কবি হেলাল হাফিজ এখন কোথায় যাবেন

আপাতত তিনি আছেন এক তরুণ কবির বাসায়। কিন্তু অসুস্থ কবিকে দেখে রাখা, নিয়ম করে ওষুধ দেওয়া তার একার পক্ষে সম্ভব নয়।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2022, 12:47 PM
Updated : 7 Nov 2022, 12:47 PM

দুই সপ্তাহ আগে হাসপাতাল ছেড়েছেন কবি হেলাল হাফিজ, তবে তিনি ভালো নেই। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র কবির যে থাকারই জায়গা নেই।

আপাতত তিনি আছেন তরুণ কবি ইসমত শিল্পীর বাসায়। কিন্তু অসুস্থ কবিকে দেখে রাখা, নিয়ম করে ওষুধ দেওয়া একা শিল্পীর জন্য কঠিন।

শিল্পী বললেন, কবির থাকার জন্য একটি ভালো জায়গা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কাউকে কিছু বলতে চান না কবি।

“উনার শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। ব্লাড প্রেশার কখনো কমে, বাড়ে। মাথা ঘুরায়। ঘুমের ভেতরে চিৎকার করে ওঠেন। সব থেকে বড় কথা মানসিকভাবে তিনি দিশাহারা। কারণ তিনি নিজে চলতে পারেন না।

“এই অবস্থায় কোথায় যাবেন? সেটা নিয়ে উনি চিন্তিত। খাওয়ার সময় কখনো কখনো চোখ ভিজে ওঠে। তার কবিতা পড়ে শোনালে আড়ালে চোখ মোছেন। আমি দেখি, কিছুই বলার থাকে না।”

হেলাল হাফিজ ডায়াবেটিস, কিডনি আর গ্লুকোমার পাশাপাশি বার্ধক্যের নানা জটিলতায় ভুগছেন। সেপ্টেম্বরের শুরুতে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।

গত ৮ অক্টোবর তার ৭৪তম জন্মবার্ষিকীতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক আনন্দ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছিল, হাসপাতাল থেকে অসুস্থ অবস্থায় সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন কবি। 

নিঃসঙ্গ হেলাল হাফিজের জীবন গত এক দশক ধরেই কাটছিল হোটেলে হোটেলে। এবার হাসপাতালে ভর্তির আগে ছিলেন সুপার হোম নামে শাহবাগের একটি হোস্টেলে। ২০ অক্টোবর যখন তিনি হাসপাতাল ছাড়লেন, তখন সেই হোস্টেলের সিট আর খালি নেই।

কবিকে তখন সেগুনবাগিচায় নিজের বাসায় নিয়ে যান ইসমত শিল্পী। কিন্তু কবির যত্ন নিয়ে শিল্পী নিজেও আছেন দুশ্চিন্তায়।

“আমাকে উনি বলেছেন, হাসপাতালে থাকতে খুব খারাপ লাগে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলবেন কিনা, উনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তো নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। উনাকে বারবার বলতে গেলে যদি কোনো কারণে বিরক্ত হন, তখন তো সেটা দুঃখজনক হবে।

“কিন্তু উনি তো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। হাসপাতালে থাকার সময় কয়েকবার ‘আত্মহত্যা’র কথাও নাকি উনার মনে উঁকি দিয়েছে। হাসপাতালে থাকলে খুবই একা অনুভব করেন। এজন্য উনি হাসপাতালে থাকতে চান না।”

শিল্পী বললেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যারা কবির জন্মদিনের আয়োজন করেছিলেন, যাদের অনুষ্ঠানে অসুস্থ শরীর নিয়েই হাজির হয়েছিলেন, তাদের অনুরোধেই তিনি কবিকে নিজের বাসায় নিয়ে যান। কিন্তু সেই আয়োজকরা এখন আর কবির খোঁজ নিচ্ছেন না।

“আমার একার পক্ষে উনার সামগ্রিক দেখাশোনা করা সম্ভব না, তাই কবির জন্য একজন লোক চেয়েছিলাম তাদের কাছে। যারা কবিকে বাসায় রেখে গিয়েছিলেন, তারা বলেছিলেন কবির জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে স্থায়ী জায়গার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু পরে তাদের পক্ষ থেকে আর কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি এতদিনে কবির জন্য একজন লোকও দেয়নি।”

দ্রোহ আর প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কেটেছে নিজের শহরেই।

১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। উত্তাল ষাটের দশক হয়ে ওঠে তার কবিতার উপকরণ।

১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। তার কবিতা হয়ে উঠেছিল মিছিলের স্লোগান।

‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কালজয়ী কবিতার এ লাইন দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পরবর্তীতে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলেন সময়ও কবিতাটি মানুষের মাঝে তুমুল সাড়া জাগায়।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এরপর বইটির ৩৩টির বেশি সংস্করণ বেরিয়েছে। দীর্ঘসময় নিজেকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ।

আড়াই দশক পর ২০১২ সালে তিনি পাঠকদের জন্য আনেন দ্বিতীয় বই ‘কবিতা ৭১’। তৃতীয় এবং সর্বশেষ বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।

শৈশবে মাতৃহারা হেলাল হাফিজ তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “আমি যেদিন মাতৃহীন হই, আমি বুঝতেই পারিনি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বেদনাটুকু অনুভব করতে পারিনি। কোনো স্মৃতি নেই। যে যাতনা আমাকে পোহাতে হলো, তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।”

বাবাও ছিলেন কবি, পেশায় শিক্ষক। স্ত্রী বিয়োগের পর আবার বিয়ে করেন। দুই ঘর মিলিয়ে চার ভাই তিন বোন হেলাল হাফিজরা।

গতবছর একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কবি বলেছিলেন, পরিবারের সবাই সব সময় তার খোঁজ রাখে, বোনরা একটু বেশি রাখে। তবে নিঃসঙ্গতা আর নির্জনতা তার ভালো লাগে। হোটেলবাসের একাকীত্বের বেদনা তিনি ‘উপভোগ’ করেন।

হেলাল হাফিজ হোটেলে থাকেন অন্তত দশ বছর ধরে। মহামারীর আগে থাকতেন সেগুনবাগিচায় কর্ণফুলী হোটেলে। তখন তার জীবন ছিল কার্যত প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক। সকালের নাস্তা থেকে রাতের খাবার– সব প্রেসক্লাব ক্যান্টিনেই হত।

২০২০ সালের মার্চ মাসে মহামারী শুরু হল, শুরু হল লকডাউনের বিধিনিষেধ। প্রেসক্লাব বন্ধ হলে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কষ্টে পড়ে গেলেন কবি।

বড় ভাই দুলাল আবদুল হাফিজ তখন কবিকে নিয়ে গেলেন তার ইস্কাটনের বাসায়। কিন্তু পরিস্থিতি একটু ভালো হলে আবার হোটেলে ফিরে যান তিনি।

এখন শরীরের যা অবস্থা, একা তাকে হোটেলে রাখা সম্ভব না। আবার তিনি হাসপাতালেও থাকতে চান না। কেবল কবিতার সঙ্গে ঘর করা এই মানুষটি তাহলে কোথায় থাকবেন? কে তাকে দেখে রাখবে?

ইসমত শিল্পী বললেন, “উনার এখন খুবই নাজুক অবস্থা। উনার জন্য একটা সুন্দর, উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। যেখানে উনি মানসিকভাবে নিরাপদ এবং আরামে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। আমরা যারা তাকে ভালোবেসে পাশে আছি, তারা সবসময় তার পাশে থাকব।”