আধুনিক সময়কে শব্দবন্ধে, শব্দের অতিরেক উদ্ভাসে সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছেন কবি।
Published : 13 Dec 2024, 09:03 PM
বিদায় কবি হেলাল হাফিজ (জন্ম ৭ অক্টোবর ১৯৪৮,মৃত্যু ১৩ ডিসম্বর ২০২৪)। অভিমান, নৈঃসঙ্গ্য, প্রবল তীব্র আবেগে দোলায়িত এক কবিসত্তা। মাত্র চারখানি কাব্যগ্রন্থ তাঁর। যে জলে আগুন জ্বলে, কবিতা ৭১, একজীবনের জন্মজখম এবং বেদনাকে বলেছি কেঁদো না। তাঁর কবিতা বিদ্রোহের প্রেরণা-পাথেয়, রোমান্টিকতায় পরম নির্ভরতা ও আশ্রয়। বলা হয়, অল্প লিখে গল্প হয়েছেন তিনি। চিরকুমার ছিলেন। শেষ বয়সে অনেক রোগ বালাই কাবু করে ফেলেছিল। মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর সৃষ্টির সোনালি সম্ভার ম্লান করতে পারেনি। বাংলা কবিতা ঋণী রইল তাঁর কাছে।
‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের সুবিখ্যাত কবিতাটি সম্পর্কে কবিতানুরাগীরা জানেন। ওই কবিতার দুটি চরণ মুখে মুখে ফেরে। তা হলো ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়..’। নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতাটি সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন ছিল কবি হেলাল হাফিজের কাছে। সেসব প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন:
“কবিতাটি প্রথম ছাপা হয় কোনো একটি লিটল ম্যাগাজিনে। নামটা ঠিক আর মনে নেই রে ভাই। সেই কালে একুশে ফেব্রুয়ারির সময় প্রচুর পরিমাণে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো। তার কোনো একটিতে। অজস্র আবৃত্তিশিল্পী কবিতাটি আবৃত্তি করেছেন। এটি গানও হয়েছে। তিন রকমের সুরে তিন গান। সুরগুলো যে আমার মনোমতো হয়েছে, তা না। আসলে কবিতাটি তো শ্লোগানধর্মী। এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা কিনা জানতে চাইছো? এর জবাবে বলব, পিতার কাছে সব সন্তানই তো প্রিয়। এই কবিতাটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে। ইংরেজি, হিন্দি, জার্মান, ফরাসি। শুনেছি, স্প্যানিশ ভাষায়ও নাকি হয়েছে, তবে সেটা আমি নিজে দেখি নি। দ্যাখো, একটা কথা স্পষ্ট করে তোমাকে বলি, আমি বেসিক্যালি যুদ্ধবিরোধী লোক। কিন্তু আমার হাত দিয়েই বেরুল এই কবিতা।”
কবিতাসন্ন্যাসী আমরা বলতে পারি কবি হেলাল হাফিজকে। এক জীবন তিনি কাটিয়ে দিলেন কবিতার জন্য। আরাধনায়, ত্যাগে, শিল্পনির্মাণে, কখনো বা আত্মপীড়নে। জীবনাভিজ্ঞতার নির্যাস তিনি কেলাসিত করে স্ফটিকস্বচ্ছতায় উপস্থাপন করেন পাঠকসমীপে। অনায়াসে হৃদয়ের নিভৃতকোণে সুরঝঙ্কারে মূর্ত জীবন্ত হয়ে ওঠে। সমকালীন বাংলা কবিতার লাবণ্যসৌরভ,অমৃতমধু তিনি সঞ্চারিত,লগ্ন করতে সমর্থ হয়েছেন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। এই কৃতি ও কীর্তি অনন্যসাধারণ। সর্বপ্লাবীও বটে। দীর্ঘ ৩৪ বছর নিঝুম নৈঃশব্দ্যের পর আমরা আবার ঝরনার জলতরঙ্গ শুনতে পেলাম ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে...। সে বছর বেরুলো তাঁর দ্বিতীয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ বেদনাকে বলেছি কেঁদো না। সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই জানেন যে, বেদনা হচ্ছে কান্নারই অপর নাম। হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে উঠে আসে এই নিভৃত নিঃসঙ্গ উপলব্ধি। এই কবি বিষাদকে শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় বাজিয়ে তুলতে পারদর্শী। এই নৈপুণ্য তাঁর সহজাত। অন্য কবিদের জন্য ঈর্ষণীয়ও বটে। তাঁর কবিতার রীতিচিত্র একেবারেই আলাদা। বিষাদ হয়তো মরমি কোনো বাদ্যযন্ত্রবিশেষ। কবিতার সুছন্দিত সুরেলা ঝঙ্কারে,আবেগে বিহ্বলতায় আমাদের মন বিমোহিত হয়। অপ্রাপ্তির কষ্ট যন্ত্রণা চিত্ররূপময় হয়ে ওঠে। সেও তো এক উপভোগ্য বিষয়। বেদনাকে বলেছি কেঁদো না নামের এ বইটি প্রকাশ করেছে দিব্যপ্রকাশ। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ যে জলে আগুন জ্বলেও বের হয় এই দিব্যপ্রকাশ থেকেই।
আধুনিক সময়কে শব্দবন্ধে, শব্দের অতিরেক উদ্ভাসে সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছেন কবি। সাংকেতিক, তাৎপর্যবহ দ্যোতনায়। হালফিল শশব্যস্ত মানুষের প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে অবকাশ বড়োই কম। দীর্ঘ কবিতা পড়বার মত ফুরসত আর মেলেই না। সেই মানসিকতাও অন্তর্হিত হয়ে গেছে কোন্ কবে! সাম্প্রতিক কালে তাই ফেসবুকে লিখিত হয় কবিতা। দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। অতি সংক্ষেপে, বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মত অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত হয় আমাদের যান্ত্রিক জীবনে। এই মাধ্যমের সুবিধাও কম নয়। তাৎক্ষণিকভাবে ফিডব্যাক পাওয়া যায়। হাতে হাতে ফল।
স্বল্প পরিসরে নতুন এই কবিতাগ্রন্থের মূল কবিতাপুঞ্জের রস আস্বাদনের পর আমরা প্রবৃত্ত হতে পারি বিশদে, বিশ্লেষণে। ৩৪ বছরে ৩৪টি কবিতা মাত্র সংকলিত এই গ্রন্থে। এক টানে পড়ে ফেলা যায়। নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ কীর্তিমান শিল্পী ধ্রুব এষের। রাজযোটক আর কি!
‘ঘুড়ি’ নামের কবিতা
সুতো ছিঁড়ে তুমি গোটালে নাটাই
আমি তো কাঙাল ঘুড়ি
বৈরী বাতাসে কী আশ্চর্য
একা একা আজও উড়ি!
কবিতার নাম ‘নীল খাম’। আমরা জানি, একসময় নীল খামে ভালোবাসার চিঠি লেখা হতো। সে কী আনন্দময় রোমাঞ্চ, অত্যাশ্চর্য শিহরণ। এই কালে চিঠি চলে গেছে জাদুঘরে, প্রত্নসম্পদ হয়ে। ইদানীং লেখা হয় মেসেজ। হাতে হাতে মুঠোফোন, বিশ্ব এখন তালুবন্দি। মুহূর্তেই পৌঁছে যাওয়া যায় বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে। ‘নীল খাম’ কবিতায় চিরন্তন কষ্ট বেদনাই বিধৃত হয়েছে গীতল মাধুর্যে।
কবি বলছেন:
আমারে কান্দাইয়া তুমি
কতোখানি সুখী অইছো
একদিন আইয়া কইয়া যাইও।
এই যে এসব অণুকাব্য, এর মাধ্যমে এক ধরনের মর্মদ্রাবী দ্রোহ,মানবিক কল্যাণের আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে সুরের স্পন্দনে। আমাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে, বোধ উপলব্ধিকে নাড়া দেয় এইসব অজর অমর কবিতাপংক্তি। তরুণদের মুখে মুখে ফেরে নন্দিত ছন্দিত এই সুগন্ধিত চরণসমূহ। এন্টিসেপটিক চুমু কবিতার মর্মরধ্বনি--
আমাকে উস্টা মেরে দিব্যি যাচ্ছো চলে
দেখি দেখি
বাঁ পায়ের চারুনখে চোট লাগেনি তো?
ইস! করেছো কী? বসো না লক্ষ্মীটি
ক্ষমার রুমালে মুছে সজীব ক্ষতেই
এন্টিসেপটিক দুটো চুমু দিয়ে দেই।
এই কবিতার কোনো ব্যাখ্যা কী আদৌ দরকার? মোটেও দরকার নেই। পড়ে মন আবিষ্ট হয়। দুঃখদীর্ণ হয় মুহূর্তেই। সেখানেই এরকম কবিতার মহতী সৌন্দর্য ও সার্থকতা। পাঠপরবর্তী অভিজ্ঞতাটা কেমন? কষ্টক্লেশের অনুরণন বেশ ভালোমতই থেকে যায়। যেন বা শুকনো ক্ষতের মত। জোছনাধোয়া শুশ্রূষা দাবি করে যে ক্ষত। উপশম হয়তো সম্ভবপর নয় কোনো কালেই। মনুষ্যত্বের, প্রগতির, ভালোবাসার অমেয় শক্তির কথা অপূর্ব সংবেদে কবি তুলে ধরেন মাত্র দু’খানা ছত্রে। ‘সঞ্চয়’ শিরোনামের কবিতাটি পড়লে এক অদ্ভুত শিহরন জাগে।
সবাই জমায় টাকা
আমি চাই মানুষ জমাতে!
একজন কবির কাছে আমাদের কী প্রত্যাশা? সুন্দরের। কল্যাণের। শুভবোধের। সত্যের। মানবিকতার মহতি মন্ত্রে তিনি উজ্জীবিত করেন সময়কে, মানুষকে। প্রগতিপথের দিশা দেন। সেই স্তোত্র আমাদের জীবনবাদী আশাবাদী করে তোলে, আবেগে আপ্লুত, মমতায় আর্দ্র করে। ‘স্রোতস্বিনী ভালোবাসা’ নামের কবিতার কিয়দংশ--
ভালোবাসা আছে বলেই তুমিও আছো, আমিও আছি।
ভালোবাসা আছে এবং থাকবে বলেই
তোমার তুমি আমার আমি, তোমার আমি আমার তুমি
এখন থেকে তুমিই আমি, আমিই তুমি।