“এখনও টেন্ডারই শেষ হচ্ছে না, মাত্র একটা হইল-কবে পাণ্ডুলিপি হাতে পাওয়া যাবে, সেটা তো নিশ্চিত না,” বলেন ছাপাখানা ব্যবসায়ী শাহাজাহান ফরাজী।
Published : 10 Oct 2024, 01:43 AM
দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য বিনামূল্যের নতুন পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি এখনও মুদ্রণে দিতে পারেনি সরকার; ফলে সময়মত শিক্ষার্থীদের হাতে তা পৌঁছানো নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
ছাপাখানা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০২৩ সালে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে তারা কাজ হাতে পেয়েছিলেন জুলাই-অগাস্টে; পাণ্ডুলিপিও চলে এসেছিল ওই সময়ের মধ্যে।
এবারও জুলাই-অগাস্টে নতুন বই ছাপানোর দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। তবে ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর সেটি বাতিল করা হয়েছে।
এরই মধ্যে বই ছাপানোর কাজ তিন মাস পিছিয়ে গেছে। অথচ গত ৭ অক্টোবর কেবল একটি দরপত্রের কাজ শেষ হয়েছে। ফলে সময়মত বই ছাপানোর কাজ ওঠানো যাবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না মুদ্রণ ব্যবসায়ীরাও।
অবশ্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে ৩৬ কোটি বই ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিতরণের জন্য ৩৬ কোটির মত পাঠ্যবই ছাপাতে হবে বলে এনসিটিবি জানাচ্ছে। আসছে বছর ১ জানুয়ারি বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বই উৎসবের তারিখ ধরলে হাতে বাকি আছে আর তিন মাসেরও কম।
ঢাকার নুরুল ইসলাম প্রিন্টিংয়ের কর্ণধার পারভেজ আহমেদ, যিনি পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজে অভিজ্ঞ, এই বিপুল পরিমাণ বই সময়মত ছাপার বিষয়ে কয়েকটি ‘যদি-কিন্তু’র ওপর জোর দিলেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শেষ করা বলতে; এখনও তো টেন্ডার প্রক্রিয়া চলতেছে। সরকার সব কিছু ঠিকঠাক করে যদি আমাদের ওয়ার্ক অর্ডার দেয়, দ্রুত পাণ্ডুলিপি দিতে পারে; তাহলে আমরা হয়ত শতভাগ চেষ্টা করব।”
২০২৩ সালে তার ছাপাখানা থেকে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ বই মুদ্রণ হয়েছিল বলে তথ্য দেন এই ব্যবসায়ী।
বছরের বাকি সময়ের মধ্যে এবার এত বই ছাপানো সম্ভব কি না, জানতে চাইলে পারভেজ বলেন, “মেশিনের ক্ষেত্রে দুই মাসে ছাপানো সম্ভব। কিন্তু ম্যাটার রেডির ব্যাপার আছে। আবার পুরনো সিলেবাস আসতেছে, নোট-গাইড তৈরি করতে হবে। কাজটা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। একটু তো বেগ পেতেই হবে।
“সরকার পাণ্ডুলিপিটা দ্রুত রেডি করে দিয়ে দিক; অন্তত প্রতিবছর যেখানে জানুয়ারির আগে ছেপে দিয়ে দিতে পারি, এবার সব না পারলেও যাতে ৭০ বা ৮০ ভাগ ছাপা বই সরকারকে দিয়ে দিতে পারি।”
চট্টগ্রামের সাগরিকা প্রিন্টিং প্রেসের মালিক গিয়াসউদ্দিন বলেন, গত বছর তিনি দুই কোটি বই ছেপেছিলেন; এবার সময় কম থাকায় এর অর্ধেকের মত বই ছাপাতে পারবেন বলে ধারণা করছেন।
“এবার তো দুই কোটি পারব না। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ছাপানো শুরু করা গেলে সময়মত এক কোটির ভেতরে বই ছাপাতে পারব।
“আগে বই ছাপতে আমরা পর্যান্ত সময় পেতাম। এখন তো ওই সময় নেই। অতিরিক্ত কাজ নিতে পারব না আমরা। যতটুকু কাজ করতে পারব, ততটুকুই নেব। কারণ বেশি কাজ নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোটা কাম্য না।”
ফারাজী প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনসের মালিক শাহজাহান ফারাজী ২০২৩ সালে ৭০ দিনে ৫৪ লাখ বই ছেপেছিলেন। ওই পরিমাণ সময় না পেলে এবার অত বই ছাপানো সম্ভব নয় বলে তার ভাষ্য।
শাহাজাহান ফরাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার যদি সময় দেয়, তাহলে আমরা এরমধ্যে বই ছাপাতে পারব। এবার ৪৫ দিন সময় পাব বলতেছে, যতটুকু পারব ততটুকুই করে দেব।
“আগের টেন্ডারও বাতিল করছে। এখনও টেন্ডারই শেষ হচ্ছে না, মাত্র একটা হইল-কবে পাণ্ডুলিপি হাতে পাওয়া যাবে, সেটা তো নিশ্চিত না।”
পাঠ্যপুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি প্রাকৃতজ শামিমরুমি টিটন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে যখন বইয়ের পাণ্ডুলিপি মুদ্রণে আসবে, তখন আর বই ছাপানোর কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।
“এত কোটি বই কোনো দিনই এই সময়ে ছাপানো সম্ভব না। এটার জন্য তো সময় দিতে হবে। না হলে প্রেসের পরিমাণ বাড়াতে হবে। গুটি কয়েক প্রেসে বেশি বই না দিয়ে আরও প্রেসে দিতে হবে।
“সম্মিলিতভাবে কাজ করলে এবং একটা টাস্কফোর্স রেডি করলে; তারা যদি তদারকি করে, তাহলে সম্ভব।”
সংশয়ে অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা
সময়মত বই হাতে পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরাও।
তারা বলছেন, পাঠ্যবইয়ে কী পরিবর্তন আসছে সেই বিষয় এখনও স্পষ্ট নয়; এর মধ্যে যদি শিক্ষার্থীদের হাতে বই উঠতে দেরি হয়, তাহলে পড়াশোনায় একটা গ্যাপ হয়ে যাবে।
ঢাকার মিরপুর এমডিসি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রুবেল মাহমুদের বাবা ইমতিয়াজ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও তো বই সংস্কার নিয়ে স্পষ্ট বার্তা পাইনি। কবে ছাপা হবে, কে জানে! দীর্ঘদিন ধরে ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা থেকে অনেকটা দূরেই আছে- বলা যায়।
“এখন যদি বই পেতে আরও দেরি হয়, তাহলে তো চট করেই পড়ায় ফিরতে পারবে না। সময়মত বই দিয়ে দেওয়া উচিত; যে করেই হোক।”
মিরপুর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিনহাজ উদ্দিন বলেন, “নতুন বই যেহেতু দেবে; আগে আগে দিয়ে দিলেই ভালো হয়। একেবারে নতুন বই যদি দেয়, তখন তো সেটা নিয়ে আমাদের আগে থেকে কোনো ধারণাও থাকবে না।”
কী বলছে এনসিটিবি?
আসছে বছর প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিতরণের জন্য ৩৬ কোটির মত পাঠ্যবই ছাপানোর কথা বলছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি।
আগের সরকারের আমলে ২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিন স্কুলে স্কুলে উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল।
২০২৪ শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি ২ কোটি ১২ লাখ ৫২ হাজার ৬ জন শিক্ষার্থীর হাতে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ৩ হাজার ৬০৬টি বই তুলে দিয়েছিল সরকার। যার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩৯ জন, প্রাথমিকের ১ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার ৫৯৪ জন এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৮৪ হাজার ৪৭৩ জন শিক্ষার্থী পাঠ্যবই পায়।
এবার ছাপাখানার কাজ শেষে সময়মত শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই উঠবে কি না-জানতে চাইলে এনসিটিবি এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো দেখেছি নভেম্বর মাসে কাজ নিয়ে তারা (ছাপাখানা) ডিসেম্বরের মধ্যে দিয়ে দিয়েছে। সে অনুযায়ী তারা যদি কাজটা করে, তাহলে তো অবশ্যই পারব, পারব না কেন!”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থা আমূল পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। মাধ্যমিকে আবার ফিরছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ। মূল্যায়ন পদ্ধতি অনেকটাই জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ এর মত হবে।
আগামী ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের নবম ও দশম শ্রেণির বই ২০১২ সালের পুরনো সিলেবাসে ছাপানো হবে জানিয়ে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এই দুই শ্রেণির নতুন পাঠ্যবইয়ের চাহিদা পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিল এনসিটিবি।
গত ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব রহিমা আক্তারের সই করা পরিপত্রে বলা হয়, নানা সমস্যার কারণে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ ‘বাস্তবায়নযোগ্য নয়’।
এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের বাধা হিসেবে শিক্ষকদের প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠের বিষয়বস্তু ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও নেতিবাচক ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবের কথা বলা হয় সেখানে।
সিদ্ধান্ত হয়েছে, পাঠ্যক্রম সংশোধন ও পরিমার্জন করে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হবে এবং আগামী বছর থেকে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আসবে।
পরিবর্তন-পরিমার্জন হওয়ার পর কবে নাগাদ বই মুদ্রণে যাবে- জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল বলেন, “পাণ্ডুলিপি যথাসময়েই যাবে। টেন্ডার অনুযায়ী যে সময় তারা (ছাপাখানা) পায়, ওই সময়েই যাবে। তারা বই ছাপানোর জন্য ৪০ দিন সময় পাবে।”
প্রাক-প্রাথমিক থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত দরপত্র করা হয়েছে, ২০ তারিখের (অক্টোবর) মধ্যে সব দরপত্রের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে তথ্য দেন তিনি।
“এখন তো বন্ধ (সরকারি ছুটি) পড়ে গেল। সে কারণে আমরা একটু সমস্যায় পড়ে গেছি। সামনের বছর আগেই টেন্ডার করার পরিকল্পনা আছে। এবার তো আসলে পরিমার্জন করার জন্য সময় নিতে হয়েছে। না হলে আরও আগে করতাম।”
নতুন বই ছাপানোর জন্য জুলাই-অগাস্টে দরপত্র আহ্বান করা হয়, পরে সেপ্টেম্বরের শুরুতে সেটি বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাতিলের কারণ জানতে চাইলে রিয়াজুল হাসান বলেন, “ওই টেন্ডারটা প্রস্তুত হইছিল নতুন কারিকুলামের বই দেওয়ার জন্য। ২০১২ সালের সিলেবাসে বই দেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ায় বইয়ের সংখ্যা, পৃষ্ঠা, বইয়ের নাম সব পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ কারণে ওইটা (টেন্ডার) বাধ্য হয়ে বাতিল করেছে সরকার।”
ক্ষমতার পালাবদলের পর সংস্কারের অংশ হিসেবে আগের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কথা বলেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এরই অংশ হিসেবে এনসিটিবির প্রকাশিত বিনামূল্যের প্রণয়ন করা এবং ছাপানো সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয় করতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে।
যদিও দশ সদস্যের কমিটির কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে সমালোচনা ও আলোচনার মধ্যে দুই সপ্তাহের মাথায় মন্ত্রণালয় ওই কমিটি বাতিল করে।
তবে সম্প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় পাঠ্যবই দ্রুত পরিমার্জন করার কথা বলেছেন জোর দিয়ে।
এ কারণে ‘কিছু ভুল-ভ্রান্তিও থেকে যেতে পারে’ বলে আগেই শঙ্কা ব্যক্ত করে রেখেছেন তিনি।
উপদেষ্টা বলেন, “ছেলে-মেয়েদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার বাধ্যবাধকতার কারণে মাত্র দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে পাঠ্যপুস্তকের পরিমার্জন করতে হয়েছে। তাতে হয়ত কিছু ভুল-ভ্রান্তি থেকে যাবে।
“আশা করি সব মহলের ও শিক্ষাবিদদের পরামর্শে শিক্ষাক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পরবর্তীতে আরও সংস্কার সম্ভব হবে।”
আরও পড়ুন