“আগামী বছর এই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা ‘শিক্ষা সংস্কার পরামর্শক কমিটি’ গঠনের চিন্তা করছি,” বলেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
Published : 17 Oct 2024, 01:45 AM
ক্ষমতার পালাবদলের পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রণীত সর্বশেষ শিক্ষাক্রম থেকে সরে এসে অন্তর্বর্তী সরকার অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষা সংস্কারের কথা বলে এলেও এর সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এখনো সামনে আনতে পারেনি।
সরকার আশা করছে, নতুন ‘কারিকুলাম‘ প্রণয়ন নিয়ে ২০২৫ সালে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেওয়া সম্ভব হবে।
তবে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষা নিয়ে বারবার কাটাছেঁড়া করলে খাপ খাওয়াতে তাদের অসুবিধা হবে।
আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থায়ী এবং কার্যকরী কারিকুলাম তৈরি করতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকারের আওতা থেকে সরিয়ে একটি কমিশনের মাধ্যমে পরিচালনা করা উচিত।
মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে ‘শিক্ষাক্রম-২০২২’ প্রস্তুত করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সেই আলোকে ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠদানও করা হয়। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিও যুক্ত হয় সেই শিক্ষাক্রমে।
নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না রাখা, মাধ্যমিকের আগে পাবলিক পরীক্ষা না নেওয়া, নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগভিত্তিক বিভাজন তুলে দেওয়াসহ একগুচ্ছ পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
চাপ কমাতে বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়নের আগে শিক্ষাবর্ষজুড়ে চালু হয় শিখনকালীন মূল্যায়ন। বেশ কিছু বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হয় শতভাগ।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থা আবার আমূল পাল্টে ফেলার কথা বলা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, মাধ্যমিকে ফিরছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ; যেখানে মূল্যায়ন পদ্ধতি হবে সেই এক যুগ আগের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ এর মত।
গত ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব রহিমা আক্তারের সই করা এক পরিপত্রে বলা হয়, নানা সমস্যার কারণে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ ‘বাস্তবায়নযোগ্য নয়’।
এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের বাধা হিসেবে শিক্ষকদের প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠের বিষয়বস্তু ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে অস্পষ্টতা এবং নেতিবাচক ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবের কথা বলা হয় সেখানে।
এর আগে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি সামনে রেখে তথ্য-প্রযুক্তিতে গুরুত্ব দিয়ে সৃজনশীল শিক্ষার প্রসারে ২০১২ সালে শিক্ষাক্রম তৈরি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সে সময় সৃজনশীল পদ্ধতি, পিএসসি ও জেডিসি পরীক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
পরীক্ষা ও মুখস্ত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতেই এক যুগ আগের সেই শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে ২০২২ সালে নতুন শিক্ষাক্রম রচনা করা হয়।
২০২৩ সাল থেকে বাতিল করা হয় জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা। ২০২২ সাল থেকে নেওয়া হচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাও।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ক্ষমতায় বসা অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনায় পাঠ্যবই সংস্কারের কাজ চলছে এখন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবির শিক্ষাক্রম উইংয়ের সদস্য অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পর্যন্ত শুধু পাঠ্যবই পরিমার্জনের কাজ চলছে, এর বাইরে শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের কোনো কাজ শুরু হয়নি।”
তবে সংস্কারের অংশ হিসেবে ২০২৫ সালে নতুন একটি ‘কারিকুলাম’ প্রণয়নের পরিকল্পনা রয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন তিনি।
অধ্যাপক রবিউল বলেন, ওই কারিকুলাম একপাক্ষিক মতামতের ভিত্তিতে তৈরি হবে না। অনেক বিশেষজ্ঞ, স্টেকহোল্ডার, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ এবং অভিভাবদের মতামতের ভিত্তিতে তারা সেটি তৈরি করবেন।
খরচ 'বাড়িয়েছে' নতুন শিক্ষাক্রম: গবেষণা
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিতর্ক কেন?
“যুগের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে, ধরেন- সমাজিক উদ্যোক্তা তৈরি, জলবায়ু পরিবর্তন, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইস্যু; এসব কীভাবে সমাধান করা যায়, আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় কোনটা দরকার, সামাজিক অবিচারগুলো কীভাবে দূর করা যায়, এগুলা সামনে রেখে শিক্ষাক্রম করার চেষ্টা করা হবে।
“তখন ওই শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য পূরণের জন্য যে পদ্ধতিতে মূল্যায়নের প্রয়োজন হবে, সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মতামতকেও প্রাধান্য দেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, “সমাজ যেটা চায়, সে রকম পদ্ধতিই হবে।”
শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বিষয়ে (কারিকুলাম প্রণয়ন) দেশ ও দেশের বাইরে থাকা বিশেষজ্ঞদের মতামত সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে।
“আগামী বছর এই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা ‘শিক্ষা সংস্কার পরামর্শক কমিটি’ গঠনের চিন্তা করছি। তবে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা তো অনেক বড় জিনিস। এর সঙ্গে রাজনৈতিক দর্শন, রাজনৈতিক তোষামোদি, অর্থনৈতিক রূপরেখা, কর্মসংস্থান কেমন হবে- সব কিছু জড়িত। এ ধরনের পুরো বিষয় নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ হবে।”
কারিগরি শিক্ষারও সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কী পরিবর্তন আসছে পাঠ্যবইয়ে?
পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের সঙ্গে যুক্তরা বলছেন, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য বইগুলোতে ‘আমূল পরিবর্তন’ আসছে না। তবে ইতিহাসবিষয়ক অনেক তথ্য পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা হবে।
আগামী শিক্ষাবর্ষের নবম ও দশম শ্রেণির বই ২০১২ সালের পুরনো সিলেবাসে ছাপানো হবে জানিয়ে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এ দুই শ্রেণির নতুন পাঠ্যবইয়ের চাহিদা পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিল এনসিটিবি।
সিদ্ধান্ত হয়েছে, পাঠ্যক্রম সংশোধন ও পরিমার্জন করে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। আগামী বছর থেকে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আসবে।
এনসিটিবির শিক্ষা ও সম্পাদনা শাখার প্রধান সম্পাদক ফাতিহুল কাদির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নির্দেশে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে লেখক-সম্পাদকদের একটি প্যানেল তৈরি করা হয়। ওই প্যানেল বই সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ করছে।
“বইগুলো একেবারে আমূল পরিবর্তন করার সময় আমাদের হাতে নাই। তাহলে আবার জানুয়ারির ১ তারিখে বই দেওয়া যাবে না।”
কী কী পরিবর্তন আসছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পাঠ্যবইয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য, ইতিহাসের বিকৃতি, অতিমাত্রায় ব্যক্তি তোষণ, বিষয়বস্তুতে অসত্য বিষয়, কাউকে কাউকে সরিয়ে ফেলার ব্যাপার আছে; সেগুলো বাতিল করা হবে। তবে কাউকে একেবারে বাদ দেওয়া বা অস্বীকারও করা হবে না।
“কিন্তু বাড়াবাড়িগুলোকে আমরা রাখব না। ইতিহাসের আলোচনা প্রসঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণায় শুধু বঙ্গবন্ধুর নাম, সেখানে জিয়াউর রহমানের নাম ছিল না। এবার জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটার কথাও থাকবে।
“বঙ্গবন্ধু পরিবারকে নিয়ে বেশি মাত্রায় কনটেন্ট দেওয়া আছে, ওই জিনিসগুলোকে আমরা যৌক্তিক জায়গায় আনব। মাদ্রাসার বইয়েও একই রকম পরিবর্তন হবে।”
নতুন শিক্ষাক্রম: আনন্দের মাঝে অভাবও 'অনেক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি অংশ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা বইয়ে ছিল দীর্ঘদিন ধরে, সেটি এবার সরিয়ে ফেলা হবে বলে জানাচ্ছেন ফাতিহুল কাদির।
তিনি বলেন, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য তৈরি করা পাঠ্যবইয়ের ওপরই পরিবর্তন আর পরিমার্জন করছেন তারা।
“এর বাইরে আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ সময় খুবই কম।“
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনায় পাঠ্যবই পরিমার্জন ও সংশোধন করা হচ্ছে। সেখানে যেসব ঘটনা ইতিহাসে অতিরঞ্জন আছে সেগুলো এবং কোনো ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর মানহানিকর কথা যদি থাকে; সেগুলোকে মুছে ফেলা হবে।”
পাণ্ডুলিপি মুদ্রণে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যতটুকু পরিবর্তন করা সম্ভব হয়, ততটুকুই আনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রিন্টিং অর্ডার দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা পরিমার্জন করব। প্রিন্ট অর্ডার শুরু হতে আরও ১৫ থেকে ২০ দিন যাবে।”
ক্ষমতার পালাবদলের পর সংস্কারের অংশ হিসেবে আগের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কথা বলেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
এরই অংশ হিসেবে এনসিটিবি প্রণীত ও ছাপানো বিনামূল্যের সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন-পরিমার্জন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন এবং সমন্বয় করতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে।
দশ সদস্যের ওই কমিটির কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে দুই সপ্তাহের মাথায় মন্ত্রণালয় ওই কমিটি বাতিল করে, যা নিয়েও হৈ চৈ শুরু হয়।
নতুন শিক্ষাক্রম: জিপিএ যুগের অবসান, মূল্যায়ন ৭ স্কেলে
নবম শ্রেণিতে 'নতুন শুরু' কেমন হল
ওই কমিটির সদস্য শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাঠ্যবইয়ের পরিমার্জন কীভাবে হবে, তা সমন্বয় করা ছিল ওই কমিটির কাজ। তবে সেই কাজ করার সুযোগ তাদের হয়নি।
“দুটো মিটিং হয়েছিল, একটাতে একজন যুক্ত হয়েছিল; আরেকটাতে দুজনের নাম প্রস্তাব হয়েছিল তাদের এখানে যুক্ত করা হবে। এর বাইরে পাঠ্যবই সংশোধন নিয়ে আমাদের কোনো পরামর্শ ছিল না।”
তবে নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার তাড়া থাকায় পাঠ্যবই দ্রুত পরিমার্জনের কাজে ‘কিছু ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে রেখেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তিনি বলেন, “ছেলে-মেয়েদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার বাধ্যবাধকতার কারণে মাত্র দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে পাঠ্যপুস্তকের পরিমার্জন করতে হচ্ছে। তাতে হয়ত কিছু ভুল-ভ্রান্তি থেকে যাবে।
“আশা করি সকল মহলের ও শিক্ষাবিদদের পরামর্শে শিক্ষাক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পরবর্তীতে আরও সংস্কার সম্ভব হবে।”
বারবার পরিবর্তনের কী প্রভাব?
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষাক্রম-২২ চালু হওয়ার পর যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন তারা। কিন্তু আবার যে পুরনো সিলেবাস ফেরা হচ্ছে, তাতে পুরোপুরি সক্রিয় হওয়া এখনই ‘সম্ভব হবে না’। আর বারবার এমন পরিবর্তন তাদের মনোযোগে প্রভাব ফেলছে।
নরসিংদীর দেওয়ানের চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী আখতার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে মুখস্ত শিক্ষা থেকে বেরিয়ে ব্যবহারিক পড়াশোনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে।
“গ্রুপ করে আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করতাম। আলাদা শিক্ষক, গাইড বই এসব লাগত না। এখন আবার যদি মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখতে হয়, তখন কষ্ট হবে। কয়েক দিন পরপর পরিবর্তন হইলে তো পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া যায় না, ফলে শেখাটাও হচ্ছে না।”
মিরপুরের মডেল অ্যাকাডেমি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, এই বারবার পরিবর্তনের ফলে তাদের ওপর চাপ পড়ছে।
“একটাতে খাপ খাওয়াতে অনেক সময় লাগছে। তার মধ্যে আবার পরিবর্তন আসলে খাপ খাওয়ানোটা কষ্টকর। কোনটাতে কী শিখব, সেটাই তো বুঝি না। বদলটা যেন আর না হয় সেটাই আমাদের চাওয়া।”
আবরারের মা জাকিয়ার ভাষ্য, শিক্ষার্থীদের জন্য স্থায়ী এবং যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
“কয়েক দিন পরপর পরিবর্তন মোটেও কাম্য না। তাদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা বন্ধ হোক, তারা সব সময় কোনটাতে কী হবে- না হবে; তা নিয়েই চিন্তায় থাকে।
“শিক্ষা রাজনীতির ওপরে হওয়া উচিত আমি মনে করি। এমন ব্যবস্থা থাকুক যাতে ওরা (শিক্ষার্থীরা) অন্তত কিছু শেখে।”
লেখক ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষায় যে পরিবর্তন আসে, এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়।
“শিক্ষার্থীরা তো ‘গিনিপিগ’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বারবার বদলালে সেটা তো নেগেটিভই হবে। এগুলা বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর, বড়দের এসব বুঝতে হবে। হুট করে পরিবর্তন করে দিলাম, সরকার পরিবর্তন হয়েছে বলে সেটা মোটেও ঠিক না।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছেন, অহরহ পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা খুবই অস্থিতিশীলতা বোধ করেন।
“এসে বলে দিল- সব (শিক্ষাক্রম-২০২২) বাদ। যারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের সঙ্গে বসে এই পরিস্থিতিতে কী করা যায়, সে আলোচনা করা যেত।”
সমাধান কী?
বারবার কাটাছেড়ার সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ের বিষয়টি সরকার থেকে আলাদা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক কায়কোবাদ।
“আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত এসব দলের পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতির শিক্ষার পরিবর্তন করতে হবে; সেটা আমি মনে করি না। শিক্ষাকে আরও বড় পর্দায় দেখতে হবে। কোনো দলের পর্দা দিয়ে দেখলে হবে না। জাতির জন্য ভালো- এমন সবই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”
জাপান, তাইওয়ানসহ যেসব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি হয়েছে, সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে কারিকুলাম তৈরি করার পরামর্শ দিচ্ছেন এই শিক্ষাবিদ।
“আমাদের শিক্ষা গবেষণার শিক্ষকরা গবেষণা করবেন, ৩০ থেকে ৫০ বছর পর তারা চিন্তা করবেন- এটার পরিবর্তন প্রয়োজন আছে কি না। অহরহ পরিবর্তনের কোনো মানে হয় না। সরকার পরিবর্তন হয়ে গেল আর শিক্ষার ‘এ হবে, সে হবে’- এসবের প্রশ্নই ওঠে না। অনেক অনেক গবেষণা করতে হবে।”
শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য স্থায়ী কমিশন তৈরি করা প্রয়োজন; যার অধীনে শিক্ষার পরিবর্তন, পরিমার্জন বা উন্নয়ন হবে।
“বারবার পরিবর্তন হচ্ছে। ভালো কথা বলে শুরু হয় কিন্তু কাজটা তো বুঝতে হবে। এবং এটা দীর্ঘমেয়াদী কাজ। ফলে এত অস্থিরতার মধ্যে তো ভালো কাজ করা মুশকিল।
“পরিবর্তনের জন্য শুধু পরিবর্তন করলাম বা খারাপ ভেবে নিয়ে আগে বাতিল করব- এই মানসিকতা দিয়ে চলবে না আসলে। প্রত্যেকটা জিনিস আলাদা করে বিচার করে ঠিক করতে হবে।”
তিনি বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমটা শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো ছিল। তবে যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের দরকার ছিল বাকিদের বোঝানো।
“করা হয়নি (বোঝানো হয়নি), সে কারণে বিভ্রান্তি ছিল। সেটাকে কাজে লাগিয়ে অন্যরা মানহীন হিসেবে ঠিক করে ফেললেন।”
এত পরিবর্তন শেষে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত কোথায় স্থির হবে?
এনসিটিবির কর্মকর্তা অধ্যাপক রবিউল কবীর বলছেন, “সমাজ যেদিন স্থির হবে; শিক্ষা ব্যবস্থা সেদিন স্থির হবে। যে পদ্ধতিকে তারা মেনে নেবে, সেটাই হবে। তার বাইরে কোনো কিছু হবে না।”