলের ২২ সুপারিশের অধিকাংশই বিদ্যমান আইনের আলোকে বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ায় নতুন করে সংস্কারের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন ইসি কর্মকর্তারা।
Published : 10 Nov 2017, 07:13 PM
সংলাপ: দলগুলোর ৫৩১ সুপারিশ ইসির কাছে
ফুরফুরে সিইসি আওড়ালেন ‘মানসসুন্দরী’
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে পাওয়া সুপারিশ পর্যালোচনা শুরু করেছে নির্বাচন কমিশনের আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) যেসব সংস্কার আনার সুপারিশ করেছে, প্রথম দফায় সেসব বিষয় নিয়ে বুধবার আলোচনা করেছেন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটির সদস্যরা।
সংলাপে পাওয়া সুপারিশ পর্যালোচনা করতে গিয়ে ইসি কর্মকর্তাদের মনে হয়েছে, প্রধান দলগুলোর বেশিরভাগই আরপিও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ভালোভাবে খতিয়ে দেখেনি। বিদ্যমান আইনে রয়েছে এমন অনেক বিষয় তারা সুপারিশ হিসাবে সংলাপে উপস্থাপন করেছে।
তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাইসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৫টি অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পর্যালোচনায় ইসি দেখতে পেয়েছে, এর মধ্যে তিনটি বিষয় বিদ্যমান আইনেই রয়েছে।
ভোটের সময় নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগসহ আরপিওর বিভিন্ন অনুচ্ছেদে ১৭টি সংস্কার চেয়েছে বিএনপি। এর অধিকাংশই বিদ্যমান আইনে রয়েছে এবং কিছু দাবি পরস্পরের সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’ বলে ইসি কর্মকর্তারা মনে করছেন। সেক্ষেত্রে আরপিও সংস্কার নিয়ে প্রধান দুই দলের অধিকাংশ প্রস্তাব আমলে না নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
সীমানা পুনর্নির্ধারণ, সেনা মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে এই দুই প্রধান দলের অবস্থান বিপরীতমুখী। তবে অনলাইনে মনোনয়ন দাখিল এবং আরপিও বাংলায় রূপান্তরের বিষয়ে দুই দল একমত।
ইসির আইন শাখার যুগ্ম সচিব মো. শাহজাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংস্কার কমিটির পক্ষ থেকে আমরা শুধু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা করছি। আওয়ামী লীগ-বিএনপির ধারাবাহিকতায় অন্য দলগুলোর সুপারিশ নিয়েও বসব। বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়গুলো কমিশনের কাছে তুলে ধরা হবে।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, সংলাপে পাওয়া প্রস্তাবগুলো রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত- এই তিন ভাগে বিভক্ত করে পর্যালোচনা করা হবে।
আরপিওর ৯ (১), ৯০ বি (বি)(খ), ২২ (১), ৩১ ও ৯৪ অনুচ্ছেদ নিয়ে সুপারিশ ছিল ক্ষমতাসীন দলটির।
এর মধ্যে রয়েছে-
>> নির্বাচন পরিচালনায় কেবল প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল কর্মচারীদের মধ্য থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার নিয়োগ করা।
>> তৃণমূলের নেতাকর্মীর মতামতের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই করে দলের মনোনীত প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিধান রাখা।
>> প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের তালিকা, ছবি ও এনআইডি ভোটের তিন দিন আগে রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা দেওয়া এবং ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রে অবস্থান করা বাধ্যতামূলক করা।
>>জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমে ভোট চালু।
>> আরপিও বাংলা অনুবাদ করা।
প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামতের বিষয়য়টি আরপিও’র নিবন্ধন বিধিমালায় রয়েছে। সেই সঙ্গে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও পোলিং এজেন্টদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে প্যানেল প্রস্তুত নির্বাচন পরিচালনা বিধি মেনেই নির্দেশনা দেয় কমিশন।
তবে ইভিএম ও আরপিও’র বাংলা অনুবাদের বিষয়টি সংসদের অনুমোদন ছাড়া সংশোধনের উপায় নেই।
আরপিওর ৫, ৭(৭), ২ (১২), ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৬, ২১, ৩৬, ৩৯, ৪৪ ই, ৮৯ এ অনুচ্ছেদে সংস্কার চেয়েছে দলটি।
এর মধ্যে রয়েছে
>> ভোটের ৯০ দিন আগে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় (স্বরাষ্ট্র, জন প্রশাসন, অর্থ, তথ্য, প্রতিরক্ষা, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, পররাষ্ট্র, কৃষি, স্বাস্থ্য) ইসির নিয়ন্ত্রণে থাকবে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থা চলবে।
>> বিতর্কিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া যাবে না, বদলি ও প্রত্যাহার সম্পূর্ণ ইসির এখতিয়ারভুক্ত থাকবে।
>> একই জায়গায় গত ৫ বছরে ধরে থাকা পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভোটের সময় একই এলাকায় পদায়ন করা যাবে না।
>> কর্মকর্তাদের কারও দলীয় আনুগত্যের প্রমাণ পেলে তাদের প্রত্যাহার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
>> আরপিওতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষাবাহিনীকেও যুক্ত করে ভোটের সময় তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া।
>> ইসির নিজস্ব প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া।
>> প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারদের নিজ ইউপি-পৌরসভা-সিটিতে দায়িত্ব না দেওয়া।
>> নির্বাচনী প্রচারের জন্যে ২১ দিন সময়সহ তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট পর্যন্ত অন্তত ৫০ দিন সময় রাখার বিধান করা।
>> মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় দলের প্রত্যয়ন না নিয়ে প্রত্যাহারের দিন তা জমা নেওয়ার বিধান করা।
>> অনলাইনে মনোনয়ন দাখিলের সুযোগ রাখা।
>> জামানত নগদ না নিয়ে শুধু ড্রাফট/পে অর্ডার/ট্রেজারি চালানের ব্যবস্থা করা।
>> মনোনয়নপত্র জমার সময় প্রস্তাবক-সমর্থকের ব্যক্তিগত উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
>> প্রার্থিতা প্রত্যাহারে প্রার্থীর উপস্থিতি, কারাগারে থাকলে প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা।
>> প্রতিটি সংসদীয় আসনে একজন ইলেকশন এজেন্ট নিয়োগের বিধান করা।
>>প্রতি আসনের ফলাফল প্রার্থী বা প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ঘোষণা করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গেজেট প্রকাশ করা।
>> ভোট গণনার স্বাক্ষরিত বিবরণী প্রত্যেক এজেন্টকে দেওয়া।
>> প্রতি জেলায় কমপ্লায়েন্ট সেন্টার চালু ও অভিযোগ ১২ ঘণ্টার মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান রাখা।
নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ, বদলি-প্রত্যাহারের এখতিয়ার, প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নিজ এলাকায় না রাখা, মনোনয়নপত্র জমার সময় প্রস্তাবক-সমর্থকের উপস্থিতি, সবার উপস্থিতিতে ফল ঘোষণাসহ অধিকাংশ সুপারিশই বিদ্যমান আইনে রয়েছে। সেই সঙ্গে তফসিল ঘোষণার পর পরিপত্র জারির মাধ্যমে মাঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
তবে অনলাইনে মনোনয়ন দাখিল, প্রতিরক্ষাবাহিনীকে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি আরপিও সংশোধনের মাধ্যমেই করতে হবে। কিন্তু ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন ইসি কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, প্রধান দুই দলের সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে আমলে নিয়ে কাজ এগোলে দ্রুত অগ্রসর হওয়া যাবে। ডিসেম্বরের মধ্যে সবার সংস্কার প্রস্তাবগুলো একীভূত করে খসড়া তৈরির পর ফেব্রুয়ারিতে তা চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।