পাঠ্যপুস্তক ‘সাম্প্রদায়িকীকরণ’, পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে নানা অপপ্রচার, ভাস্কর্য অপসারণ, কওমি মাদ্রাসাকে ‘অন্যায্য’ মর্যাদা দানসহ উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে সরকারের আত্মসমর্পণের প্রতিবাদে হতাশ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দেশের বিভিন্ন পেশার নেতৃস্থানীয় নাগরিকরা।
Published : 08 May 2017, 08:36 PM
শিক্ষা, সাহিত্য, চিকিৎসা, গবেষণা, নাটক, গান, নৃত্য, আবৃত্তিসহ সংস্কৃতি অঙ্গনের ৪০৮ জন ব্যক্তির স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়।
হেফাজতে ইসলামের মতো মৌলবাদী সংগঠনের বিভিন্ন দাবি দাওয়া সরকার ‘মেনে নিচ্ছে’ অভিযোগ জানিয়ে শঙ্কিত এই নাগরিকরা বিবৃতিতে প্রশ্ন তুলেন, “এই হেফাজতপ্রীতি কোন বাংলাদেশের ইঙ্গিত দিচ্ছে?”
তারা বলছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সাথে সরকারের আপস ও আত্মসমর্পণের ঘটনায় দেশের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মানুষ ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়া এসব নাগরিকদের আশঙ্কা, ক্ষমতায় থাকার জন্য অথবা যাওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা এবং মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সাথে রাখার যে অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তা দেশকে এক ভয়াল অন্ধকারে নিয়ে যাবে।
হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোর দাবি মেনে নেওয়ায় শিক্ষা, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলোকে ধর্মীয়করণ করে জঙ্গিবাদের ‘উর্বর ক্ষেত্র’ তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
জামায়াত-হেফাজতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ‘এক এবং অভিন্ন’ বলে অভিহিত করে তারা বলেন, বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে দুটি দল অনেকটাই সফল হয়েছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক বিকৃতির অভিসন্ধিকে ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভয়ানক বিস্তার’ হিসেবে দেখছেন তারা।
তারা বলেন, পশ্চাৎপদ ও মৌলবাদের তোষণনীতির কারণেই পাঠ্যপুস্তকে এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে। এ বছরের পাঠ্যপুস্তকের এই পরিবর্তন সেই সাম্প্রদায়িক অপ-রাজনীতির সঙ্গে সরকারের আপসরফারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
তাদের প্রশ্ন, সরকার নিজেকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতাবিরোধী বলে প্রচার-প্রচারণা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বললেও পাঠ্যপুস্তকে কেন এই পশ্চাদপসরণের চিত্র?
তাদের মতে, পাঠ্যপুস্তকের এই সাম্প্রদায়িকীকরণের ঘটনা সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের সাফল্যকে ‘ম্লান’ করে দিয়েছে।
কওমি মাদ্রাসার ‘দাওরায়ে হাদিস’কে স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্সের সমমানের সরকারি স্বীকৃতির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান তারা।
তাদের প্রশ্ন, যে কওমি মাদ্রাসার কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচিতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; তাকে কোন বিবেচনায় মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেওয়া হল?
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহ আহমদ শফী স্নাতকোত্তর সনদে স্বাক্ষর করবেন ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা
হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীকে ‘বিকৃত রুচির’ ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করে তারা বলেন, “আহমদ শফির কর্তৃত্বেই সনদ দেওয়া হবে। তার শিষ্যরা, যারা চিন্তায়-মননে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে গড়ে উঠছে, তারা ভবিষ্যতে দেশের প্রশাসনিক পদগুলো দখলে নেবে- এমন ভাবনায় আমরা শিউরে উঠছি।”
সুপ্রিম কোর্টের প্রবেশ মুখে নির্মিত ন্যায় বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য অপসারণের দাবিটিকে তারা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হিসেবে দেখছেন।
বিবৃতিতে তাদের অভিযোগ, “হেফাজতে ইসলাম দেশের সকল অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও মুক্তিসংগ্রামের সকল স্মারক ও সৌধসমূহকেই মূর্তি আখ্যা দিয়ে ভেঙে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য শহীদমিনার, স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলা, শিখা চিরন্তন।”
সুপ্রিম কোর্টের লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্যটিতে শিল্পমানের ঘাটতি থাকলে দেশের প্রতিভাবান শিল্পীদের দায়িত্বে এর মানোন্নয়নের পরামর্শ দেন তারা।
তারা সরকারের প্রতি মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী ভাবাদর্শের ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তি প্রদানের দাবি জানান। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে ‘কার্যকর’ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর দাতাদের মধ্যে রয়েছেন, প্রাবন্ধিক-গবেষক আহমদ রফিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক কামাল লোহানী, এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ময়মনসিংহের ভাষাসৈনিক আব্দুল আজিজ তালুকদার, কবি নির্মলেন্দু গুণ, প্রাবন্ধিক যতীন সরকার, অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সৈয়দ হাসান ইমাম, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক অজয় রায়, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ড. সফিউদ্দিন আহমদ, শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন, নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা, রবীন্দ্র গবেষক সনৎ কুমার সাহা, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, আবৃত্তিশিল্পী আশরাফুল আলম, চিত্রশিল্পী আবুল বারক আলভী, নাট্যব্যক্তিত্ব রোকেয়া রফিক বেবী, নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসানসহ আরও অনেকে।