কারা কীভাবে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার’ গড়ে তুলেছে, আর তাদের সঙ্গে পাহাড়ের সশস্ত্র দল ‘কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ বা ‘কেএনএফ’ বা বম পার্টির সখ্য কীভবে তৈরি হল, সে বিষয়ে আরও কিছু নতুন তথ্য হাজির করেছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি।
জঙ্গিবাদ দমনে গঠিত বিশেষায়িত এই ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান বলছেন, নিষিদ্ধ জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি), আনসার আল ইসলাম এবং জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা মিলে নতুন এ জঙ্গি দল গড়ে তুলেছেন। চলতি বছরের শুরুতে তারা ঠিক করেন, তাদের সংগঠনের নাম হবে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া।
সমতল ও পাহাড়ে এ সংগঠনের কার্যক্রম চলে আলাদাভাবে। সমতলে প্রথম আমির ছিলেন মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। তিনি গতবছর গ্রেপ্তার হওয়ার পর দায়িত্ব পান আনিছুর রহমান ওরফে তমাল। তবে আগাগোড়াই এ সংগঠনের মূল ব্যক্তি শামিন মাহফুজ, যিনি রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কৃত একজন সাবেক শিবির কর্মী।
আসাদুজ্জামান বলছেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা অবস্থায় এর আগে তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শামিন, তবে এখন তিনি পলাতক।
কারাগারে থাকার সময়ই শামিনের সঙ্গে রক্সি এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হরকাতুল জিহাদ নেতা আবু সাঈদের পরিচয় হয়। সেখানেই তারা নতুন দল গড়ার পরিকল্পনা করেন এবং ২০১৮ সালে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর রক্সি ও শামিন মিলে সেই দল গঠনের কাজ শুরু করেন।
বুধবার রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসে সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান এই তথ্য তুলে ধরেন।
গ্রেপ্তার ওই পাঁচজন হলেন- মো. আব্দুল্লাহ (২২), মো. তাজুল ইসলাম (৩৩), মো. জিয়াউদ্দিন (৩৭), মো. হাবিবুল্লাহ (১৯) এবং মো. মাহামুদুল হাসান (১৮)।
আসাদুজ্জামান বলেন, গত সেপ্টেম্বরে ঢাকার রামপুরা থেকে গ্রেপ্তার চিকিৎসক শাকিরকে গ্রেপ্তারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জামাতুল আনসারের বিষয়ে নতুন এসব তথ্য তারা পেয়েছেন।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া কয়েকজন তরুণের বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়ে সম্প্রতি নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
দুই দফায় ওই দলের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে গত দুই বছরে বাড়ি ছাড়া অর্ধ শতাধিক তরুণের খোঁজ তারা পেয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের একটি তালিকাও র্যাব প্রকাশ করে।
এরপর গত ২০ অক্টোবর বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসারের সাত সদস্য এবং তিন পাহাড়িকে গ্রেপ্তারের খবর দেয় র্যাব
পরে র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, পাহাড়ের সশস্ত্র দল ‘কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ বা ‘কেএনএফ’ বা বম পার্টির ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ চলে জামাতুল আনসার সদস্যদের। সেজন্য দুই বছর আগে দুই সংগঠনের মধ্যে চুক্তিও হয়েছিল। সে অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহন করে জামাতুল আনসার।
জামাতুল আনসারের সঙ্গে বম পার্টির যোগাযোগ কীভাবে তৈরি হল, সেই তথ্য বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে দেন সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান।
সিটিটিসি বলছে, কুমিল্লার নিখোঁজ তরুণদের সন্ধানে নেমে আবরারুল হক নামের এক তরুণকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার মগবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেদিনই এ সংগঠনের ‘শীর্ষস্থানীয় নেতা’ ডাক্তার শাকির বিন ওয়ালীকে রামপুরা থেকে আটক করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে শাকির বলেন, তিনি জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়া নামের এক সংগঠনের দাওয়া বিভাগের প্রধান। তখনই এ সংগঠনের কথা জানতে পারে সিটিটিসি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ডা. শাকির পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণের সময় দলের সদস্যদের চিকিৎসাও দিতেন। দলের কেউ আহত হলে কীভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে, সে বিষয়েও প্রশিক্ষণ দিতেন।
সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলছেন, পাহাড়ে এ জঙ্গি দলের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ চলত তিন ভাগে। শামিন মাহফুজের পাশাপাশি ডাক্তার শাকিরেরও যাতায়াত ছিল সেখানে। নতুন রিক্রুটদের কেউ ক্যাম্প থেকে ফিরে আসতে চাইলে তার হাত, পা, চোখ বেঁধে বন্দি করে রাখা হত।
ডা. শাকিরের দেওয়া তথ্যে গত ১৭ অক্টোবর দলের ‘অন্যতম সংগঠক এবং অর্থদাতা’ কৃষিবিদ মহসিন ইমাম ওরফে রিয়েলকে সিটিটিসি গ্রেপ্তার করে। পরে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেখানে শামিন মাহফুজ ও রক্সির নাম আসে।
কারাগারে থাকা রক্সিকে তখন নতুন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। সেখান থেকেই জামাতুল আনসারের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য মেলে বলে সিটিটিসির ভাষ্য।
আসাদুজ্জামান বলেন, “এই সংগঠনের কাজ মূলত ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তকরণ এবং দুর্গম এলাকায় মাদ্রাসা পরিচালনা এবং ধর্মের প্রচার প্রসারের আড়ালে জঙ্গিবাদের বিস্তার। রিক্রুটমেন্ট, অর্থ সংগ্রহ, সশস্ত্র সামরিক ট্রেনিং, আধুনিক অস্ত্র ক্রয়সহ একটি বিশাল বাহিনী গঠন করতে চেয়েছিল তারা।
“২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭০/৮০ জন যুবককে তারা এ সংগঠনে যুক্ত করেছে। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল পাহাড়ে তাদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি, নিরাপদ সামরিক ট্রেনিং, সংগঠনের প্রয়োজনে দেশে নাশকতা উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে পুনরায় নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, রক্সি সমতলের নেতৃত্ব পাওয়ার পর সদস্য সংগ্রহ এবং পাহাড়ে প্রশিক্ষণের কাজ জোরদার হয়। কিন্তু পাহাড়ে নিরাপদে অবস্থান এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দলের মূল নেতা শানিন মাহফুজ তখন তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু নাথান বমের সঙ্গে সহযোগিতার চুক্তি করেন।
আসাদুজ্জামান বলেন, “কেএনএফ বা বমপার্টির প্রধান নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। অন্যদিকে জামাতুল আনসারের বর্তমান আমীর শামিন মাহফুজ ছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তারা খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।”
দুই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল জানিয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, “প্রশিক্ষণের ব্যাপারে যখন দুর্গম জায়গা খোঁজা হচ্ছিল তখন শামিন মাহফুজ জানতে পারে তার বন্ধুই বমপার্টির প্রধান। এরপরে তারা যোগাযোগ শুরু করে এবং কক্সবাজারের একটি হোটেলে বসে টাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষণের বিষয়ে চুক্তি হয়।”
এরপর যাত্রাবাড়ী থানার এক মামলায় ২০২১ সালে রক্সি গ্রেপ্তার হলে সমতলের আমিরের দায়িত্ব নেন তমাল। আর শামিন পুনরায় দলকে সংগঠিত করেন। তার নেতৃত্বেই বান্দরবানের রোয়াংছড়ির দুর্গম পাহাড়ে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে।
আসাদুজ্জামান বলেন, এ বছরের শুরুর দিকে পাহাড়ি ক্যাম্পে শামিন মাহফুজ, ডাক্তার শাকির বিন ওয়ালীসহ কয়েকজন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন, তাদের দলের নাম হবে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়া’। ডাক্তার শাকির গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশের কাছে সে কথাই বলেছেন।
গ্রেপ্তার ৫ জন দুই দিন করে রিমান্ড
ডেমরা থেকে গ্রেপ্তার জামাতুল আনসারের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা হয়েছে ডেমরা থানায়। ওই মামলায় তাদের দুই দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে সিটিটিসি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজমের পুলিশ পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন বৃহস্পতিবার পাঁচ আসামিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন।
শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম শহিদুল ইসলাম তাদের দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ সময় আসামিদের পক্ষে কোন আইনজীবীকে দেখা যায়নি।
পুরনো খবর
সাত ছাত্র নিরুদ্দেশ: সেই চিকিৎসককে গ্রেপ্তারের কথা জানাল সিটিটিসি