“ওর একটা বড় অভিমান ছিল, সেই অভিমানের কারণেই একাকী থাকতো,” বলেন তিনি।
Published : 14 Dec 2024, 11:08 AM
দ্রোহ আর প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের চেয়ে আরেক কবি নির্মলেন্দু গুণ বয়সে বছর তিনেকের বড়। দুজনেরই বাড়ি নেত্রকোণায় হওয়ায় তাদের জানাশোনা বহু দিনের; তারুণ্যে একসঙ্গে অসংখ্য আড্ডার স্মৃতি তাদের।
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’র স্রষ্টার প্রয়াণের কয়েক ঘণ্টা বাদে শুক্রবার রাতে সেই স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন নির্মলেন্দু গুণ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় গুছিয়ে কথা বলতে পারছিলেন না তিনি। বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়া গুণ তবু স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনলেন পুরনো দিনের কথা।
নির্মলেন্দু গুণ বললেন, “আমার শরীরটাও তো ভালো যাচ্ছে না। হেলালের মৃত্যুর খবরটা জানলাম। শেষের দিকে তো যোগাযোগ খুব একটা হতো না।
“তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমি আর আবুল হাসান যে কত দিন-রাত হেলালের ইকবাল হলের (জহুরুল হক হল) রুমটাতে আড্ডা দিয়েছি, তার হিসাব নেই।”
অকৃতদার হেলাল হাফিজের জীবনের শেষ দিনগুলো কাটছিল ঢাকার শাহবাগের সুপার হোম নামের এক হোস্টেলে। শুক্রবার দুপুরে বাথরুমে পড়ে গেলে তার মাথায় রক্তক্ষরণ হয়। পাশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ও তো লেখালেখি শুরু করেছে একটু পরে। ওর একটা বড় অভিমান ছিল, সেই অভিমানের কারণেই একাকী থাকতো।
“হেলালের বাবা কিন্তু কবি ছিলেন। কিন্তু হেলাল লেখালেখিতে এসেছে পরে।”
কবি হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর, নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কেটেছে নিজের শহরেই।
১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। উত্তাল ষাটের দশক হয়ে ওঠে তার কবিতার উপকরণ।
ষাটের দশকে হেলাল হাফিজের কক্ষে আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি হাতড়ে গুণ বলেন, “আমি প্রথম যখন ঢাকায় আসি, তখন হেলালের বড় ভাই দুলালের রুমে উঠেছিলাম। পরে তো হেলালের রুম হয়ে গেল আমার আর আবুল হাসানেরও রুম।
“এই রুমে আমরা কত আড্ডা দিয়েছি- তা ভোলার নয়। এসব কিছু কিছু আমার আত্মজীবনীতে লিখেছি।”
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, সেই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেও প্রাণে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ।
নির্মলেন্দু গুণ বলেন, “২৫ মার্চে মেসে ছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাগুলি হচ্ছে। হেলালকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।
“২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। তখন তো ধরেই নিয়েছিলাম ও আর বেঁচে নেই। পরে দেখলাম, ছোট্ট একটা পোঁটলা নিয়ে হেলাল এক কোণা থেকে বেরিয়ে আসছে। ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। এগুলো এখন বলতে গেলে ভুলে যায়। আমার আত্মজীবনীতে লিখেছি।”
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হেলাল হাফিজের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। প্রকাশকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বইটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ।
তিনি বলেন, “ওর প্রথম কবিতার বইটা বের করার সময় আমিই প্রকাশকের সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছিলাম। (জাতীয়) প্রেস ক্লাবেও আমার সঙ্গেই ও প্রথম প্রথম যেতো। আমি তো বেশিদিন এক জায়গায় থাকি নাই।
“আমি প্রেস ক্লাবে যাওয়া কমিয়ে দিলাম। কিন্তু দেখলাম হেলাল যেতো। পরে তো প্রেস ক্লাবের পাশেই একটা হোটেলের রুমে থাকতো। ওর অনেক অভিমান ছিল।”
শেষ দিকে তেমন যোগাযোগ না থাকলেও ‘আত্মিক যোগাযোগ’ ছিল বলে ভাষ্য গুণের।
হেলাল হাফিজ কেন হোটেলে থাকতেন, কী তার অভিমান ছিল? সেই প্রশ্নের নানা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকে। হেলাল হাফিজও বিভিন্ন সময় এ নিয়ে অল্পবিস্তর বলেছেন। তবু যেন রহস্যই রয়ে গেছে কবির জীবন।
হেলাল হাফিজের ভাই দুলাল আবদুল হাফিজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে তো কবিতার মানুষ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক। প্রেস ক্লাবের পাশেই একটি হোটেল কক্ষে একাকী থাকত।
“আমরা তাকে বাসায় নিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু সে থাকেনি। অসুস্থ হয়েছিল, তখন হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছি। সুস্থ হয়ে আবার হোটেলেই থাকা শুরু করে।”
এক দশকের বেশি সময় হেলাল হাফিজ রাত্রিযাপন করেছেন হোটেলে। ২০২০ সালে যখন কোভিড মহামারী শুরু হল, তার আগে তিনি সেগুনবাগিচায় কর্ণফুলী হোটেলে থাকতেন।
মহামারীর শুরুতে লকডাউনের বিধিনিষেধ আরোপ হলে প্রেস ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া নিয়ে কষ্টে পড়ে যান কবি।
বড় ভাই দুলাল আবদুল হাফিজ তখন কবিকে নিয়ে যান তার ইস্কাটনের বাসায়। কিন্তু পরিস্থিতি একটু ভালো হলে আবার হোটেলে ফিরে যান তিনি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে নানা জটিলতা। ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ আর গ্লুকোমা কঠিন করে তোলে হেলাল হাফিজের জীবনকে। কয়েকবার হাসপাতালেও যেতে হয়।
কোভিড পরবর্তী সময় থেকে হেলাল হাফিজ শাহবাগের সুপার হোম হোস্টেলে থাকতেন জানিয়ে দুলাল হাফিজ বলেন, “এখানেও সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। পরে তাকে সবাই হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু সে হোস্টেলেই থাকত।”
কবি মামুন খানেরও বাড়ি নেত্রকোণায়। হেলাল হাফিজের মৃত্যু খবর জানার পর শুক্রবার সন্ধ্যায় ছুটে এসেছিলেন হাসপাতালে।
সেখানে মামুন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নেত্রকোণার সঙ্গে হেলাল হাফিজের একটু অভিমান ছিল। কিন্তু অভিমানটা ছিল প্রেমের।
“নেত্রকোণার মানুষও তাকে খুব ভালোবাসেন। তার জন্মদিনে কিছু সংগঠন প্রতি বছরই সেখানে অনুষ্ঠান আয়োজন করেন।”
হেলাল হাফিজ সবশেষ যে হোস্টেলে থাকতেন, সেই সুপার হোমের আরেক কক্ষের বাসিন্দা রূপম রোদ্দুর। গত তিন বছর ধরে তিনিই কবির দেখভাল করতেন।
রূপম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি তো বিগত কয়েক বছর ধরেই একাকিত্বে ভুগছিলেন। শারীরিকভাবেও কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। হাঁটাচলা ঠিকমত করতে পারতেন না।
“আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য বলেছি। উনি হাসপাতালে থাকতে চাইতেন না। দুপুরের দিকে তিনি বাথরুমে পড়ে যান। পরে হোস্টেলের লোকজন উনাকে হাসপাতালে নেন; চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। তার কবিতা হয়ে ওঠে মিছিলের স্লোগান।
‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কালজয়ী কবিতার এ লাইন দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পরবর্তীতে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ও কবিতাটি মানুষের মাঝে তুমুল সাড়া জাগায়।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র ৩৩টির বেশি সংস্করণ বেরিয়েছে। দীর্ঘসময় নিজেকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ।
আড়াই দশক পর ২০১২ সালে তিনি পাঠকদের জন্য আনেন দ্বিতীয় বই ‘কবিতা একাত্তর’। তৃতীয় ও সর্বশেষ বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।
খুব কম লিখেছেন হেলাল হাফিজ। তবে তার কবিতা যেমন হয়ে উঠেছিল মিছিলের স্লোগান, তেমনই আবার হয়ে উঠেছিল প্রেমের চিঠির অনুষঙ্গ। কবিতা যে বই ছাড়াও কার্ড হয়ে বের হতে পারে, তাও দেখা যায় হেলাল হাফিজের ক্ষেত্রে।
আগের খবর...
হেলাল হাফিজের শেষ শয্যা বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে
কবি হেলাল হাফিজ অনন্ত কবিতালোকে
'আমি চাই মানুষ জমাতে': কবি হেলাল হাফিজের প্রস্থান
জন্মদিনে এবার দোয়াই কবি হেলাল হাফিজের কাছে 'উপহার'