চার বছর পেরিয়ে গেলে ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের একটি মামলারও বিচার শুরু হয়নি।
Published : 04 May 2017, 10:06 PM
কয়েকটির অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও মামলাগুলোর অধিকাংশই এখনও তদন্তাধীন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাণ্ডবের নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের অনেককে চিহ্নিত করা গেছে বলে দাবি করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, যিনি এখন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন।
তবে তাণ্ডবকারীদের সবাইকে এখনও চিহ্নিত করতে না পারার কথা স্বীকার করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সেদিনের ঘটনা নিয়ে পুলিশের করা অর্ধ শতাধিক মামলার কোনোটিতেই আসামির তালিকায় নেই হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর নাম।
শফীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক এবং কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি, সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভাস্কর্য অপসারণের ঘোষণা আসার পর হেফাজতের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর অগ্রগতি নিয়ে সংশয়ী অনেকে।
তখন হেফাজতের কর্মসূচির বিরুদ্ধে নামা একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হেফাজতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর পুলিশ এদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে আগ্রহী হবে না, এটা খুবই স্বাভাবিক।
তবে পুলিশ তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দাবি করে মনিরুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে প্রচুর সংখ্যক মানুষের আগমন ঘটেছিল। কোন ঘটনায় কারা সরাসরি জড়িত, তা নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।
“সেখানে কার কী ভূমিকা ছিল, সারাদেশ থেকে যেহেতু মানুষ এসেছে তাদের পরিচয় কী ছিল, কার কী ইনডিভিজ্যুয়াল রেসপনসিবিলিটি ছিল, কালেকটিভ রেসপনসিবিলিটি কী ছিল, সেগুলো বের করতে সময় লাগছে।”
অন্যদিকে হেফাজত নেতারা এই মামলাগুলোকে হয়রানিমূলক দাবি করে বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের সংগঠনের প্রধান শফীর বৈঠকের সময় মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তারা।
যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ আন্দোলন আন্দোলন শুরুর পর ২০১৩ সালে নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে সক্রিয় হয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজত।
১৩ দাবি আদায়ে ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় হেফাজতের নেতা-কর্মীরা।
দিনভর তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলে। তখন মতিঝিল, পল্টন ও আশপাশ এলাকায় ফুটপাতের শত শত দোকান ভাংচুর অগ্নিসংযোগ করে তারা। তাণ্ডবের শিকার হয় আশপাশের অনেক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা।
রাতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানে হেফাজতকর্মীদের তুলে দেওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সেদিন হেফাজতের তাণ্ডবে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ৩৯ জন নিহত হন।
মামলার হাল
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সেদিন ঘটনায় ঢাকাসহ পাঁচ জেলায় মোট ৮৩টি মামলা হয়, যাতে আসামি করা হয় ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে।
আসামির তালিকায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। আসামিদের মধ্যে হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিশ, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীদের নামও রয়েছে।
এসব মামলার মধ্যে পুলিশ ১৫টিতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। এর মধ্যে কেবল বাগেরহাটে একটি মামলার বিচার শেষ হয়েছে, তাতে সব আসামি খালাস পেয়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর রমনা, মতিঝিল, ওয়ারী, তেঁজগাও এলাকায় মোট ৫৩টি মামলা হয়েছিল। তার মধ্যে চারটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, বাকি ৪৯টি মামলা তদন্তাধীন।
পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল বলেন, সেদিনের সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের প্রত্যেকটি ঘটনায় আলাদা আলাদা মামলা হয়। অধিকাংশ মামলাই তদন্তাধীন।
তিনি বলেন, “ওইসব ঘটনার পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদানকারীদের অনেককেই চিহ্নিত করা গেছে। সরাসরি যারা ফুট সোলজার হিসেবে কাজ করেছে, তাদের সবাইকে চিহ্নিত করা যায়নি।”
সেদিন পুলিশ কর্মকর্তা এসআই শাহজাহান হত্যাকাণ্ডের মামলাটির তদন্তও এখনও শেষ হয়নি।
মনিরুল বলেন, “এসআই শাহজাহান হত্যার ঘটনায় কয়েকজন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এসেছে। বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের নাম এসেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
“যারা নির্দেশনা দিয়েছেন তাদের কারও কারও নাম এসেছে। সরাসরি থেকে যারা ঘটনায় অংশ নিয়েছেন তাদের অনেককেই চিহ্নিত করা যায়নি।”
ট্রাফিক পুলিশ ফাঁড়িতে একজন কনস্টেবলকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার মামলাটিও তদন্তাধীন।
“আমরা চেষ্টা করছি এসব মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করে তা নিষ্পত্তি করার,” বলেন মনিরুল।
আদালত পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কোনো মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
ঢাকার ঘটনার পরদিন ৬ মে হেফাজতের ডাকা সড়ক অবরোধে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন। সে ঘটনায় পুলিশ ৫৩ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা ৪-৫ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করে। ওই মামলার তদন্ত শেষ হয়নি বলে হাটহাজারী থানা পুলিশ জানিয়েছে।
বাগেরহাটে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হেফাজতের দুজন কর্মী নিহত হন। এ ঘটনায় ফকিরহাটে চারটি ও বাগেরহাট সদর থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। এতে হেফাজত, জামায়াত ও স্থানীয় বিএনপির ৮৮ জন নেতা-কর্মীসহ ১০-১২ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
ফকিরহাট থানায় করা মামলাটির রায়ে সাক্ষীর অভাবে সব আসামি খালাস পান। হেফাজত, জামায়াত ও বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের আসামি করে অন্য পাঁচটি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে জমা পড়েছে।
নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর-শিমরাইল এলাকায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবির সংঘর্ষ ও নিহতের ঘটনায় সাতটি মামলা হয়। এর একটি করেন একজন বাস মালিক, অন্যগুলো করে পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মঈনুল হক বলেন, ইতোমধ্যে পাঁচ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি দুই মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।
‘মিথ্যা মামলায় হয়রানি’
হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, ওই সময়ের মামলাগুলোতে তাদের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১০/১৫ দিন আগে ময়মনসিংহ জেলা হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শহীদুল্লাহ সরকারকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়। এখনও তার কোনো সন্ধান মিলছে না।
“কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জ হেফাজতে ইসলামের সভাপতি মাওলানা ফেরদৌস রহমানকে গোয়েন্দা পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল। পরে তাকে আদালতে হাজির করা হয়।”
চার বছর আগের মামলাগুলোতে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাসহ অন্তত ২০০ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জানিয়ে ইসলামাবাদী বলেন, তারা প্রত্যেকেই জামিনে রয়েছেন।
“মিথ্যা মামলা দিয়ে দেশের আলেম-ওলামাদের উপর এভাবে নির্মম নির্যাতনের ঘটনা আগে কোনোদিন দেখা যায়নি।”
বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায়ও পুলিশ হেফাজত নেতা-কর্মীদের আসামি করেছে বলে অভিযোগ সংগঠনটির নেতাদের।
সেদিন হেফাজতের কর্মসূচিতে বর্তমান সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টি এবং সরকারবিরোধী দল বিএনপিও সমর্থন দিয়েছিল।
ইসলামাবাদী বলেন, “জাতীয় পার্টিসহ সরকারের অনেকেই আমাদের সহযোগিতা করেছিল। আইন তো সবার জন্যই সমান। তবে তাদের বিরুদ্ধে তো কেউ কোনো মামলা করল না।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হেফাজত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ওই আন্দোলন করেনি। যারা ইসলাম অবমাননা করে, আন্দোলন ছিল তাদের বিরুদ্ধে।
সরকারের সঙ্গে হেফাজতের কোনো চুক্তি বা সমঝোতা হয়নি বলে জানান ইসলামাবাদী।
তিনি সেইসঙ্গে বলেন, “এদেশের নাগরিক হিসেবে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হেফাজতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা সম্প্রতি বৈঠক করেছেন। তারা ওই সময়ে করা মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন।”
‘হেফাজত এক চুলও সরেনি’
হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে এখন প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করলেও এই সংগঠনটি নারীবিরোধী, প্রগতিবিরোধী অবস্থান থেকে এক চুলও সরেনি বলে সরকারকে সতর্ক করেছেন শাহরিয়ার কবির।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হেফাজতের লক্ষ্য হল মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন ধ্বংস করে দেওয়া। তারা তাদের ১৩ দফা থেকে এক চুলও সরে আসেনি।
“ওই দফা দিয়ে তারা বাংলাদেশকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চাইছে। তারা ১৩ দফার জন্য জনমতও তৈরি করছে।”
হেফাজত আমির শফীর একাত্তরের ভূমিকা তুলে ধরে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “২০১৩ সালের তাণ্ডবের পর একটা শ্বেতপত্র বের করেছিলাম, সেখানে লিখেছি আহমদ শফীসহ শীর্ষ নেতারা একাত্তরে কীভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল।
“তারা মুজাহিদ বাহিনী গঠন করেছিল। তারা নেজামে ইসলামের নেতা ছিলেন। বঙ্গব্ন্ধু সাংবিধানিকভাবে নেজামে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।”
আওয়ামী লীগ সরকারের হেফাজতের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “যদিও সরকার বলছে হেফাজতের সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি, তবে হেফাজতের প্রধান আহমদ শফীর সঙ্গে তাদের বৈঠক তো হয়েছে।
“তাদের সঙ্গে বৈঠকের অর্থ হল সমঝোতা না হলেও এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা তাদের দেওয়া হয়েছে।”