পরিবেশ দূষণের কথা মাথায় রেখে সরকারি নির্দেশনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন ক্রেতারা। তাদের অনেকেই বাসা থেকে আনছেন কাপড় কিংবা পাটের ব্যাগ।
Published : 13 Oct 2024, 11:32 PM
মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক এলাকায় একটি সুপারশপ থেকে বের হচ্ছিলেন রেহনুমা, হাতে প্লাস্টিকের দুটি বড় ব্যাগ।
ছুটির দিন শুক্রবার কাছে গিয়ে ব্যাগের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বললেন, “সরকারিভাবে তো প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ, তাও দেওয়া হচ্ছে। আবার প্রতিটি প্লাস্টিকের ব্যাগের জন্য আট টাকা করে রাখা হচ্ছে। এ কেমন কথা!”
রেহনুমার ক্ষোভের প্রসঙ্গ ধরে প্লাস্টিকের ব্যাগে পণ্য দেওয়ার কথা তুললে ওই সুপারশপের ওই আউটলেটের এক কর্মী বলেন, “আমাদের এখানে পাট ও চটের ব্যাগ রয়েছে, কিন্তু এখন শেষ হয়ে গেছে। তাই আউটলেটে থাকা বাকি কিছু প্লাস্টিকের ব্যাগ দেওয়া হচ্ছে।”
তবে সেই ব্যাগের জন্য টাকা নেওয়া হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি। এ বিষয়ে কথা বলতে আউটলেটটির ব্যবস্থাপকের দেখা পাওয়া গেল না।
এদিন পরে মিনাবাজার, ইউনিমার্ট ও স্বপ্নের মত সুপারশপগুলোর কয়েকটি আউটলেট ঘুরে দেখা গেছে, সেগুলোতে পুরোপুরি বন্ধ হয়নি পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার। প্লাস্টিকের র্যাপিং, ফোম ট্রে, নিষিদ্ধ নেটের ব্যাগ ও প্লাস্টিকের বড় ব্যাগের সবই ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
কিছু আউটলেটে প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করে পাট, কাপড় কিংবা কাগজের ব্যাগ ব্যবহারের নির্দেশনা প্রচার করা হচ্ছে।
ক্রেতাদেরও কেউ কেউ আসছেন কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে। যারা ব্যাগ আনছেন না, তাদের কারও কারও হাতে আবার প্লাস্টিকের ব্যাগই ধরিয়ে দিচ্ছে সুপারশপগুলো। জানতে চাইলে বিকল্প ব্যাগের সংকটের কথা বলছেন সেখানকার কর্মীরা।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সুপারশপগুলোতে ১ অক্টোবর থেকে পলিথিন ও পলিপ্রোপলিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু এক সপ্তাহে সেই নির্দেশনার প্রতিফলন দেখা গেল ‘আংশিক’।
তবে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারি নির্দেশনার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন ক্রেতারা। তাদের অনেকেই বাসা থেকে এনেছেন কাপড় কিংবা পাটের ব্যাগ।
ধানমন্ডিতে ইউনিমার্ট সুপারশপের মাছ বিভাগের ইনচার্জ মিরন মোল্লার ভাষ্য, “আমাদের শপের প্রায় ৪০ শতাংশ ক্রেতা নিজেরাই ব্যাগ হাতে করে বাজার করতে আসছেন। ক্রেতারা কাঁচা মাছ মোম প্রলেপ দেওয়া কাগজের ব্যাগেই নিচ্ছেন। তবে ব্যাগ ছিড়ে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কয়েকটি কাগজের ব্যাগ দিচ্ছি। এতে কেউ অভিযোগ করছেন না।”
বছরের পর বছর ধরে বাজার ছেঁয়ে যাওয়া পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা কতটুকু সম্ভব হবে সেটি নিয়ে সংশয়ের মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতারা পর্যাপ্ত বিকল্প ব্যবস্থা আর সচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছেন।
নিষেধাজ্ঞা শুরুর এক সপ্তাহ পর আউটলেটগুলোতে সেটির বাস্তবায়ন ‘যৎসামান্য’ হওয়ার বিষয়ে ধানমন্ডিতে মীনা বাজারের অপারেশনসও আউটলেট ইনচার্জ পারভেজ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ব্যাগের চাহিদা থাকে, কিন্তু সে তুলনায় ব্যাগের সরবরাহ নেই। আবার ভেন্ডররা ব্যাগের দামও বেশি বলছে। ফলে বাধ্য হয়ে নিষিদ্ধ নেটের ব্যাগ দিচ্ছি।
“কাল থেকে নেটের ব্যাগও শেষ, তখন বড় কার্টুন ও কাগজের ব্যাগে দিতে হবে। ক্রেতারা অনেকেই ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার বাজার করেন এখানে। ফলে পাটের বা কাপড়ের ব্যাগই তাদের কিনতে কয়েক হাজার টাকার। শুরুতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।”
মীনা বাজারে প্রতিটি আউটলেটেই ক্রেতাদের সচেতন করতে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ বাসা থেকে বা বাজার থেকে কিনতে একটু পর পর ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।
তবে সুপারশপটির ধানমন্ডির আউটলেটে ফল, কাটা সবজি, গুড়সহ বিভিন্ন পণ্য পলিথিনে মুড়িয়ে রাখতে দেখা গেছে গত বুধবার।
এ বিষয়ে পারভেজ আলম বলেন, “প্রথম তিন দিন কোনো পলিথিন ব্যবহার করিনি। কিন্তু তাতে সব নষ্ট হয়ে যায়। মাছি ও পোকা ওড়ে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ক্রেতারা এমন খাবার কিনতে চায় না। তাই পলিথিন র্যাপ ব্যবহার করছি।”
পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারে তদারকি সংস্থার অভিযানের বিষয়টি তুললে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার তো পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু বিকল্প তো বাজারে পাচ্ছি না। এখন অভিযান ও জরিমানা হলে আমাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য তা ভালো নয়। তখন তো সব বন্ধ করতেই হবে।”
স্বপ্নের ধানমন্ডি আউটলেটে প্রতিদিন ব্যাগের চাহিদা থাকে এক হাজারের মত। সেখানেও পাট, চট ও কাপড়ের ব্যাগের সংকট। পলিথিনে মাংস, ফল, সবজি মোড়ানো থাকতে দেখা গেল।
এ আউটলেটের ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ”বিকল্প পথ না আসা পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে আমরা এত কিছু পরিবর্তন আনতে পেরেছি, এটিও পরিবেশবান্ধব করা হবে।”
সরকারের পলিথিন বন্ধের সিদ্ধান্তকে সঠিক বললেও এর বিকল্প বা পূর্বপ্রস্তুতির অভাবের কথা বলেন তিনি।
সেখানে থাকা আয়শা আইরিন নামে এক বলেন, “ব্যাগ আনতে ভুলে গেছি তাই এই ব্যাগ দিল।”
ধানমন্ডির মিনা বাজারের ক্রেতা এসমাত জাহান বলেন, “নেটের ব্যাগে কী বেশি বাজার নেওয়া যায়। এখানে পাট বা কাপড়ের ব্যাগ নেই, না হলে কিনে নিতাম।"
এ এলাকার আরেক সুপারশপ ইউনিমার্টে বৃহস্পতিবার ঘুরে তুলনামূলকভাবে পলিথিন ও প্লাস্টিক নিষিদ্ধের নির্দেশনা খানিকটা বেশি মানতে দেখা গেছে। এখানে কাগজ, পাট, কাপড়ের ব্যাগের ব্যবস্থা অন্য আউটলেটের থেকে বেশি দেখা গেছে।
এ আউটলেটের মাংস বিভাগে বেঙ্গল মিট মাংস বিক্রি করে। সেখানে পলিথিন মোড়ানো ও ফোমের এক ধরনের ট্রেতে মাংস দেওয়া হচ্ছে, যা পানিরোধক।
এটি পরিবেশবান্ধব কি না জানতে চাইলে বেঙ্গল মিটের ইনচার্জ নেহাল উদ্দিন বলেন, "আমাদের লাইসেন্স আছে। এগুলো ফুডগ্রেড। এটি ক্ষতিকর নয়। আমরা শুরু থেকেই ক্রেতাদের এতে করে মাংস দিয়ে আসছি।"
এ কর্মকর্তার দেখানো লাইসেন্সে ফোমের ট্রে তৈরির উপাদান লেখা হয়েছে 'পলিস্টাইরিন', যা একটি সিন্থেটিক প্লাস্টিক (পলিমার)।
তবে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, ”পলিথিন যে ফর্মেই তৈরি হোক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কোথাও এমন কিছু ব্যবহার করা যাবে না। বিকল্প হিসেবে পলিথিনের মতো দেখতে এমন কিছু পরিবেশবান্ধব হলেও এই মূহুর্তে বাজারে রাখার কথা ভাবছি না।"
বাজারে ব্যাগের সরবরাহের বিষয়ে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) তরফ থেকে বলা হয়েছিল, যোগান ঠিক রাখতে ব্যাগের দাম কমানো ও বেশি সংখ্যায় তৈরির কাজ চলছে। ২৯ সেপ্টেম্বর বলা হয়েছিল এরইমধ্যে এক কোটি ব্যাগের অর্ডারের এসেছে বিভিন্ন সুপারশপ থেকে, যা সামনে আরও বাড়বে।
ব্যাগের দাম
মিনা বাজারে ১৩ থেকে ২০ টাকায় চার আকারের ব্যাগ রাখা হয়েছে। স্বপ্নে ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে ৬ থেকে ১৪ টাকার মধ্যে। ইউনিমার্টে কম দামের পাটের ব্যাগের দামই ২৯ টাকা এবং মাঝারি আকারেরগুলো ১৪৫ এবং বড় ও ভালোগুলোর দাম ৪৫০ টাকা।
তবে স্বপ্ন সুপারশপে ব্যাগের পুনরায় ব্যবহার বাড়াতে নিজেদের কাছে থাকা প্লাস্টিক ও পলিপ্রোপলিন ব্যাগ আনলে প্রতি ব্যাগে দুই টাকা করে ক্রেতাদের দেওয়া হচ্ছে।
পলিথিন-টিস্যু ব্যাগ এবার বন্ধ হবে? বিকল্প যোগান কতটা
পলিথিনে না দিলে 'কিসে দিমু'! অবাক বিক্রেতা