দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটির স্থাপনা ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ মহামারী, যুদ্ধসহ নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
Published : 06 Mar 2025, 01:34 AM
ক্ষমতার পালাবদলের আগে আওয়ামী লীগ সরকার সর্বশেষ যে ধারণা দিয়েছিল, তাতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালু হওয়ার কথা ছিল।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বছরের শেষেও তা চালু করা যাবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটির কাজ কোভিড মহামারীসহ বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
দু্ই ইউনিটের ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রাথমিক কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। আর মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে।
এরপর মূল প্রকল্পে স্থাপনা ও সঞ্চালন লাইনের কাজ দফায় দফায় পিছিয়ে যাওয়ায় নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখছেন কর্মকর্তারা।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি একটি ইউনিট থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যোগ হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনও হয়নি, যদিও সে বছরের অক্টোবরে ইউনিটটির জন্য জ্বালানি এনে মজুদ রাখা হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হওয়ায় গত এক বছর ধরে উৎপাদনে যেতে পারছে না প্রথম ইউনিট।
প্রকল্প পরিচালক ও পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ড. মো. জাহেদুল হাছান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রকৌশলগত কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে। এখন এগুলোর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে ৪০০ কেভির দুটি সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন।
“একটি লাইন গত ডিসেম্বরে চালু হয়েছে। আগামী মার্চের মধ্যে আরেকটি লাইন চালু করবে। এর পরই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলক উৎপাদনের প্রস্তুতি নিতে পারবে।”
পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করতে গেলেও অন্তত চার মাসের বিভিন্ন ধাপ পার হতে হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।
তবে সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসি- পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রশিদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, লাইন নির্মাণে কিছুটা বিলম্ব হলেও বেশ কয়েক মাস ধরে অন্তত ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সক্ষমতা প্রস্তুত হয়ে আছে।
“কিন্তু প্রকল্পের অন্যান্য কারিগরি প্রস্তুতির অভাবে হয়ত উৎপাদন শুরু করা যাচ্ছে না। তাই কাজ বিলম্বের পুরো দায়দায়িত্ব পিজিসিবির ওপর বর্তায় না।”
পিজিসিবির কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রকল্পের দিক থেকে আরও একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র প্রয়োজন, যা এখনও প্রস্তুত হয়নি। সেখানে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও প্রস্তুত হয়নি।
তারা বলছেন, অনেক স্থানে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের আশপাশের ভূমিও প্রস্তুত করা হয়নি। সুতরাং বলা যায়, প্রস্তুতির ঘাটতি সব দিক থেকেই রয়েছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে।
আর এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরা।
যুক্ত রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি, গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন কিছু সংস্থা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হলেও এ বিষয়ে কর্মকর্তাদের কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি নন।
গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর সে সরকারের যেসব মেগাপ্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তার অন্যতম।
দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি ডলার দুর্নীতির অভিযোগও ইতোমধ্যে উঠেছে।
যেসব কারণে বাধাগ্রস্ত কাজ
বাংলাদেশে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ভাবনা ১৯৬১ সালে শুরু হয়েছিল। অবশ্য ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এ বিষয়ে সক্রিয়তা দৃশ্যমান হয়।
২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি চূড়ান্ত করে দুই দেশের সরকার।
প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর রোসাটমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এতমস্ত্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশন।
তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ২০১৭ সালের অক্টোবরে।
সে বছর নভেম্বরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের চুল্লি ও পানি শীতলকারী ডোমের কংক্রিট ঢালাই কাজ শুরু হয়। পরের বছর জুলাইয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় চুল্লির নির্মাণ কাজ।
কাজ শুরুর ৬৮ মাসের মধ্যে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল স্থাপনা নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল।
সে অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয় সরকারের তরফে। আর পরের বছর সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট চালু হওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এটি হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্রটির মেয়াদ হবে ৬০ বছর। পরে তা আরও ২০ বছর তা বাড়ানো যাবে।
প্রায় পাঁচ বছরে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন সময় কাজ পিছিয়ে এখন তা আট বছরেও শেষ করা যাবে কি না, সেই সংশয় তৈরি হয়েছে।
প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলার মধ্যেই ২০২০ সালের প্রথম দিকে কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হলে কয়েক মাসের জন্য কাজের অগ্রগতি থেমে যায়।
প্রায় এক বছরের অচলাবস্থার পর ২০২১ সালে আবার কাজে স্বাভাবিক গতি ফেরে।
কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রকল্পের বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য ছয়টি সঞ্চালন লাইন থাকছে। এসব সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজে দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল অচলাবস্থা।
প্রকল্পটির কাজ ২০১৮ সালের এপ্রিলে শুরু করে দুই বছরে শেষ করার কথা ছিল। ভারতীয় ঋণের শর্ত অনুযায়ী ভারতীয় ঠিকাদারদের মাধ্যমে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ হচ্ছিল। তবে মাঝপথে এসে ভারতীয় ঠিকাদাররা প্রকল্পের ব্যয় বাড়াতে চাইলে বাংলাদেশও বেঁকে বসে।
এ নিয়ে এক বছরের অচলাবস্থার পর নিজস্ব অর্থায়নে কাজ শুরু করে সরকার। তাতে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ পিছিয়ে যায় দুই বছর।
এরপর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কাজটি শেষ করার সময় ঠিক করা হয়। সে সময়ে প্রথম ইউনিটটিও চালু করার কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান ঘোষণা করেছিলেন, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রথম ইউনিট এবং ২০২৬ সালে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হবে।
ইতোমধ্যে প্রথম ইউনিট চালুর সেই সময়ও পেরিয়ে গেছে।
পিজিসিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই মাসে পদ্মা ও যমুনা নদীর অংশের তিনটি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ শুরু করে কোম্পানিটি। ২০২৫ সালের জুনে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
গণআন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সঞ্চালন লাইন নির্মাণে যুক্ত ভারতীয় নাগরিকরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে চলে যায়। যদিও তারা পরে আবার কাজে যোগ দিয়েছেন।
ক্ষমতার পালাবদলের পর রূপপুর প্রকল্পে অন্তত ৫০০ কোটি ডলারের দুর্নীতি হওয়ার খবর আসে একটি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে।
সে সংবাদের সূত্র ধরে দেশের সংবাদমাধ্যমে এই দুর্নীতির খবর আসে। এ নিয়ে পরে হাই কোর্টে রিট আবেদন করা হয়।
হাই কোর্টের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক রূপপুর প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।
অভিযোগের তদন্ত শুরু হওয়ায় নির্মাতা দেশ রাশিয়া বেশ নাখোশ হয়েছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালুর কথা বলা হলেও চুক্তির অন্যপক্ষ রাশিয়ার দিক থেকে সেই প্রস্তাব এখনও অনুমোদন হয়নি।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক জাহেদুল হাছান বলেন, “এখন প্রকল্পের সময় এক্সটেন্ড করা উচিত। কিন্তু রাশিয়ার পক্ষে থেকে এখনও তা করা হয়নি।”
দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের (প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি) ঋণচুক্তি করেছিল সরকার। চুক্তি অনুযায়ী খরচের ৯০ ভাগ রাশিয়া এবং ১০ ভাগ বাংলাদেশ বহন করার কথা।
রূপপুর প্রকল্পের অর্থায়নে যুক্ত রাশিয়ার ভেনশেকনম ব্যাংক বা ভিইবি (ব্যাংক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফরেন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স) যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ায় অর্থ লেনদেনে সরাসরি প্রভাব পড়ে।
বিকল্প উপায়ে চীনের কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে লেনদেন করার আলোচনা করছে বাংলাদেশ।
অগ্রগতির সর্বশেষ
রূপপুর প্রকল্প চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে।
জ্বালানি পেলেও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই গিয়েছিল। তাছাড়া মূল প্রকল্পেরও নানা ধাপের কাজ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি ছিল।
যে কারণে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে বলা হলেও পরে তা পিছিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঠিক করা হয়।
সেই সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর গত ২ ফেব্রুয়ারি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছানের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়।
তিনি বলেন, গত ডিসেম্বরেই চুল্লিপাত্রে কৃত্রিম জ্বালানি বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। চুল্লি শীতল রাখার যন্ত্র বা আরসিপির পরীক্ষাও হয়েছে। এছাড়া চারটি পানির পাম্পের কার্যকারিতা পরীক্ষার কাজও ধাপে ধাপে হচ্ছে। এসব কাজ শেষ হতে এক মাস লাগবে।
যদিও চুল্লিপাত্রে কৃত্রিম জ্বালানি বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে; এতে দুই সপ্তাহ সময় লাগার বিষয়টি তখন সংবাদমাধ্যমে এসেছিল।
প্রকল্প পরিচালক বলছেন, বিদ্যুতের লাইন আসার পর কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক সংযোগগুলোর পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে পরবর্তী ধাপে। দুইটি সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে সংযোগের কাজও করতে হবে। এর জন্য লাগবে এক মাস।
তিনি বলেন, আরেকটি কাজ হচ্ছে বিদ্যুতের মূল কাজ চালু করার আগে অভ্যন্তরীণ সংযোগগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। এটি করতে এক মাস সময় প্রয়োজন হবে। এরপর শুরু হবে চূড়ান্ত যাত্রা বা ফিজিক্যাল স্টার্টআপ। এটা করতে লাগবে দুই মাস।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের পরীক্ষামূলক যাত্রা কবে শুরু হবে, এমন প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেন, “আগামী মার্চের মধ্যে নতুন একটি ৪০০ কেভি ক্ষমতার গ্রিড লাইন প্রস্তুত হয়ে যাবে। সেটি এলেই চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু করা যাবে। পরীক্ষাটি হবে চারটি ধাপে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, এ পরীক্ষায় চার মাস সময় লেগে যেতে পারে।”
সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত হওয়ার পর চুল্লিতে জ্বালানি দিতে একমাস সময় লাগবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলতে থাকলে আগামী জুন থেকে জুলাইয়ের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুতের অভিজ্ঞতা পেতে পারে বাংলাদেশ। তবে এগুলো নির্ভর করছে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। তাই কখন কোন কাজ শুরু হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।”
দেরির যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে পিজিসিবি
সঞ্চালন কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য মোট ছয়টি গ্রিড লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।
লাইনগুলোর মধ্যে রূপপুর থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ ২০২২ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। রূপপুর থেকে বগুড়া পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে গত বছর এপ্রিলে। সে বছর জুনে শেষ হয় আমিনবাজার থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইনের কাজ।
এছাড়া রূপপুর থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার (স্থলভাগ) ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন, রূপপুর থেকে ঢাকা (আমিনবাজার-কালিয়াকইর) পর্যন্ত ১৪৭ কিলোমিটার (স্থলভাগ) ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন, রূপপুর থেকে ধামরাই পর্যন্ত ১৪৫ কিলোমিটার (স্থলভাগ) ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ প্রায় শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
এই লাইন তিনটি পদ্মা এবং যমুনা নদী অতিক্রম করেছে। ৪০০ কেভি রূপপুর গোপালগঞ্জ সঞ্চালন লাইনের দুই কিলোমিটার পদ্মা নদীর অংশের কাজ আগামী মার্চের মধ্যে শেষ করার জন্য পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া ৪০০ কেভি রূপপুর-ঢাকা সঞ্চালন লাইনের সাত কিলোমিটার ও ২৩০ কেভি রূপপুর-ধামরাই সঞ্চালন লাইনের সাত কিলোমিটার যমুনা নদীর অংশের কাজ আগামী ডিসেম্বর নাগাদ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
এসব লাইন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট-২ এর উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজন হবে।
গ্রিড লাইনের বর্তমান অবস্থায় অর্থাৎ ইতোমধ্যে শেষ হওয়া ৪০০ কেভি রূপপুর-বগুড়া এবং ২৩০ কেভি রূপপুর-বাঘাবাড়ী সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট-১ এ উৎপাদিত ৬০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা যাবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী মার্চ/এপ্রিলে প্রথম ইউনিটের ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় ৪০০ কেভি রূপপুর-গোপালগঞ্জ সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত থাকবে বলে আশা করছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি।
প্রকল্পে দেরির ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারি এ কোম্পানি জানায়, সঞ্চালন লাইন তিনটির নদীর অংশ নির্মাণে ভারতের লাইন অব ক্রেডিট চুক্তির আওতায় অর্থায়নের শর্তানুযায়ী ভারতীয় ঠিকাদারদের মধ্যে প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হয়।
দরপত্র মূল্যায়নে দেখা যায়, দরদাতা প্রাক্কলনের তুলনায় অনেক বেশি দর প্রস্তাব করেছে। পরে সঞ্চালন লাইন তিনটির নদীর অংশ ভারতীয় অর্থায়নের আওতা থেকে বের করে সরকারি অর্থায়নের আওতাধীন কর্ম-পরিকল্পনায় আনা হয়। তারপর আবার দরপত্র (আন্তর্জাতিক ওপেন টেন্ডার) আহ্বান করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রায় দেড় বছর সময় ব্যয় হয়।
ফলে নদীর অংশে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ স্থলভাগের অংশের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে যায়। তবে, প্রথম দরপত্রের তুলনায় দ্বিতীয় দরপত্রে প্রায় ৪০ শতাংশ কম দর প্রস্তাব পাওয়া যায়। সরকারি কর্ম-পরিকল্পনা অনুযায়ী নদীর অংশের কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ৬ হাজার ৫৬ কোটি টাকা।
দেরির কারণে বাড়তি ব্যয়
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পরিচালনায় প্রতি মাসে কত টাকা খরচ হয় কর্তৃপক্ষ তা সুনির্দিষ্টভাবে না জানালেও একটি ধারণা পাওয়া গেছে প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে।
তিনি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তিন পালায় মোট ২২ হাজার জনবল কর্মরত রয়েছে, যাদের অধিকাংশই পারমাণবিক প্রযুক্তি, যন্ত্রকৌশল ও ভারী প্রকৌশল বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত। মোট জনবলের মধ্যে সাত হাজার রাশিয়ার নাগরিক আর বাকি ১৫ হাজার বাংলাদেশের প্রকৌশলী ও শ্রমিক।
তিনি বলেন, রাশিয়ার প্রকৌশলীরা মাসে ৩ থেকে ৫ হাজার ডলার বেতন পানন। গড়ে ৪ হাজার ডলার ধরলে মাসে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার খরচ হচ্ছে। এক ডলার সমান ১২০ টাকা হিসাব করলে বাংলাদেশি টাকায় ৩৩৬ কোটি টাকা।
দেশি শ্রমিকদের বেতন ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে। আর প্রকৌশলীদের বেতন ৮০ হাজার টাকা। গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে হিসাব করলে দেশি জনবলের বেতন বাবদ মাসে খরচ হচ্ছে ৭৫ কোটি টাকা। টাকার অংকটি কম-বেশি হতে পারে, বলেন প্রকল্প পরিচালক।
প্রকল্প পরিচালকের হিসাবে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে বছরে খরচ হয় ৫ হাজার কোটি টাকার মত। অর্থাৎ যত দেরি হচ্ছে ততই বাড়তি খরচ হচ্ছে।
প্রকল্পে রাশিয়া যে খরচ করছে সেটা বাংলাদেশ ঋণ হিসাবে পাচ্ছে। ঋণের এই অর্থ ২০২৭ সাল থেকে পরিশোধ করার কথা থাকলেও এখন ২০২৯ সাল থেকে পরিশোধ করার বিষয়ে একমত হয়েছে দুই দেশ।
প্রকল্পের এই বিলম্ব ও অনিশ্চয়তা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে নাগরিক সমাজের।
ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা নাগরিক সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিলম্বের কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে সেটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এত বড় প্রকল্পের চুক্তি স্পষ্ট ও উন্মুক্ত নয়। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ কেমন পড়বে তাও ঠিক করা হয়নি। তাহলে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই প্রকল্পে কেন গেলাম?”
যা ঘটেছে তার প্রতিটি ঘটনা এখন স্বাধীন-নিরপেক্ষ ব্যক্তি দিয়ে তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।
“যা কিছু ঘটেছে তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়কে দিতে হবে। এখন পর্যন্ত আমরা মন্ত্রণালয়ের কোনো ব্যাখ্যা পেলাম না,” বলেন তিনি।
'দুর্নীতির' খবরে আদালতে যাওয়ার হুমকি রোসাটমের
রূপপুরের স্বপ্ন পূরণে বড় অগ্রগতি, বসল প্রথম পরমাণু চুল্লিপাত্র