নানা বিতর্কের মধ্যে নবম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমের যাত্রা শুরু হল। শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়টি উপভোগ্য, তবে অভিভাবকদের মধ্যে রয়ে গেছে অনেক প্রশ্ন।
Published : 20 Jan 2024, 12:38 AM
বড় পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে জানুয়ারিতে নবম শ্রেণির ক্লাস শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। আগের শিক্ষাবর্ষগুলোর মত এবার বিজ্ঞান, মানবিক কিংবা বাণিজ্যের বিভাজনে শ্রেণিকক্ষে ঢুকতে হয়নি তাদের।
জাতীয় নির্বাচনের কারণে এবার বছরের প্রথম দিন থেকে ক্লাস শুরু হয়নি স্কুলগুলোতে। কোথাও ১৪ জানুয়ারি, কোথাও তার পরদিন থেকে ক্লাসে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা।
তাদের দিয়েই মাধ্যমিকের ‘নতুনের যাত্রা’ শুরু হল। তারা একাদশ শ্রেণিতে উঠলে খোলনালচে পাল্টে যাবে উচ্চ মাধ্যমিকেও।
এই পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকদের একাংশের উদ্বেগ কাটছে না। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালো লাগা আছে। তারা গ্রুপ হিসেবে অ্যাসাইনমেন্ট করছে। একজনের কাছ থেকে আরেকজন শিখতে পারছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এনসিটিবি বলছে, এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদেরকে ‘জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলানোর মত করে’ যোগ্য করে তুলবে।
শিক্ষাক্রমে বড় যেসব পরিবর্তন এসেছে, তার একটি হল মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন না রাখা। অর্থাৎ নবম শ্রেণিতে এতদিন বিষয় অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের আলাদা করে দেওয়ার যে পদ্ধতি ছিল, এখন তা নেই।
এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তির শেষ নেই। শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন বিরোধীরা দাবি করে আসছেন, শিক্ষার্থীরা এখন বিজ্ঞান ‘কম পড়বে’; ‘ঘাটতি নিয়ে’ উচ্চ মাধ্যমিকে যাবে।
আবার নতুন যে মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকছে, সেখানে কোনো নম্বর বা গ্রেডিং থাকছে না। এ নিয়েও আপত্তি আছে অভিভাবকদের একটি বড় অংশের।
পাঠ্যক্রম নিয়েও বিতর্ক চলমান। এই শিক্ষা পদ্ধতি বৈষম্য তৈরি করবে বলে মত দিচ্ছেন কেউ কেউ। তাদের যুক্তি, মফস্বল বা গ্রামের অনেক স্কুলে এ পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই।
নতুন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠন।
এনসিটিবি অবশ্য বলছে, সমালোচকদের বক্তব্য বাস্তব তথ্যভিত্তিক নয়। তাদের দাবি, এখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান চর্চা বাড়বে। মূল্যায়ন পদ্ধতিও শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় তাদের অবস্থানের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরবে।
নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন, আগামীতে প্রয়োজনে পরিবর্ধন পরিমার্জন হবে সব কিছুতে। তবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন জরুরি, এমন কথাও বলেছেন তিনি।
কেমন লাগছে শিক্ষার্থীদের?
ঢাকার সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের মালিবাগ শাখার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী কাজী তাহমিন ইসলাম তামিম সপ্তাহখানেক ধরে নতুন শিক্ষাক্রমে ক্লাস শুরু করেছে।
কেমন লাগছে, এই প্রশ্নে তার জবাব, “নতুনভাবে শুরু হল। আমাদের গ্রুপ করে ক্লাস করতে হয়। এটা একদিকে ভালো, আরেকদিকে খারাপ। আমি যেটা পারলাম না, আরেকজন সেটা পারে। এতে একজনের ওপর চাপ পড়ে না। সবাই মিলে কাজটা করা যায়।
“আবার ক্লাসে বই অতটা পড়ায় না। গ্রুপ ওয়ার্ক দেয় বেশি। বইয়ের খুঁটিনাটি বিষয় কম পড়ায়, ছক করায় বেশি।”
নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার বারৈচা গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণির পিংকি আক্তারের কাছে ভালো লেগেছে নতুন শিক্ষাক্রম।
“ক্লাস করে ভালই লাগছে। গ্রুপে ক্লাস হয়, সহপাঠীদের মধ্যে আলোচনা হয়, এটা ভালো লাগে। তবে পরীক্ষা খুব কম, পরীক্ষা বেশি থাকলে ভালো হত। এতে বাসায় পড়া হত বেশি।”
বিজ্ঞান শিক্ষা কমবে?
নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার বিভাজন না থাকায় শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়বে বলে মনে করেন সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমার বাচ্চা বিজ্ঞান পড়তে চায় কিন্তু সে সেটা পড়তে পারছে না। তার মানে একটা ‘পুওর সায়েন্স’ ও ‘পুওর ম্যাথ’ নিয়ে তাকে দশম শ্রেণি পার করতে হবে এবং এর সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে সেখানেও সে তেমন কিছু শিখতে পারবে না।”
তবে এনসিটিবির সদস্য মো. মশিউজ্জামানের দাবি, শিক্ষাক্রমে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতে বিজ্ঞান শিক্ষায় ঘাটতি তৈরি হবে না।
তার মতে, দশম শ্রেণি পর্যন্ত সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ‘বেসিক এডুকেশন’ নিশ্চিত করা। আর একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে ‘ব্রিজিং’ তৈরি করবে।
তার যুক্তি, দশম শ্রেণি পর্যন্ত এতদিন সারাদেশে ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান পড়ত। বাকি ৮১ শতাংশের যতটুকু বিজ্ঞান জানা দরকার, তার চেয়ে কম জানত। ফলে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ তৈরি হচ্ছিল না।
আবার মাধ্যমিকে যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ত, ফলাফল খারাপ করে তাদের অর্ধেক একাদশে মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে চলে যেত।
“তাহলে মোট শিক্ষার্থীর ৯০ ভাগই আসলে বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। এখন আমরা বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছি শতভাগ শিক্ষার্থীর মধ্যে। অর্থাৎ ১০০ ভাগ শিক্ষার্থীই বিজ্ঞান শিখবে,” বলেন মশিউজ্জামান।
মাধ্যমিকের ‘ঘাটতি’ বিবেচনায় নিয়ে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, উচ্চ শিক্ষায় এখন বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটির জন্য ৫০০ নম্বর বাধ্যতামূলক। বিভাগের (বিজ্ঞান, মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষা) বিষয়ের জন্য আছে ৬০০ নম্বর।
“নতুন শিক্ষাক্রমে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ৭৫ শতাংশ পড়াই থাকবে বিভাগভিত্তিক। অর্থাৎ দুই বছরে ২৫ শতাংশ মনোযোগ একটা বিষয়ে দিতে পারবে। এতে করে যতটুকু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, ততটুকু সে একাদশ-দ্বাদশে পূরণ করে ফেলবে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ঘাটতি নিয়ে উচ্চ শিক্ষায় যেতে হবে না।”
মফস্বল-গ্রামের স্কুল কি পারবে?
নতুন শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে ছোট শহর বা গ্রামের স্কুলগুলোর তাল মেলানোর সক্ষমতা আছে কি না, সেখানকার শিক্ষকদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার যোগ্যতা আছে কি না, এসব প্রশ্ন নিয়ে কথা হচ্ছে কয়েক মাস ধরে।
সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খুব কম সংখ্যক স্কুলের সক্ষমতা আছে। বাকিদের তা তো নাই। দেশের চার-পাঁচ লাখ শিক্ষকের মধ্যে কয়েক শতাংশের শিক্ষার্থীদের বোঝানোর জ্ঞান আছে। বাকিদের তো সেই যোগ্যতা নাই।
“কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে দেখা যাবে, শিক্ষার্থীরা এই নতুন শিক্ষাক্রম ভালোভাবে শিখছে। কিন্তু বাকিরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে শিক্ষায় বৈষম্য বেড়ে যাবে।”
তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বাড়তি কোনো কিছুর দরকার নেই।
তিনি বলেন, “চারপাশের নানা উপকরণের ব্যবহারেই সেটা শিক্ষার্থীদের কাছে আনন্দদায়ক করে তোলা সম্ভব। গ্রামের স্কুলগুলোতে আমরা দেখেছি, আমরা রিপোর্ট পেয়েছি, তাদের অনেকে অনেক ভালোভাবে এটা বাস্তবায়ন করছে।”
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী শিক্ষকরা অন্যদের শেখাবেন। এভাবেই বিষয়টি চলছে। এটি প্রতিষ্ঠান প্রধান তদারকি করবেন। প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ ক্লাস নেবে না। সেজন্য স্বীকৃতি নাই, তাদেরও তালিকা সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।”
মূল্যায়ন নিয়ে উদ্বেগ কাটেনি
এ বছর যারা নবম শ্রেণিতে পড়ছে, তারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় আগের মত জিপিএ পাবে না। এমনকি নম্বরও থাকছে না।
এখন থেকে নবম আর দশম শ্রেণির জন্য থাকছে আলাদা বই। একসঙ্গে দুই বছরের পরীক্ষাও আর থাকছে না। বরং শ্রেণিকক্ষেই হবে মূল্যায়নের বেশিরভাগ।
গ্রেড ও নম্বর তুলে দিয়ে এই মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে এখনো উদ্বেগ রয়ে গেছে।
রাজধানীর মালিবাগের সাউথ পয়েন্ট স্কুলের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নূরজাহান ইসলামের শঙ্কা, তার সন্তান নতুন শিক্ষাক্রম ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারবে না।
তিনি বলেন, “আমার বাচ্চা একটু অন্তর্মুখী। আগে তো শিক্ষকের কাছে পড়িয়ে বা নিজে বুঝিয়ে দিতে পারতাম। এখন সে কীভাবে শিখবে সবকিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। কারণ, এখান থেকেই তো উচ্চ শিক্ষার পথটা তৈরি হবে।”
মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এক অভিভাবক বলেন, “ক্লাসে যতই শিখুক, পরীক্ষা না হলে বাচ্চারা মন দিয়ে পড়ে না। দুই মাসে অন্তত একটা পরীক্ষা থাকা উচিত ছিল। বছরের শেষে তো ঠিকই পরীক্ষা হবে। এটা আগেভাগে নিলে তো কোনো সমস্যা ছিল না।”
এনসিটিবির সদস্য মশিউজ্জামান নম্বর উঠিয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বলেন, “একটা বাচ্চা বাংলায় ৭০ পেলে বোঝা যায়না যে সে সৃজনশীল ভালো পারে বা ব্যাকরণ ভালো বোঝে। অ্যাপের মাধ্যমে মূল্যায়নের আইকন শিক্ষার্থীরা সব সময় দেখতে পাবে। সে বুঝতে পাবে কোন স্তর আছে।
“আমরা ৭ পয়েন্টের একটি লেভেলিং করছি। লেভেল কিছু হাই-লো থাকবে। সেগুলো স্রেফ কতগুলো চিহ্ন। পারদর্শিতার সূচক আছে। সে প্রাথমিক স্তরে, নাকি মাঝামাঝি স্তরে নাকি দক্ষতা স্তরে আছে- সেগুলো বোঝানোর জন্য সূচক আছে।”
এনসিটিবির চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “নৈপুণ্য অ্যাপের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। কোন বিষয়গুলো সে ভালোভাবে জানছে বা দুর্বল, কোনটায় কীভাবে দক্ষ হয়ে উঠছে, সে বিষয়গুলো সেখানে লেখা থাকবে।”
নবম শ্রেণির মূল্যায়ন স্কুলেই হয়ে যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণির বই দিয়ে। দশম শ্রেণির বইটা এমনভাবে লেখা হবে যেন, উচ্চ মাধ্যমিকে যে যেই বিষয়ে পড়তে চায়, যেন সেগুলো পড়তে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা বরং আরো ভালোভাবে বিষয়গুলো আয়ত্বে আনতে পারবে।”
ডিসেম্বরে এসএসসি, উচ্চমাধ্যমিকে বাড়বে শিক্ষার সময়
বাংলাদেশে সাধারণত ফেব্রুয়ারির শুরুতে মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষার পর ফলাফল পেতে অপেক্ষা করতে হয় দুই মাস।
তবে নতুন শিক্ষাক্রমে বিভাগ বিভাজন না থাকায় পরীক্ষা ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আসবে। এসএসসি পরীক্ষা চালাতে আগে ৩৩ কর্মদিবস লাগত। এখন লাগবে ১০ কর্মদিবস।
অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, “হয়ত ডিসেম্বরে আমরা এসএসসি পরীক্ষাটা নিয়ে নেব। রেজাল্ট হতে লাগবে ১৫ দিন। মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর একাদশে সাধারণত জুলাইয়ে ক্লাস শুরু হয়। তবে ২০২৫ সালে যারা দশম শ্রেণিতে পড়বে, তারা পরের বছরের শুরুতেই উচ্চ মাধ্যমিকে চলে যাবে।”
এতে একাদশ ও দ্বাদশ মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা ২২ মাস সময় পাবে, এখন পাচ্ছে ১৮ মাস। এই চার মাস বেশি পড়ার কারণে তাদের শেখার সুযোগ বাড়বে।
আরও পড়ুন:
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিতর্ক কেন?
নতুন শিক্ষাক্রম: আনন্দের মাঝে অভাবও ‘অনেক’