“আমাদের এই ঘোষণাপত্র ৫ অগাস্ট ২০২৪ সাল থেকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হবে।’’
Published : 17 Jan 2025, 12:31 AM
বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিমুখ বদলে দেওয়া জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্রের খসড়ায় ‘বাহাত্তরের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিলের অভিপ্রায়’ তুলে ধরা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, “ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম।”
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে যোগ দেওয়া একটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ঘোষণাপত্রের খসড়ার একটি কপি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম পেয়েছে।
জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ও অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের মতামত ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছিল। এর ফলে গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যর্থ করার পথ সুগম হয়েছিল।
“পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন শাসনামলে রাষ্ট্র ও এর প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনির্মাণে ব্যর্থতা ছিল এবং এ কারণে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।”
জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের অংশ হিসেবে ডাকা বৈঠকে ১৬টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ২৭ জন প্রতিনিধি আলোচনায় অংশ নেন।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, জেএসডি, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও গণ ফ্রন্টের প্রতিনিধিরা বৈঠকে ছিলেন।
আরো ছিলেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, নেজামে ইসলামী, বাসদ (মার্কসবাদী), জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা।
বরাবরের মত অন্তর্বর্তী সরকারের এই সংলাপে ডাক পায়নি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি।
জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে ‘তাড়াহুড়ো’ ও ’যেনতেন’ প্রক্রিয়ায় যাতে তা করা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে সর্বদলীয় বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকে পরামর্শ আসার কথা বলেছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে তারা বলেন, ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে জুলাই-অগাস্টের গণআন্দোলন নিয়ে এ ঘোষণাপত্র তৈরির দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারকে দলগুলোর প্রতিনিধিরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা প্রণয়নের তাগিদও দিয়েছেন।
অন্যদিকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, “স্পষ্টভাবে বললে, এই ঘোষণাপত্র অভ্যুত্থানের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দল, শক্তি, ছাত্র-জনতার বিভিন্ন ফোরামের সাথে আরও নিবিড় আলোচনার মাধ্যমে তৈরি করতে হবে। সর্বসম্মতিক্রমে এটা তৈরি করতে হবে।”
উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার করার কথা তুলে ধরে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় বলা হয়, “আমাদের এই ঘোষণাপত্র ৫ অগাস্ট ২০২৪ সাল থেকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হবে।’’
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে সে দিন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চার মেয়াদের শাসনের অবসান ঘটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সহিংসতার জেরে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। দাবি ওঠে, সরকার পতনের।
আন্দোলনে ‘শহীদদের’ তালিকা নিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
বুধবার প্রকাশিত প্রথম গেজেটে সারাদেশের ৮৩৪ জন ‘শহীদের’ নাম স্থান পেয়েছে।
অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। গত ২৯ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে আনে তারা। বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ওই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচিও দেয় তারা।
এ বিষয়ে ২৯ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নাৎসি বাহিনীর মত অপ্রাসঙ্গিক এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের ‘কবর’ রচনা করা হবে।”
প্রথমে সরকার এর সঙ্গে যুক্ত না হলেও পরে এ প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানায়। তখন ৩১ ডিসেম্বর ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচি বদল করে সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে এদিনে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন প্রধান উপদেষ্টা।
জুলাই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ক্ষমতার সুষ্ঠ রদবদলের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক ব্যর্থতার সুযোগে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ এক-এগারোর বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্যের পথ সুগম করা হয়।
এতে বলা হয়, “বিগত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে।”
খসড়ায় বলা হয়েছে, “বিগত সরকারের আমলে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক, মানবিক অধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি খুনি রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে।
“উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনা পরিবারের নেতৃত্বে অবাধে লুটপাট, ব্যাংক লুট, টাকা পাচার এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে বিগত সরকার বাংলাদেশ ও এর সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে এবং এর পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করে।
“শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ গত প্রায় ১৫ বছর যাবত নিরন্তর সংগ্রাম করে জেলজুলুম, হামলা মামলা, গুম খুন ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
“বাংলাদেশে বিদেশী রাষ্ট্রের অন্যায় প্রভুত্ব, শোষণ ও খবরদারির বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে তল্পীবাহক আওয়ামী লীগ সরকার নিষ্ঠুর শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে।”
জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় বলা হয়েছে, “ধারাবাহিক তিনটি নির্বাচনী প্রহসনের মধ্য দিয়ে অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার এদেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে।
“ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যত্র ছাত্র ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সরকারী চাকুরীতে দলীয় নিয়োগের একচেটিয়া ও কোটাভিত্তিক সুবিধা সৃষ্টি করে ছাত্র, চাকুরী প্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়।”
খসড়ায় বলা হয়েছে, “বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন ও গণহত্যা চালানোর ফলশ্রুতিতে সারা দেশে দল-মত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।”
গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্রদের প্রণীত নয় দফা দমনে সরকার আরো নির্মমতার আশ্রয় নেয় এবং ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ এবং ব্লক রেইড করে ছাত্র জনতার আন্দোলনকে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে বলে খসড়া ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রের খসড়ায় বলা হয়েছে, “ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, শ্রমিক প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষের যোগদান এবং আন্দোলনের একপর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন দেন।”
সেখানে শেখ হাসিনার পতনের সময়ের ভাষ্যও তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবেলায় গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের সার্বভৌমত্বের অভিপ্রায় ও পরম অভিব্যক্তি রাজনৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত, বৈধ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বলে খসড়া ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে।
প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ভেঙে দেওয়ার আহবান জানানো হয়েছে খসড়ায়।
এতে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও অখণ্ডতা রক্ষার্থে মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়েরও অবতারণা করা হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে ‘ফ্যাসিস্ট’ আওয়ামী লীগ সরকারের সংগঠিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচারের কথাও এসেছে খসড়ায়।
সেখানে বলা হয়েছে, “এই ঘোষণা প্রদান করিলাম যে ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন যা রাষ্ট্রে সকল ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যর অবসান ঘটাবে এবং এদেশের তরুণ সমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে।”
আরও পড়ুন: