হোস্টেলেই ফিরে গেলেন হেলাল হাফিজ

সংসার বিবাগী এই কবির জীবন কাটছে হোটেলে হোটেলে।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2022, 06:06 AM
Updated : 19 Nov 2022, 06:06 AM

হাসপাতালে চিকিৎসার পর ঢাকার সেগুনবাগিচায় কবি ইসমত শিল্পীর বাসায় উঠেছিলেন কবি হেলাল হাফিজ; তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় সেখানে থাকার পর ফের একাকী জীবনে ফিরে গেছেন তিনি।

ইসমতের বাসা থেকে গত ১৪ নভেম্বর শাহবাগের সুপার হোম হোস্টেলে গিয়ে ওঠেন হেলাল হাফিজ। পূর্বপরিচিত এই হোস্টেলই এখন তার ঠিকানা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ইসমত শিল্পী বলেন, “হাসপাতাল পরবর্তী ২৫ দিন কবি আমার এখানে ছিলেন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তার সুস্থতা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের। এখন ব্যক্তিগতভাবে ফোনে যথাসম্ভব খোঁজখবর রাখতে চেষ্টা করছি।”

হেলাল হাফিজ ডায়াবেটিস, কিডনি আর গ্লুকোমার পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছেন। সেপ্টেম্বরের শুরুতে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।

দ্রোহ আর প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের জীবন গত এক দশক ধরেই কাটছিল হোটেলে হোটেলে। সেপ্টেম্বরে হাসপাতালে ভর্তির আগেও তিনি সুপার হোমে ছিলেন। ২০ অক্টোবর যখন হাসপাতাল ছাড়লেন, তখন সেই হোটেলে সিট খালি না থাকায় হেলাল হাফিজকে সেগুনবাগিচায় নিজের বাসায় নিয়ে যান ইসমত শিল্পী।

ইসমত বলেন, কবির থাকার জন্য একটি ভালো জায়গা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কাউকে কিছু বলতে চান না কবি।

“উনার শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। ব্লাড প্রেসার কখনো কমে, কখনও বাড়ে। মাথা ঘুরায়। ঘুমের ভেতরে চিৎকার করে ওঠেন। সব থেকে বড় কথা মানসিকভাবে তিনি দিশাহারা। কারণ তিনি নিজে চলতে পারেন না।”

গত ৮ অক্টোবর তার ৭৪তম জন্মবার্ষিকীতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক আনন্দ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছিল, হাসপাতাল থেকে অসুস্থ অবস্থায় সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন কবি।

নভেম্বরের শুরুতে ইসমত শিল্পী বলেছিলেন, “বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যারা কবির জন্মদিনের আয়োজন করেছিলেন, যাদের অনুষ্ঠানে অসুস্থ শরীর নিয়েই হাজির হয়েছিলেন, তাদের অনুরোধেই তিনি কবিকে নিজের বাসায় নিয়ে যান। কিন্তু সেই আয়োজকরা এখন আর কবির খোঁজ নিচ্ছেন না।”

Also Read: কবি হেলাল হাফিজ এখন কোথায় যাবেন

এদিকে কবি হেলাল হাফিজের থাকার জায়গা না থাকার খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশের পর একাধিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যেগেও কবির দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন কেউ কেউ। কিন্তু হেলাল হাফিজ কারও উপর নির্ভর না করে সুপার হোমেই ফিরে গেছেন।

হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কেটেছে নিজের শহরেই।

১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। উত্তাল ষাটের দশক হয়ে ওঠে তার কবিতার উপকরণ।

১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। তার কবিতা হয়ে উঠেছিল মিছিলের স্লোগান।

‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কালজয়ী কবিতার এ লাইন দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পরবর্তীতে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলেন সময়ও কবিতাটি মানুষের মাঝে তুমুল সাড়া জাগায়।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এরপর বইটির ৩৩টির বেশি সংস্করণ বেরিয়েছে।

দীর্ঘসময় নিজেকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ। আড়াই দশক পর ২০১২ সালে তিনি পাঠকদের জন্য আনেন দ্বিতীয় বই ‘কবিতা ৭১’। তৃতীয় এবং সর্বশেষ বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।

Also Read: নত চিত্তে কেবলই নত হতে শিখেছি: হেলাল হাফিজ

শৈশবে মাতৃহারা হেলাল হাফিজ তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “আমি যেদিন মাতৃহীন হই, আমি বুঝতেই পারিনি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বেদনাটুকু অনুভব করতে পারিনি। কোনো স্মৃতি নেই। যে যাতনা আমাকে পোহাতে হলো, তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।”

বাবাও ছিলেন কবি, পেশায় শিক্ষক। স্ত্রী বিয়োগের পর আবার বিয়ে করেন। দুই ঘর মিলিয়ে চার ভাই তিন বোন হেলাল হাফিজরা।

গতবছর একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কবি বলেছিলেন, পরিবারের সবাই সব সময় তার খোঁজ রাখে, বোনরা একটু বেশি রাখে। তবে নিঃসঙ্গতা আর নির্জনতা তার ভালো লাগে। হোটেলবাসের একাকীত্বের বেদনা তিনি ‘উপভোগ’ করেন।

হেলাল হাফিজ হোটেলে থাকেন অন্তত দশ বছর ধরে। মহামারীর আগে থাকতেন সেগুনবাগিচায় কর্ণফুলী হোটেলে। তখন তার জীবন ছিল কার্যত প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক। সকালের নাস্তা থেকে রাতের খাবার– সব প্রেসক্লাব ক্যান্টিনেই হত।

২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে মহামারী শুরু হলে লকডাউনের বিধিনিষেধ শুরু হয়। প্রেসক্লাব বন্ধ হলে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কষ্টে পড়ে যান কবি।

বড় ভাই দুলাল আবদুল হাফিজ তখন কবিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার ইস্কাটনের বাসায়। কিন্তু পরিস্থিতি একটু ভালো হলে আবার হোটেলে ফিরে যান তিনি।