ইমতিয়াজের দুই বোন, এক ভগ্নিপতি ও তিন ভাগ্নে সহ মোট ছয়জন শুক্রবার রাতে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী হয়েছিলেন। সবাই ছিলেন 'চ' বগিতে।
Published : 06 Jan 2024, 02:26 PM
রাজধানীর বার্ন ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর ওয়ার্ডের দরজার সামনে ওয়ার্ডের দেয়ালের প্লাগ পয়েন্টে, চার্জে দেওয়ার সময়ও বেজে চলছিল মো. ইমতিয়াজের মোবাইল ফোন। সমানে ফোন আসছে, নিজেও করছেন নানাজনকে। তাকে প্রশ্ন করার আগেই বলতে শোনা গেল, "কোনো খোঁজ পাইনি, সব হাসপাতালে লোকজন পাঠাইছি। লাশগুলো চেনা যাচ্ছে না।”
ঢাকার সব হাসপাতাল খুঁজেও বোন এলিনা ইয়াসমিন কোনো খোঁজ পাননি ইমতিয়াজ। এলিনা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী ছিলেন। এখন ইমতিয়াজ এসেছেন বার্ন ইনস্টিটিউটে। যেখানে ভর্তি আছেন ইমিতিয়াজের পরিবারের আরও ৫ জন।
ইমতিয়াজের দুই বোন, এক ভগ্নিপতি ও তিন ভাগ্নেসহ মোট ছয়জন শুক্রবার রাতে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী হয়েছিলেন। সবাই ছিলেন 'চ' বগিতে। ট্রেনে আগুন লাগার পর সবাই নামতে পারলেও তার এক বোন এলিনা ইয়ামিন নিখোঁজ রয়েছেন।
ইমতিয়াজ বলেন, “এলিনা ৬ মাসের ছেলে আরফান ছিল তার আরেক বোন রত্নার কোলে। ট্রেনে আগুন লাগার পর রত্না আরফানকে কোলে নিয়ে কোন রকমে নামতে পারেন। রত্না আপার স্বামী ইকবাল এবং দুই ছেলের দিহান ও রোহানও ট্রেন থেকে নামতে পারে। শুধু খোঁজ নেই এলিনার।“
ট্রেন থেকে নামতে পারলেও ইমতিয়াজের পরিবারের বাকি ৫ সদস্য কমবেশি আহত হয়েছেন।
ইকবাল, রত্না ও তাদের দুই ছেলে দিহান ও রেহানকে ৫২০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রাখা হয়েছে; আর ছয় মাসের আরফানকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রাখা হয়েছে বলে জানান ইমতিয়াজ।
শুক্রবার রাতে আগুন লাগার পর ঢাকার গোপীবাগে যেখানে ট্রেনটি থেমেছিল, সেখানকার মসজিদেও এলিনার খোঁজে মসজিদে মাইকিং করা হয়েছিল।
হতাশ কণ্ঠে ইমতিয়াজ বলেন, “বোনের সন্ধান পেতে ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলো চষে ফেলেছি, কোথাও পেলাম না।“
ভোট ঠেকাতে বিএনপির ডাকা হরতালের আগে শুক্রবার রাত নয়টার দিকে রাজধানীর গোপীবাগ কাঁচাবাজারের কাছে এসে থেমে যায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি। বেনাপোল থেকে দেড় শতাধিক যাত্রী নিয়ে ট্রেনটিতে সে সময় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। এ ঘটনায় অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে, দগ্ধ হয়ে হাসাপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন আটজন। আগুনে পুড়ে যাওয়া মরদেহগুলো নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলেন অপর্ণা বিশ্বাস। তার ছেলে চিকিৎসক কৌশিক বিশ্বাস বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী ছিলেন।
অপর্ণা জানান, ৩৯ তম বিসিএস ক্যাডার কৌশিক ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্র কৌশিক শুক্রবার চেম্বার করতে ফরিদপুর যান। এবারেও রোগী দেখা শেষ করে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকায় ফিরছিলেন তিনি। আগুনে পুড়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসাধীন আছেন চিকিৎসক কৌশিক।
এই ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলছিলেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা আবু সিদ্দিক খান। তার ছেলে আসিফ মোহাম্মদ খান ও পুত্রবধূ নাতাশা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী ছিলেন।
আগুন লাগার পর অনেকটা পুড়ে যাওয়া আসিফ জানালা দিয়ে মাথা বের করেন। সে সময় বাইরে থাকা লোকজন তাকে টেনে এর করতে পারলেও ভেতরেই রয়ে যান নাতাশা। এর পর থেকে নাতাশার কোনো খোঁজ নাই।
নারিন্দার বাসিন্দা আবু সিদ্দিক জানান, আসিফ ও নাতাশা ফরিদপুরের ভাঙায় আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে ওই ঘটনার শিকার হন।
তিনি বলেন, "আমি আর কারো লগে কথা কমু না। একবার ডিএমপি আইসা ছেলেরে জিগায় সে বিএনপি করত কী না, আরেকবার রেল পুলিশ আইসা জিগায় কোন দলের রাজনীতি করে। আমি আপনাদের এক কথা বলব আর আরেক রকম অর্থ দাঁড়াবে।"
আরও পড়ুন:
‘বাচ্চা-বউ পুইড়া গেছে, বের হয়ে কী করব’
ঢাকায় বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন, নিহত ৪
ছেলের খোঁজে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে বাবা