হেফাজতের কথায় মনে হয় এটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নয়: নূর

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত ভাস্কর্যকে ‘গ্রিক দেবীর মূর্তি’ আখ্যায়িত করে তা অপসারণের দাবিতে হেফাজতে ইসলাম যে আন্দোলন শুরু করেছে, তার সমালোচনায় মুখ খুলেছেন সরকারের একজন মন্ত্রী।

চট্টগ্রাম ব‌্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2017, 07:15 PM
Updated : 18 Feb 2017, 05:23 AM

সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, “হেফাজত আজকে যেভাবে বলছে, তাতে মনে হচ্ছে এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নয়, মনে হচ্ছে এটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র।”

নারী নীতি ও গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতায় ২০১৩ সালে ঢাকার মতিঝিলে তাণ্ডব চালানো সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নতুন এ তৎপরতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ না দেখে হতাশাও প্রকাশ করেছেন আশি ও নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় নাট‌্যাভিনেতা নূর। 

শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে তীর্যক নাট্য দলের আয়োজনে একুশ স্মরণে ‘নাট্যভাষা বাংলা আমার’ শীর্ষক নাট্য আয়োজনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী।

পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রতিক রদবদলে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির যে অভিযোগ উঠেছে, সে প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “একজন সরকারি কর্মকর্তা আমাকে বললেন, যে পরিবর্তনগুলো নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, আমি বিশদ পড়েছি কি না।

“আমি বলেছি, আমার তো পড়ার দরকার নেই। যে পরিবর্তনকে হেফাজত বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানায়, সেটি আমার না পড়লেও চলে।”

গত বছরের ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে রোমান যুগের ন‌্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’ এর আদলে একটি ভাস্কর্য স্থাপনের পর তা অপসারণের দাবিতে কর্মসূচি দেয় হেফাজতে ইসলাম।

ইসলামী সংগঠনটির একটি প্রতিনিধি দল গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতি বরাবরে একটি স্মারকলিপি দিয়ে আসে। সেখানে ওই ভাস্কর্যকে ‘অনৈসলামিক’ আখ‌্যায়িত করে বলা হয়, “স্বাধীনতার পর থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদের আজ্ঞাবাহী এক শ্রেণির পেইড ও প্রপাগান্ডিস্ট মিডিয়া ও ইসলামবিদ্বেষী সেকুলার অপশক্তি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃহত্তর তৌহিদি জনতার ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ঈমান-আক্বিদার বিরুদ্ধে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

“তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল, পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া নাস্তিক্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদী প্রবন্ধ-নিবন্ধ সংযোজনের দাবিও করছে। সুতরাং আমরা মনে করি, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপনও সেই ধারাবাহিকতারই একটি অংশ।”

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, অসাম্প্রদায়িক সহাবস্থান বাংলাদেশের ঐতিহ‌্য। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান- সাবই শান্তিপূর্ণভাবে যুগের পর যুগ এই ভূখণ্ডে বসবাস করে আসছে এবং যে যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করে আসছে। সরকার কারও ধর্ম পালনের বিরুদ্ধে নয়।

“আমাদের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ভবনের সামনে যে ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে, যে ভাস্কর্যটি আন্তর্জাতিকভাবে ন্যায়বিচারের প্রতীক এবং পৃথিবীর বহু দেশে এ ভাস্কর্য আছে, সেটি নিষিদ্ধ করার জন্য তারা (হেফাজত) উঠে পড়ে লেগেছে।

তার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রতিবাদের ভাষা ‘যথেষ্ট শক্তিশালী’ হয়েছে কি না- সেই প্রশ্ন রেখে মন্ত্রী বলেন, “আমি তো তা দেখি না। আমি তো তা মনে করছি না। তাহলে এই যে সংস্কৃতি চর্চা, এটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। ক’দিন পরে তো আপনি এখানে নাটক করতে পারবেন না। এখানে তারা সমাবেশ করবে। আপনি গান গাইতে পারবেন না, আপনি কবিতা আবৃত্তি করতে পারবেন না।”

চট্টগ্রামের নাট‌্যকর্মীদের সামনে আসাদুজ্জামান নূর প্রশ্ন রাখেন, “সংবিধান রক্ষার জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হব না? আমাদের ভূমিকা পালন করব না, যে ভূমিকা ৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষ পালন করেছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে?

“বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক শ্লোগান- জয় বাংলা, সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল। আমরা তো সেই শক্তি মনে হয় হারিয়ে ফেলছি। হারিয়ে ফেললে ক্ষতি আমাদের। সেটা হয়ত এ মুহূর্তে বুঝতে পারছি না।”

তবে এই দেশে শাহবাগের গণজাগরণমঞ্চ সম্ভব হওয়ায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হওয়ায়, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্ভব হওয়ায় এখনও আশা হারাননি বলে জানান নূর।

“আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে অসাধারণ সাহসী ভূমিকার পরিচয় দিয়েছেন। বলা হয়েছে, যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা আপসহীন। এটি আমাদের সরকার প্রধানের দৃপ্ত ঘোষণা। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এই শক্তিগুলোকে প্রতিহত করার জন্য আমরা কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারব না? কেন আমরা একটা লড়াইয়ে নামতে পারব না?”

সম্প্রতি ঢাকার উত্তরায় সংঘবদ্ধ কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং এক স্কুলছাত্রের খুন হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে মন্ত্রী সন্তানদের ‘প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে’ অভিভাবকদের মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দেন।

তিনি বলেন, “এ ঘটনাগুলো ঘটছে কেন? এগুলো এখনো তেমন সংখ্যায় ঘটছে না বলে আমরা ধাক্কাটা খাচ্ছি না। কিন্তু যে কোনো সময় ধাক্কাটা খাব, ধাক্কাটা লাগবে।”

হলি আর্টিজান, শোলাকিয়া ঈদগাহে জঙ্গি হামলার মত ঘটনা বাংলাদেশে ঘটনার ‘কথা ছিল না’ মন্তব‌্য করে নূর বলেন, “আমরা বিস্ময় এবং বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করলাম- হলি আর্টিজানে মাত্র পাঁচটি ছেলে ঠাণ্ডা মাথায় ২০ জন মানুষ হত্যা করল। নারী ছিল, অন্তঃসত্ত্বা নারী ছিল।

“তারা হত্যা করল ঠাণ্ডা মাথায়, ইসলামের নামে, ধর্মের নামে। চারিদিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রক্তাক্ত মৃতদেহগুলো পড়ে আছে। তার মধ্যে বসে তারা চা-পানি খাচ্ছে। বাবুর্চিকে বলছে, ‘চিংড়ি মাছ দিয়ে টমেটো দিয়ে রান্না কর। আমরা রাতের খাবার খাব’।”

নূর বলেন, “এরা কি মানুষ? এরা তো দানব। এরা তো কোনো ধর্মের নয়, এরা এ সমাজের নয়, পৃথিবীর নয়, অথচ এরা তো আমাদের মধ্যেই জন্ম নিচ্ছে।”

পাঁচ দিনের এ নাট্য আয়োজনের উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমির সভাপতি মনোজ মিত্র। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ ও তীর্যক দল প্রধান আহমেদ ইকবাল হায়দার বক্তব‌্য দেন।