ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির ভাঙা হয়েছে; ভাংচুর-লুটপাট হয়েছে হিন্দুদের শতাধিক ঘর।
Published : 30 Oct 2016, 07:20 PM
মন্দিরে হামলা: ইউএনও, ওসির অপসারণ দাবি আ. লীগের
সংঘর্ষে আহত মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব
রোববার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত নাসিরনগরে এই তাণ্ডবের পর পাশের জেলা হবিগঞ্জের মাধবপুরেও দুটি মন্দিরে হামলা হয়েছে বলে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়।
এই ঘটনার পর পাশাপাশি দুটি উপজেলা সদরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিজিবি মোতায়েন করা হলেও আতঙ্ক কাটছে না বলে হিন্দু নেতারা জানিয়েছেন।
ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইসলামী দলগুলো বেশ সক্রিয়। এই বছরের শুরুতে এক মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাণ্ডবে সুর সম্রাট আলাউদ্দিত খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে য্ভোবে বৌদ্ধ বসতিতে হামলা হয়েছিল, একই রকম হামলা রোববার হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে।
শুক্রবার নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেইসবুক পাতায় একটি পোস্ট নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
ফেইসবুকে রসরাজ ‘ইসলাম অবমাননা করে’ পোস্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার পর পুলিশ তাকে শনিবার আটক করে। আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান।
ওই ঘটনা নিয়ে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ ব্যানারে রোববার বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয় নাসিরনগর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে। হবিগঞ্জের মাধবপুরেও ডাকা হয় এক কর্মসূচি।
রসরাজের শাস্তির দাবিতে একদল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব চত্বরে বিক্ষোভ দেখায়। আর কয়েকশ লোক সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই সড়ক অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর বলেন, অবরোধ থেকে একদল লোক দেশি অস্ত্র নিয়ে নাসিরনগর সদরের দত্তবাড়ির মন্দির, নমশুদ্রপাড়া মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, ঘোষপাড়া মন্দির, গৌরমন্দির গুঁড়িয়ে দেয়।
উপজেলা সদরের দত্তপাড়া, ঘোষপাড়া, গাংকুলপাড়া পাড়া, মহাকাল পাড়া, কাশিপাড়া, নমসুদপাড়া, মালিপাড়া, শীলপাড়ায় হামলা হয়েছে।
পূজা উদযাপন পরিষদের নাসিরনগর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হরিপদ পোদ্দার বলেন, “১০-১৫টি মন্দিরের পাশাপাশি দেড়শ’র বেশি বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে।”
এ সময় কয়েকজন পূজারীসহ অন্তত ২০ জন আহত হন বলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উপজেলা সভাপতি আদেশ দেব জানান।
তিনি বলেন, ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি মন্দির ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে।
উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল জ্যোতি দত্ত বলেন, “শত শত লোক অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় ফেরাতে গিয়ে এলাকার কিছু মুসলিম যুবকও আহত হয়।”
সুব্রত সরকার নামে একজন বলেন, “আমার বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই মারধর শুরু করে। মন্দিরে ভাঙচুরের পাশাপাশি তারা মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায়।”
প্রদীপ দাস নামে এক জন বলেন, তার ভাই মানিক দাসের একমাত্র সম্বল মাছ ধরার জালটিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে বলে জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান জানান।
স্থানীয়রা জানায়, হামলাকারীদের বেশিরভাগই যুবক বয়সের এবং তাদের পরনে ছিল প্যান্ট-শার্ট।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথমে এক প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। পরে অন্যান্য বাহিনীও যোগ দেয়।
প্রতিটি ভাংচুরের ঘটনায় আলাদা মামলার প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে এসপি মিজানুর বলেন, ইতোমধ্যে ছয় ‘হামলাকারীকে’ তারা গ্রেপ্তার করেছেন।
১২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলী জানান, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান ও পুলিশ সুপার মিজানুর বিকালেই ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে যান।
জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন, “তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।”
এদিকে কর্মসূচি আহ্বানকারী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উপজেলা সভাপতি ইসলাম উদ্দিন দুলাল দাবি করেছেন, এই হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
“পবিত্র কাবা শরিফের অবমাননাকারীর শাস্তি আমরা দাবি করেছি। একই সাথে যারা মন্দিরে হামলা করেছে, আমরা তাদেরও শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।”
নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন দেব বলেন, “বিকালের পর পরিস্থিতি দৃশ্যত শান্ত হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে।”
এই হামলার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করছেন এসপি মিজানুর।
তিনি বলেন, “সুযোগ সন্ধানী মহল সরকারকে বিব্রত করতে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এর নেপথ্যে যারা রয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এদিকে পাশের এলাকার রসরাজের শাস্তি দাবিতে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ ব্যানারে রোববার বিকালে মাধবপুর উপজেলা চত্বরে প্রতিবাদ সভা ডাকা হয়।
মাওলানা ইউনুছ আনছারীর সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন মাওলানা মিজানুর রহমান আজিজি, মাওলানা ইলিয়াছ, মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা মির্জা হাছান আলী, মাওলানা খাদেমুল ইসলাম আল হাসানি, সন্নি জামাত নেতা জসিম উদ্দিন, এখলাছ সিরাজী, শামিম আহাম্মেদ।
নাসিরনগর উপজেলার লোকজনও দল বেঁধে এই প্রতিবাদ সভায় এসেছিলেন বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
তারা বলেন, প্রতিবাদ সভা থেকে একটি অংশ মিছিল নিয়ে বের হতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। একই সময় একদল যুবক মাধবপুরে বাজারে ঢুকে ঝুলন মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর এবং কালী মন্দিরের ফটক ও আসবাবপত্র ভাংচুর করে।
এ সময় বাজারের ব্যবসায়ীরা আতংকে দোকানপাট বন্ধ করে ফেলে।
র্যাব -৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের অধিনায়ক মাঈন উদ্দিন বলেন, তার বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হওয়ার আগেই হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
খবর পেয়ে দ্রুত র্যাব ও বিজিবি ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহবুব আলী, পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র, জেলা ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট (এডিএম) এমরান হোসেন, উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ ফজলে আকবর মো. শাহজাহান, উপজেলা নির্বাহী কমকর্তা মোকলেছুর রহমান, ওসি মোকতাদির হোসেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক তাজুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরির্দশনে যান।
পুলিশ সপার জয়দেব ভদ্র বলেন, “যারা মন্দিরে হামলা-ভাংচুর করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কালী পূজার একদিন বাদে এই হামলার ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সবাই মর্মাহত হয়েছেন বলে জানান উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি সুনীল দাস।
৫৫ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তার বাহিনীর ২ প্লাটুন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।