ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সভাপতি সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সমর্থকরা নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়ি-মন্দিরে হামলার নেপথ্যে ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
Published : 10 Nov 2016, 09:32 PM
নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরে এবার আগুন
স্পষ্ট হয়েছে, সাম্প্রদায়িকতার হোতা আ. লীগ: বিএনপি
আ. লীগে শুদ্ধি অভিযান চালানো উচিত: শামসুজ্জামান খান
নাসিরনগরের ইউএনও মোয়াজ্জামকে প্রত্যাহার
নাসিরনগরে প্রশাসনের গাফিলতি দেখছে ১৪ দল
‘নাসিরনগরে হামলার নেপথ্যে রাজনৈতিক খেলা’
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে নাসিরনগরের এমপি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের সঙ্গে মোকতাদির ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের দ্বন্দ্বই হামলার নেপথ্য কারণ হিসেবে উদঘাটিত হয়েছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের বিরোধ দীর্ঘদিনের। উপজেলা আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় মন্ত্রী ছায়েদুল হকের কথায়। গত মার্চে ইউপি নির্বাচন কেন্দ্র করে বিরোধ তুঙ্গে উঠে।
এর জের ধরে ছায়েদুলকে উপদেষ্টার পদ থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করে জেলা আওয়ামী লীগ। বহিষ্কার করা হয় নাসিরনগর উপজেলা সভাপতি রাফি উদ্দিনকেও।
ইউপি নির্বাচনের বিরোধের কথা তুলে ধরে নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবদুল গাফ্ফার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মন্ত্রী সাহেবকে বিপদে ফেলার জন্য এ হামলা।”
হামলার মূল হোতা হিসেবে হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখির কথা উঠে এসেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে। কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত তার এলাকা থেকে ট্রাকে করে মানুষ এসে হামলা চালায় নাসিরনগরে।
জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের নাসিরনগরে পাঁচদিনের ব্যবধানে হিন্দুদের বাড়ি-মন্দির দুই দফা আক্রান্ত হওয়ার পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক ও সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবুল হাসেম, হরিপুর ইউনিয়ন সভাপতি ফারুক মিয়া ও চাপরতলা ইউনিয়ন সভাপতি সুরুজ আলীকে সাময়িক বহিষ্কার করে জেলা আওয়ামী লীগ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে হামলায় এই নেতাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, মন্ত্রীর অনুসারী হওয়ায় জেলা সভাপতি উবায়দুল মোকতাদিরের উদ্যোগে এই নেতাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা মোকতাদির ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর পিএস ছিলেন। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের ভগ্নিপতি তিনি।
হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনায় নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য মোকতাদির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নাসিরনগরে মন্ত্রী মহোদয়ই সব। আঁখির সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। তাকে যখন মনোনয়ন দেওয়া হয়, তখন আমি দেশের বাইরে ছিলাম।”
উপজেলার মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বিরোধের কথা স্বীকার করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুন বলেন, “এমপি সাহেব (ছায়েদুল) সেখানে সর্বেসর্বা। কেন্দ্র ও জেলা কমিটির কোনা কর্মসূচি তারা পালন করেন না। এমপি উপস্থিত হওয়া ছাড়া কোনো প্রোগ্রাম হয় না। এমনকি জাতীয় শোক দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচিও নাসিরনগর উপজেলা পালন করে না।”
আঁখির এলাকা থেকে এসে হামলা
১৩ কিলোমিটার দূরের হরিপুর ইউনিয়ন থেকে ১৪ থেকে থেকে ১৫টি ট্রাক ভরে মানুষ আসার পর হামলা হয় নাসিরনগরের হিন্দু পল্লীতে। যেসব ট্রাকে চড়ে হামলাকারীরা এসেছিল সেগুলোর ব্যবস্থা ও অর্থের যোগান চেয়ারম্যান আঁখি দিয়েছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানিয়েছেন।
জেলা যুবলীগের সাবেক সদস্য আঁখির বর্তমানে কোনো পদ নেই আওয়ামী লীগ বা এর কোনো সহযোগী সংগঠনে। তিনি সমবায় সমিতির মালিক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মদ ব্যবসায়ী হিসাবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে।
এছাড়া হরিপুরের হরিণবেড় বাজারের যে দোকান থেকে রসরাজ দাসের ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে কথিত ধর্ম অবমাননার ছবি পোস্টের খবর পাওয়া যায় এবং লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করা হয় তার মালিক জাহাঙ্গীরও চেয়ারম্যানের অনুসারী।
ট্রাকে করে বহিরাগতরা পৌঁছার পর নাসিরনগর কলেজ মোড়ে চলতে থাকা সমাবেশের লোকজন তাদের সঙ্গে মিশে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ শুরু করে বলে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রত্যক্ষদর্শী নাসিরনগরের একটি দোকানে বসে এই প্রতিবেদকের কাছে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন।
“তারা হিন্দুপাড়ার দিকে যেতে থাকলে সমাবেশের একটা অংশও তাদের সঙ্গে মিলে হামলা চালায়। কলেজ মোড়ের অদূরে দত্তবাড়ির মন্দির থেকে হামলা শুরু হয়।”
তবে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের উপজেলা আহ্বায়ক রেজাউল করিম রেনু দাবি করেছেন, তাদের সংগঠনের কেউ হামলা চালাতে যায়নি।
“দোয়া-মোনাজাত দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষ হয়েছে। এখান থেকে কেউ হামলা চালাতে যায়নি। বরং ঠেকাতে গিয়ে কয়েকজন আহতও হয়েছে,” বলেন তিনি।
হামলার ঘটনাক্রম
শনিবার-২৯/১০/২০১৬ # রসরাজের ফেইসবুকের বিষয় জানাজানি সকাল ১১টায় # রসরাজ আটক- বেলা আড়াইটায় # রসরাজকে পুলিশে সোপর্দ-বিকাল ৩টা # হরিণবেড় বাজারে মিছিল-সমাবেশ- পৌনে ৬টা # হরিপুর এলাকায় মাইকিং শুরু- বিকাল সাড়ে ৪টা # নাসিরনগরে মিছিল- পৌনে ৬টা # নাসিরনগরে মাইকিং শুরু-সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা
| রোববার-৩০/১০/২০১৬ # হরিণবেড় বাজারে জমায়েত শুরু- সকাল সাড়ে ৮টা # রসরাজের গ্রামে প্রথম ভাংচুর- সকাল ৯টা # ট্রাকে চড়ে নাসিরনগরের উদ্দেশে যাত্রা- পৌনে ১১টার দিকে নাসিরনগরে সমাবেশ # আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-নাসিরনগর কলেজ মোড়- ১১টা থেকে ১টা # হেফাজতে ইসলাম-আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠ-সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা # হিন্দু বাড়িতে হামলার শুরু- দুই সমাবেশস্থল থেকেই, বেলা ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে।
|
সমাবেশ চলার মধ্যে ট্রাকে করে হরিপুরের দিক থেকে লোকজন এসেছিল জানিয়ে কচুয়া দরবার শরীফের এ পীর বলেন, “সকাল ১০টার দিকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সমাবেশ শুরু করতে ১১টা বেজে গিয়েছিল। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ছিল। আমাদের এখানে জেলার এডিশনাল এসপি, ইউএনও, ওসি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সার্বক্ষণিক ছিলেন। তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের জন্য প্রশংসাও করেছেন।”
আহলে সুন্নতের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে এই বিষয় নিয়ে নাসিরনগরের আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সমাবেশ চলছিল তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে। তাদের সমাবেশ থেকেও লোকজন গিয়ে হিন্দু পল্লীতে হামলায় অংশ নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
তবে তৌহিদী জনতা’র উপজেলা আহ্বায়ক মুফতি ইসহাক আল হোসেইন বলছেন, তাদের সংগঠনের নেতাকর্মীরা নয়, কিছু ‘অনুপ্রবেশকারী’ সমাবেশ থেকে হামলায় গিয়েছিল।
“আমরা সমাবেশের মধ্যে ছিলাম। সকাল ১০টা থেকে শুরু করে ১২টার দিকে শেষ করে দেই। শান্তিপূর্ণভাবে এলাকা ছেড়ে গিয়েছি আমরা।”
হামলাকারীদের বহন করে আনা ওই সব ট্রাক ভাড়া করার ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান আঁখির সংশ্লিষ্টতার কথা তুলে ধরে ইউপি নির্বাচনে তার কাছে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন হারানো ফারুক মিয়া বলেন, ঘটনার দিন রোববার মাধবপুর ট্রাক স্ট্যান্ড থেকে ট্রাক ভাড়া করে সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরের হরিপুর থেকে লোক নিয়ে যাওয়া হয় নাসিরনগর সদরে।
মাধবপুর ট্রাক স্ট্যান্ড থেকে ভাড়ায় দুটি ট্রাক সরবরাহকারী নুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অন্তত ১৫টি ট্রাক মাধবপুর থেকে যায়।
“ইউনিয়ন পরিষদ থেকে টাকা দেওয়া হয়েছিল। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তো আঁখি সাহেব।”
আঁখির ইউনিয়ন হরিপুরের বাসিন্দা এ ট্রাক মালিক বলেন, তার দুটি ট্রাকের ভাড়া দেওয়া হয়েছিল দুই হাজার টাকা করে।
আঁখির কর্মী দোকানদার জাহাঙ্গীর ও সুজন পাঠান মটর সাইকেলযোগে গিয়ে ট্রাকগুলো নিয়ে আসেন বলে জানান হরিপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী আমরু মিয়া।
রসরাজের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে ‘আসামিকে আটককারী’ হিসাবে যে পাঁচজনের নাম এসেছে তাদের মধ্যে শঙ্করাদহ এলাকার ইসমাইলও আঁখির অনুগত বলে জানান তিনি।
চেয়ারম্যান আঁখি ট্রাক ভাড়ায় নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও জাহাঙ্গীর ও সুজন যে তার কর্মী তা স্বীকার করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে।
তিনি বলেন, “কারা ট্রাক ধরাইছে আমি জানি না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।”
হিন্দুদের এলাকা ছাড়তে বলেছিলেন আঁখি
হামলার আগের দিন শনিবার রসরাজের নামে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ছড়ালে এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হয়। এ সময় চেয়ারম্যান আঁখি হিন্দু প্রধান ওই গ্রামের বাসিন্দাদের এলাকা ছেড়ে যেতে বলেন। তার কথা শুনে অনেক পুরুষ আশপাশের এলাকায় গিয়ে হামলা থেকে রক্ষা পেলেও তাদের বাড়ি-ঘর ছাড় পায়নি।
হরিণবেড়ের বাসিন্দা অজয় বর্ধন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চেয়ারম্যান কালী পূজা দেখতে শনিবার রাতে এলাকায় এসে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন।
“চেয়ারম্যান সাব নিরাপদ জায়গায় চলে যাইতে কইছিলেন। আমি রাতে না গিয়ে পরদিন সকাল ১০টায় বাড়ি থেকে চলে গেছি।”
আঁখির কথামতো রাত আড়াইটার দিকে পাশের হাছানপুর গ্রামে চলে যাওয়ার কথা জানান একই গ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী অতীন্দ্র চন্দ্র দাস।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আঁখি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এলাকা ছেড়ে যেতে বলি নাই। শনিবার দিন রাতে কালীপূজা দেখতে গিয়া তাদের শুধু নিরাপদে থাকতে বলছি।”
‘রাজাকার’ পরিবারের দ্বন্দ্ব
স্থানীয় নেতারা জানান, গত মার্চে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময় উপজেলা আওয়ামী লীগ ১৩ ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে প্রার্থীদের তালিকা কেন্দ্রে পাঠায়।
মন্ত্রী ছায়েদুলের পরামর্শে এসব প্রার্থী বাছাই হয় জানিয়ে সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি গাফফার বলেন, এখানে জেলা নেতাদের কোনো কথা না রাখায় বিরোধের শুরু হয়।
জেলা কমিটির নেতাদের বক্তব্য ছিল, ফারুকের বাবা তাজুল ইসলাম ওরফে তাইজুদ্দিন একাত্তরে রাজাকার হিসেবে যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত ছিলেন। আর মন্ত্রী ছায়েদুল হক একক সিদ্ধান্তে একজন ‘রাজাকারপুত্রকে’ দলের মনোনয়ন দিচ্ছেন।
এ নিয়ে সে সময় মিছিল-সমাবেশও হয়। তবে তার জায়গায় যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল সেই আঁখির এক দাদাও রাজাকার ছিলেন বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজলজ্যোতি দত্ত বলেন, “একজনকে সরিয়ে আরেকজনকে দিয়েছে- দুজনেরইতো প্রায় একই রকম অবস্থা। একজন রাজাকারের ছেলে, আরেকজন নাতি।”
তিনি বলেন, “মন্ত্রী সাহেব মনোনয়ন দিয়েছেন। সেটা বাদ পড়ে অভিযোগ ওঠার পর। একচুয়ালি ধরতে গেলে তো দুইজনই রাজাকারের বংশধর।”
আঁখির দাদার ভাই দরবেশ মিয়া রাজাকার ছিলেন বলে জানান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলার সভাপতি জয়তুল হোসেনও।
’ইন্ধনদাতা’ চারজনও জেলা নেতৃত্ব ঘনিষ্ঠ
হামলার ইন্ধনদাতা হিসাবে নাসিরনগর উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এটিএম মনিরুজ্জামান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আবদুল আহাদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উপজেলা সভাপতি আদেশচন্দ্র দেব এবং জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী বিউটি কানিজ সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন স্থানীয় নেতাদের।
ওই চারজনের মধ্যে মনিরুজ্জামান সরকার বাদে অন্যরা সরাসরি জেলা সভাপতি উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মামুন সরকারের ঘনিষ্ঠ এবং মন্ত্রী ছায়েদুল হক বিরোধী হিসেবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত।
হামলায় তাদের ইন্ধনের কথা বলেছেন উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আটজন নেতা, যাদের মধ্যে এ ঘটনায় বহিষ্কৃত তিনজনও রয়েছেন।
সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম বলেন, “ইন্ধনদাতারা সব মন্ত্রীর বিরুদ্ধের লোক। উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান সরকার, আওয়ামী লীগ নমিনেশন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সদর ইউনিয়নে ভোট করে হেরে যাওয়া আবদুল আহাদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি আদেশচন্দ্র দেব এই ইন্ধনদাতাদের মধ্যে রয়েছে।”
তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “হামলায় বিএনপি-জামায়াতের লোক আছে, মন্ত্রী সাহেবের এগেইনস্টের লোক আছে। আঁখি চেয়ারম্যান আছে, টাকার বিনিময়ে নমিনেশন নিয়েছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় গণসংযোগ করতেছে, যোগাযোগ করতেছে। ডাইরেক্ট না, ইনডাইরেক্টও আছে। চক্রান্ত করতেছে।”
এই চারজনের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান এলাকায় মন্ত্রীর পক্ষে বলে পরিচিত হলেও তাকে সন্দেহ করছেন স্থানীয় নেতারা।
এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবদুল গাফফার বলেন, ইউপি নির্বাচনে প্রার্থিতাকে কেন্দ্র করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রাফি উদ্দিনকে সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কার করে জেলা আওয়ামী লীগ। তবে উপজেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দুইজনের স্বাক্ষরেই প্রার্থী মনোনয়নের সুপারিশ করা হয়েছিল।
মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ সম্পর্কে জেলার সাধারণ সম্পাদক মামুন সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে ভুল স্বীকার করেছিল, এ কারণে।”
ইন্ধনদাতা হিসেবে নাম আসা আবদুল আহাদ মন্ত্রী ছায়েদুলের বিরোধী হওয়ায় উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হয়েও নতুন কমিটিতে কোনো পদ পাননি বলে জানান গুণিয়াক ইউনিয়নের প্রবীণ আওয়ামী লীগ কর্মী শহিদুল হক।
গত ইউপি নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে হেরে যান আহাদ। তাকে মন্ত্রীবিরোধী হিসাবেই জানেন এলাকাবাসী।
হামলায় ইন্ধনদাতা হিসাবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হাসেমের অভিযোগ প্রসঙ্গে আহাদ বলেন, “উনি মন্ত্রী সাহেবের আপন ভাতিজী জামাই, আবার ভাইগনা। স্বজনপ্রীতির কারণে, আত্মীয়তার কারণে আমি বাদ পড়ছি। ঘটনার দিন একটা গ্রুপ মিটিং করে, আরেক গ্রুপ হামলা চালাতে যায়। মিটিংয়ের অনুমতি না দিলেতো হামলার ঘটনা ঘটত না।”
ওই ঘটনার একটি ভিডিওতে সদর ইউপি চেয়ারম্যান হাসেমকে হামলাকারীদের মিছিলের সামনে দেখা গেছে। এ বিষয়ে হাসেমের দাবি, তিনি ফেরাতে গিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আহাদ বলেন, “যারা মিছিলে গেছে তাদের অনেকে আওয়ামী লীগ করলেও সুন্নি আকিদার মানুষ। আহলে সুন্নতের মিছিল থেকে যেহেতু হামলা হয়েছে, আর হাসেমও সুন্নি তরিকারই, সেহেতু তার সংশ্লিষ্টতা থাকা স্বাভাবিক।”
তিনি বলছেন, মিছিলকারীদের সঙ্গে মিলে হরিপুর, হরিণবেড় ও হবিগঞ্জের মাধবপুর এলাকা থেকে আসা লোকজন ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
“প্রথমে দত্তবাড়ি দিয়ে হামলার শুরু হয়। আমি মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম। ঘটনা শোনার পর সেখানে যাই। এরপর কাশীপাড়ায় হামলা ঠেকাতে গেলে মিছিলের লোকরা আমাকে আঘাতও করে।”
সন্দেহ হিন্দু নেতাকেও
প্রথম দফায় ৩০ অক্টোবর হামলার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও নাসিরনগরে পুলিশ মোতায়েনের মধ্যে ৪ নভেম্বর ভোররাতে হিন্দু পল্লীর কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনার পিছনে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উপজেলা সভাপতি আদেশচন্দ্র দেবকে সন্দেহের কথা বলছেন কেউ কেউ।
হামলার প্রতিবাদে ৪ নভেম্বর কেন্দ্র ঘোষিত মানববন্ধন কর্মসূচির প্রস্তুতি নেয় নাসিরনগরে পূজা উদযাপন পরিষদ এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ। তবে আগের রাতে দুই সংগঠনের নেতাদের ওই কর্মসূচি পালন থেকে বিরত থাকতে বলেন মন্ত্রী ছায়েদুল হক।
একজন ইউপি চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পশ্চিমপাড়ায় সাগরদাসের বাড়ির পরিত্যক্ত মন্দিরে আগুন দেওয়ার সময় একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘ছায়েদ্দা (ছায়েদুল হক) মানববন্ধন করতে দিবা না, এবার ঠেলা সামলাও।’
মন্ত্রী হিন্দুদের ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলেছেন বলে যে কথা প্রচার হয়েছে তার জন্য আদেশচন্দ্রের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন ছায়েদুল হক।
তিনি বলেন, “আদেশচন্দ্রসহ আরও কিছু বেঈমান লোক দলে ভিড়তে চায়। যারা বেঈমান তাদের নেই নাই, নিবও না।”
এই আদেশচন্দ্র বর্তমানে উপজেলা বিএনপির সভাপতি একরামুজ্জামানের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু পরিষদে সক্রিয় ছিলেন বলে জানান নাসিরনগরের আওয়ামী লীগকর্মী সবুজ মিয়া।
সবুজের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৯৯ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করা ব্যবসায়ী একরাম ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনে নৌকার টিকেট না পেয়ে কুলা মার্কায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন। পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ২০০৮ সালে ধানের শীষে নির্বাচন করে ছায়েদুল হকের কাছে অল্প ব্যবধানে হারেন তিনি।
পরবর্তীতে একরামুজ্জামানের সঙ্গে থাকা অনেকে উপজেলা আওয়ামী লীগে ভিড়লেও আদেশচন্দ্রের জায়গা হয়নি বলে জানান গুণিয়াক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মী শহিদুল।
সন্দেহের মুখে থাকা কানিজের দুই ভাই গ্রেপ্তার
নাসিরনগরের ভুড়েশ্বর ইউনিয়নের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা তাহের মিয়ার মেয়ে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক বিউটি কানিজকেও হামলায় ইন্ধনদাতা বলছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।
হামলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তার ভাই ফারদিন তাহের রাহুল নিজাম ও মামাতো ভাই সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “ঘটনার পরদিন আমি আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নাসিরনগরে যাই। আমার সঙ্গে ওইদিন যারাই ছিল তাদের সবাইকে ফোন করে পুলিশ গ্রেপ্তারের করা হবে এমন কথা বলছে। এটা কেন?”
কয়েক মাস আগে এলাকায় মাদকবিরোধী সমাবেশ করতে গেলে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা তাদের ব্যানার-ফেস্টুন পুড়িয়ে দেয় বলে অভিযোগ করেন কানিজ।
জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ
হামলার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি জেলা পুলিশের বিরুদ্ধেও গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি দিলীপ নাথ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনা জানার পর আমি সংগঠনের পরিচয় দিয়ে এসপি সাহেবকে শনিবার রাতেই ফোন করেছিলাম হামলা ঠেকানোর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানোর কথা বলেছিলাম। কিন্তু সে উদ্যোগ তো নেওয়া হলোই না, তার মধ্যে এটা নিয়ে একটা সমাবেশে গিয়ে বক্তব্য দিলেন ইউএনও ও ওসি।
“ঘটনার শুরুতে সেখানে থানা থেকেও পর্যাপ্ত পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। তাদের এ ব্যর্থতার জন্য আমরা দুজনকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলাম।”
জড়িত দলীয় কর্মীদেরও বিচার চায় বিএনপি
উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছায়েদুল হক মন্ত্রী হওয়ার পর নাসিরনগরে বিএনপি কোণঠাসা হয়ে আছে। হিন্দুদের বাড়িতে হামলার সঙ্গে আমাদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। দুটি সমাবেশের পর হামলার ঘটনাগুলো ঘটে।”
হামলায় হরিপুরের যুবদল নেতা বিল্লাল হোসেনসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে ধরলে তিনি বলেন, “আমরা ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার কারণে রসরাজ দাসের শাস্তির দাবি জানিয়েছি, এখনো জানাচ্ছি। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বাড়িতে হামলাকে সমর্থন করি না। হামলার সঙ্গে বিএনপির কোনো নেতাকর্মী যদি জড়িত থাকে তাদেরও বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা হোক।”
গ্রেপ্তার আতঙ্ক
ক্ষমতাসীন দলের বিরোধের জেরে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘরছাড়া হয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ।
নাসিরনগর উপজেলা শহরের অপু টেলিকমের মালিক আলমগীর মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শহরতো বাদ দেন, গ্রামের মানুষও বাড়িতে নাই। রাতে অধিকাংশ মুসলমানের বাড়িতে কোনো পুরুষ থাকে না। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে শান্তি এখানে ছিল, এখন সেটা একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির রূপ নিয়েছে।
তিনি বলেন, “আমার দোকান থেকে শুধু মোবাইল ব্যাংকিংয়েই দৈনিক এক লাখ টাকার বেশি লেনদেন হত, এখন সেটা ১০ হাজারও হয় না। অন্যান্য দোকানের অবস্থাও তাই।”
গ্রামের মানুষ যে যেখানে পারছে সেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে মন্তব্য করে আলমগীর বলেন, হাওড়ের মধ্যে বনে গিয়েও আশ্রয় নেয় অনেকে।
নাসিরনগর থেকে ঢাকার পথ ধরার সময় কথা হয় ভুড়েশ্বর গ্রামের এক অটোরিক্সা চালকের সঙ্গে।
আনুমানিক ২০ বছর বয়সী এই যুবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জড়িত থাকলেও ধরে, না থাকলেও ধরে- কেউ বাদ নাই। গ্রাম না ছাইড়া উপায় নাই। একবার গ্রেপ্তার হইলে দোষী না হলেও ৩-৪ মাস জেলে থাকতে হবে। দেখি ঢাকায় কিছু বন্ধুবান্ধব আছে, তাদের কাছে গিয়ে কিছুদিন থাইক্যা আসি।”