নত চিত্তে কেবলই নত হতে শিখেছি: হেলাল হাফিজ

“আমি যাপিত জীবনের সিংহকাল কবিতার জন্য ব্যয় করেছি। কবিতাপ্রেমী মানুষের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি- সেটা অভূতপূর্ব, অতুলনীয়।”

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Oct 2022, 04:47 AM
Updated : 8 Oct 2022, 04:47 AM

অসুস্থ শরীরে হাসপাতাল থেকে উপস্থিত হলেন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে; সবার শুভেচ্ছা নিলেন, জানালেন জীবনের ৭৪ বছর পেরিয়ে আসার অনুভূতি।

কবি হেলাল হাফিজ; সমালোচকদের বিচারে বিচারে অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, জনপ্রিয়তার বিচারে বাংলাদেশে কবিদের শীর্ষ সারিতেই থাকছে তার নাম।

সেই হেলাল হাফিজের ৭৪তম জন্মবার্ষিকী ছিল শুক্রবার। আর তা উদযাপনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজন হল এক আনন্দ সন্ধ্যা।

কবি বেশ কিছু দিন ধরেই অসুস্থ, রয়েছেন ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।

বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, খুব অসুস্থ, তবুও জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন।

অসুস্থ শরীর নিয়েই শুক্রবার ‘আনন্দ সন্ধ্যা’য় দেখা দিলেন কবি; আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, “আপনাদের ভালোবাসা-আদর-সম্মান আমাকে ঘাস থেকে, তৃণ থেকে উদ্ভিদে রূপান্তরিত করেছে। আমি নত হই, আমি নত চিত্তে কেবলই নত হতে শিখেছি। নত হতে চাই, নত হতে চাই।”

একই সঙ্গে দ্রোহ আর প্রেমের কবি হেলাল হাফিজ। জন্ম তার ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কেটেছে নিজ শহরেই।

ছোটবেলার স্মৃতি মনে করে অনুষ্ঠানে হেলাল হাফিজ বলেন, “আমি যেদিন মাতৃহীন হই, আমি বুঝতেই পারিনি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বেদনাটুকু অনুভব করতে পারিনি। কোনো স্মৃতি নেই। যে যাতনা আমাকে পোহাতে হলো, তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।

“যত দিন গিয়েছে, একটু একটু করে বড় হয়েছি। বয়স বেড়েছে। মাতৃহীনতার বেদনা আমাকে আমূল গ্রাস করেছে। সেই সব শৈশব-কৈশোর ও প্রথম যৌবনে আমি ছিলাম খেলাধূলার মানুষ। যতই বয়স বাড়তে লাগলো, মাতৃহীনতার এই বেদনা আমাকে গ্রাস করে ফেললো।”

১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। উত্তাল ষাটের দশক হয়ে ওঠে তার কবিতার উপকরণ। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়।

খেলাধুলা দিয়ে সেই বেদনাকে প্রশমিত করতে না পেরে লেখালেখিতে যুক্ত হয়েছেন জানিয়ে হেলাল হাফিজ বলেন, “সেই লেখালেখির জীবন নিতান্ত কম নয়। ৭৫ বছরের একটি জীবন পেয়েছি। খুব কম মানুষ এতটা পায়। কিন্তু এই দীর্ঘ জীবন আমি পুরোটা কাজে লাগাতে পারিনি। কিছু জীবন অপচয় করে ফেলেছি। খুব কম লিখেছি জীবনে, কিন্তু জীবন খরচ করে লিখেছি।”

খুব কম লিখেছেন হেলাল হাফিজ। তবে তার কবিতা যেমন হয়ে উঠেছিল মিছিলের স্লোগান, তেমনই আবার হয়ে উঠেছিল প্রেমের চিঠির অনুসঙ্গ। কবিতা যে বই ছাড়াও কার্ড হয়ে বের হতে পারে, তাও দেখা গেল হেলাল হাফিজের মাধ্যমে।

Also Read: জন্মদিনে এবার দোয়াই কবি হেলাল হাফিজের কাছে ‘উপহার’

যে কবিতা মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেবে, তেমন কবিতা লিখতে চেয়েছেন বলে জানান হেলাল হাফিজ।

তিনি বলেন, “সত্তুর-আশির দশকে যেদিন বইমেলা শেষ হত। তার পরদিন কোনো কবিতার কথা শোনা যেত না। কোনো পঙতির কথা শোনা যেত না। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, খুব কম লিখব। বইয়ের সংখ্যা কম হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমি এমন কাব্য প্রকাশ করে যেতে চাই, মেলা যেদিন শেষ হবে কবিতার আয়ু সেদিন শেষ হয়ে যাবে না। এমন একটি কাব্যগ্রন্থ রেখে যেতে চাই, যেটি এক থেকে অনেক মেলা পর্যন্ত এর আয়ু দীর্ঘায়ু হবে। মানুষ স্মরণে রাখবে। মানুষ তার মনে এবং মগজে সেই বইয়ের স্মৃতি লালন করবে।”

ষাটের দশকে লেখালেখির শুরু, তখন থেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পরও তার প্রথম কবিতার বই বের হয় আশির দশকে, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ শিরোনামে। তারপর আর একটি মাত্র বইই বের করেছেন।

হেলাল হাফিজ বলেন, “১৭ বছর লেখালেখি করে প্রায় ১ বছর ধরে ৫/৬শ কবিতা থেকে ৫৬টি কবিতা বাছাই করে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি। এই বইটি প্রথমে অন্য এক নামে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সেই নামটি আমার মনঃপুত ছিল না। আমারই দেওয়া নাম, কিন্তু খুব অতৃপ্তি ছিল। খুব খুঁতখুঁতে লাগছিল নিজের কাছে। সেজন্য বই ছাপা হয়ে যাওয়ার পরেও আমার রয়্যালিটির টাকা থেকে প্রকাশককে ক্ষতিপূরণ দিয়ে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ নামে বইটি প্রকাশ করেছিলাম।”

নামকরণ নিয়ে এই কবি বলেন, “আমরা ওহি নাযিলের কথা বলি। বিশ্বাস করুন- আমার মনে হয়, এই নামটি আমার কাছে ওহি নাযিল হয়েছিল। যেদিন নামটি আমার মগজে আসল, সেদিনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।”

আয়োজকদের আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে হেলাল হাফিজ বলেন, “আমি যাপিত জীবনের সিংহকাল কবিতার জন্য ব্যয় করেছি। কবিতাপ্রেমী মানুষের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি- সেটা অভূতপূর্ব, অতুলনীয়।

“আমি চেয়েছিলাম আমার কবিতা দিয়ে অর্থ নয়, বিত্ত নয়, আমি মানুষ জমাতে চাই। সেই মানুষ জমাতে গিয়ে জীবনের যে দারুণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, তাও আমার জীবনের অপঠিত ইতিহাস হয়ে আছে। কবিতা আমাকে অনেক দিয়েছে। এই ঋণ জীবদ্দশায় পরিশোধ করার ক্ষমতা আমার নেই।”

অনুষ্ঠানে ভক্ত-অনুরাগীদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হন কবি। নানা রকম উপহারও পান, জন্মদিনের কেকও কাটেন।

অনুষ্ঠানে আরও আলোচনা করেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কবি মিনার মনসুর, অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস, কবি রবীন আহসান, কবি ঠোকন ঠাকুর, কবি কাজল রশীদ শাহীন, আলোকচিত্রী সুদীপ্ত সালাম, কবি মনির ইউসুফ, কবি শিমুল সালাহউদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, অধ্যাপক শ্যামলী নাসরিন, ইরশাদুল হক টিংকু, কবি ইসমত শিল্পী। সঞ্চালনা করেন ইমরান মাহফুজ।

কবি হেলাল হাফিজের কবিতা নিয়ে রচিত ‘ফুল ও ফুলকি’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনও করা হয় অনুষ্ঠানে। মোড়ক উন্মোচন শেষে লেখক মোহাম্মদ আলী বলেন, “এই আয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার জীবনে। কবিতার জন্য আমার কাজের শুরু মাত্র।”