নোটিস পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে, বলেন দুদকের সচিব।
Published : 02 Jul 2024, 09:07 PM
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সম্পদের হিসাব চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
একই সঙ্গে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দিয়েছে সংস্থাটি। নোটিস পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে।
মঙ্গলবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য দেন কমিশনের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন।
তিনি বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত অনুসন্ধানকারী কমিটি প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য-রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জা, জ্যেষ্ঠ কন্যা ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর এবং মেজো কন্যা তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায়।
”অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণের নামে-বেনামে, দেশে-বিদেশে আরো স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে মর্মে তথ্য পাওয়া যায় বিধায়, তাদের দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(১) ধারা মোতাবেক পৃথক পৃথক সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারির বিষয়ে কমিশন কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তদানুযায়ী, সংশ্লিষ্টদের নামে সম্পদ বিবরণী নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে।”
অপরদিকে ‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিষয়েও অনুসন্ধান শেষ করার কথা জানিয়েছেন দুদক সচিব।
তিনি বলেন, ”মতিউর রহমান দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ হুন্ডি ও আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক গঠিত অনুসন্ধানকারী দল অনুসন্ধান শেষ করেছে।
”কমিশনের সিদ্ধান্তক্রমে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মতিউর রহমান, প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, প্রথম পক্ষের সন্তান আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব, প্রথম পক্ষের সন্তান ফারজানা রহমান ইপ্সিতা ও দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলী'র নামে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(১) ধারা ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭ বিধি ১৭(১) মোতাবেক সম্পদ বিবরণীর নোটিস জারি করা হয়েছে।”
এর আগে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিন ঠিক করলেও দুদকে হাজির হননি বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জিশান মির্জা এবং দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর।
তবে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ নিয়ে তারা তিনজনই লিখিত ব্যাখ্যা পাঠিয়েছেন বলে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন জানিয়েছিলেন।
বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক
বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ প্রধান, যিনি একাধারে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ ইউনিট র্যাবেরও প্রধান ছিলেন। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি অবসরে যান।
গত ৩১ মার্চ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ৩ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে তাকে নিয়ে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন দৈনিক কালের কণ্ঠ। সেখানে সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠে আসে। এরপর আলোচনা শুরু হয় তাকে নিয়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামে প্রায় ১৪০০ বিঘা জমিতে একটি ইকো রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন বেনজীর পরিবার। এছাড়া ঢাকা ও পূর্বাচলে তার একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে।
তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়ার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে সেই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
বনের জমি দখল করে গাজীপুরে রিসোর্ট বানানোর অভিযোগও আনা হয়েছে দৈনিকটির আরেক প্রতিবেদনে। ওই রিসোর্টের এক-চতুর্থাংশের মালিকানা বেনজীর পরিবারের বলে পত্রিকাটি দাবি করেছে।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে হবিগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এপ্রিলের শেষে বেনজীর এবং তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে দুদকে আবেদন করেন।
এরপর ২২ এপ্রিল দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, বেনজীরের ‘অবৈধ সম্পদ’ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন তারা। এজন্য তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন- উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক নিয়ামুল হাসান গাজী এবং জয়নাল আবেদীন।
একই দিন এক আদেশে দুই মাসের মধ্যে বেনজীরের বিষয়ে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন চেয়ে নির্দেশ দেয় হাই কোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী এবাদাত হোসেনের বেঞ্চ।
নির্দেশনার পর সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর ও তার পরিবারের সম্পদের খোঁজে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আটটি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয় দুদক।
পরে দুদকের আবেদনে বেনজীর, তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের স্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। সেই সঙ্গে তাদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব এবং বিভিন্ন কোম্পানিতে তাদের নামে থাকা শেয়ারও অবরুদ্ধ করার আদেশ আসে। সেই অনুযায়ী পরে ব্যবস্থাও নেয় দুদক।
বেনজীর ও তার স্ত্রী-কন্যাদের দেশের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তবে বোট ক্লাবের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগের জন্য দেওয়া চিঠিতে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিদেশে থাকার কথা বলেন। তারা সবাই দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে। এগুলোর প্রতিবাদ করেননি সাবেক আইজিপি।
ছাগলকাণ্ডের পর মতিউরের সম্পদের অনুসন্ধান
বেনজীরের সম্পদ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান শুরুর আলোচনার মধ্যে কোরবানি ঈদের সময় ‘ছাগলকাণ্ডের’ ঘটনায় আলোচনায় আসেন একাদশ বিসিএসের (শুল্ক ও আবগারি) কর্মকর্তা মতিউর রহমান।
এরপর তাকে এনবিআর থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে যুক্ত করা হয়। সরিয়ে দেওয়া হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে সরকার মনোনীত পরিচালক পদ থেকেও।
সংবাদমাধ্যমে একের পর এক মতিউর, তার স্ত্রী ও সন্তানের সম্পদের খবর আসার মধ্যে দুদক তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে।
এরপর তার দেশত্যাগের আলোচনার মধ্যে আদালত মতিউর, তার প্রথম স্ত্রী ও সন্তানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
কোরবানির জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার ফেইসবুক পোস্ট ঘিরে রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হয়।
ছাগল কিনতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন ইফাত। ধানমন্ডির বাসায় ঈদের দিন ছাগলটি কোরবানি দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তখন ছাগলসহ ইফাতের ছবি জুড়ে দিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন- ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার অর্থের উৎস কী?
এ প্রশ্ন ঘিরে সামনে আসতে থাকে ইফাতের পরিচয়। ইফাত নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে ও সংবাদমাধ্যমে বাবার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমান।
ইফাতের বাবার পরিচয় ধরে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল ব্যয়ে কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য হল কী করে?
অবশ্য ছাগলটি ইফাত শেষপর্যন্ত কেনেননি বলে দাবি সাদিক এগ্রোর কর্ণধার মোহাম্মদ ইমরান হোসাইনের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ইফাত শুধু ১ লাখ টাকা দিয়ে ছাগলটির বুকিং করেছিলেন। তবে অবশিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে ছাগলটির তিনি আর নিয়ে যাননি।
বিষয়টি নিয়ে ইফাতের বক্তব্যও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। তার দাবি, ইমরান হোসাইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তার ‘অনুরোধে’ ছাগলটি নিয়ে প্রচারের জন্য এতটা দামের কথা বলে পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি।
মতিউর রহমান এ আলোচনায় ‘ঘি ঢেলেছেন’ ছেলের পরিচয় ‘অস্বীকার’ করে। একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কেউ তার ছেলে বা আত্মীয় নয়, এমন নামে কাউকে চেনেন না পর্যন্ত। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান।
এরপর ইফাতের পরিচয় ও পারিবারিক ঠিকুজি নিয়ে ফেইসবুকে নানা তথ্য আসতে থাকে। ইফাতের সঙ্গে মতিউর রহমান এবং পরিবারের অন্যদের ছবিও প্রকাশিত হয়।
এক পর্যায়ে সামনে আসেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা।
এ সংসদ সদস্য বলেন, ইফাত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের (স্ত্রীর) ছেলে। মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি নাম লেখান রাজনীতিতে। তিনি এখন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
মতিউর রহমান এর আগে ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলের, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনার সহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৯৪ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া এ কর্মকর্তা পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সেসব দুদক তদন্তও করেছে।
বেসরকারি এক টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “চারবার দুদক তদন্ত করে দেখেছে, আমি কোনো দুর্নীতি করিনি।”
মতিউর সরকারি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসায় জড়িয়েছেন; বিনিয়োগ করেছেন পুঁজিবাজারেও।
বিপুল আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মতিউর ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, “একটা গ্রুপ অব কোম্পানির ৩০০ একরের জমিতে আমার একটা অংশ আছে। কোনো কারখানায় আমার বিনিয়োগ আছে। কিন্তু ৩০০ একর জমি বা কারখানার পুরোটা আমার না। আমাদের পরিবারের বিনিয়োগ আছে মাত্র।”
গুলশানে বেনজীরের ৪ ফ্ল্যাটে প্রবেশে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের আদেশ
বেনজীরের আরও সম্পত্তি তদারকিতে তত্ত্বাবধায়ক
বেনজীরের পাসপোর্ট ‘জালিয়াতি’: ৮ কর্মকর্তাকে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ
হাজির হননি বেনজীরের স্ত্রী-মেয়েরাও, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা: দুদক সচিব
ছাগলকাণ্ড: এনবিআর থেকে সরানো হল মতিউরকে
বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে মতিউরের স্ত্রীর আবেদন
পুঁজিবাজারে আমার বিনিয়োগ নেই: গভর্নর রউফ তালুকদার
এনবিআরের আরেক কর্মকর্তার সম্পদ ক্রোক, ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
‘ছাগলকাণ্ড’: মতিউর ও তার পরিবারের বিও হিসাব অবরুদ্ধের নির্দেশ